The formulas of Organon Medicine.

The formulas of Organon Medicine.

(১) চিকিৎসকের উদ্দেশ্য Aim of Physician (সূত্র-১)
সূত্রঃ ১। চিকিৎসকের একমাত্র মহৎ উদ্দেশ্য-
(২) আদর্শ নিরাময় Ideal cure (সূত্র-২)
সূত্রঃ ২। আদর্শ আরোগ্যের শর্তসমূহ-
(৩) চিকিৎসকের যোগ্যতা Physician’s qualification (সূত্র-৩-)
সূত্রঃ ৩। চিকিৎসকের গুণাবলী-
সূত্রঃ ৪। প্রকৃত স্বাস্থ্য সংরক্ষক চিকিৎসক-
সূত্রঃ ৫। রোগের মূল কারণ ও উত্তেজক কারণ-
(৪) রোগ লক্ষণ/রোগের প্রকাশ Manifestation of disease (সূত্র-৬-৮)
সূত্রঃ ৬। রোগের প্রকৃত পরিচয় ও উহার পর্যবেক্ষণ-
সূত্রঃ ৭। লক্ষণসমষ্টিই উপযুক্ত ঔষধ নির্বাচনের একমাত্র নির্দেশিকা-
() স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার Restoration of health (সূত্র-)
সূত্রঃ ৮। লক্ষণসমষ্টির অবসানই আরোগ্য প্রাপ্তি-
(৬) জীবনীশক্তি Vital Force (সূত্র-৯-১৭)
সূত্র- ৯। জীবনশক্তির প্রভাবে মানবদেহ সজীব থাকে-
সূত্রঃ ১০। জীবনীশক্তি একটি অভৌতিক সত্ত্বা-
সূত্রঃ ১১। রোগ বা জীবনীশক্তির আক্রান্ত অবস্হা-
সূত্রঃ ১২। আক্রান্ত জীবনীশক্তি এক সাথেই বিশৃঙ্খল হয় আবার রোগ-লক্ষণ বিদূরিত হইলে এককালেই স্বাস্থ্য পুনঃস্থাপিত হয়-
সূত্রঃ ১৩। কোন রোগই দেহ হইতে পৃথক বস্তু নহে-
সূত্রঃ ১৪। দেহাভ্যন্তরে রোগের অবস্থিতি চিকিৎসকের নিকট ধরা পড়িবেই-
সূত্রঃ ১৫ । জীবনীশক্তির অসুস্থতা এবং প্রকাশিত লক্ষণসমষ্টি অভিন্ন-
সূত্রঃ ১৬ । সূক্ষ্ম রোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত সূক্ষ্ম জীবনীশক্তি সূক্ষ্ম ঔষধশক্তি দ্বারাই আরোগ্যপ্রাপ্ত হয়-
সূত্রঃ ১৭ । রোগলক্ষণ দূরীভূত হইলে সমগ্র পীড়াটিও দূরীভূত হয়-
(৭) লক্ষণ সামগ্রিকতা Symptom totality (সূত্র-১৮)
সূত্রঃ ১৮। লক্ষণসমষ্টিই রোগের নিদর্শন এবং ওষুধ নির্বাচনের একমাত্র নির্দেশক-
(৮) ঔষধ ও আরোগ্য নীতি Medicine and Health Policy (সূত্র-১৯-২৪)
সূত্রঃ ১৯। ঔষধের স্বাস্থ্য পরিবর্তনকারী শক্তি-
সূত্রঃ ২০। ঔষধের স্বাস্থ্য পরিবর্তনকারী শক্তির উপলব্ধি-
সূত্রঃ ২১। ঔষধের আরোগ্যসাধিকা শক্তির পরিচয়-
সূত্রঃ ২২। রোগ নির্মূলের জন্য প্রয়োগকারী ঔষধসমূহের প্রকারভেদ-
সূত্রঃ ২৩। বিসদৃশ ওষুধের রোগারোগ্যের ক্ষমতা নাই-
সূত্রঃ ২৪। রোগলক্ষণের সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন ঔষধই রোগ আরোগ্য করিতে পারে-
(৯) হোমিওপ্যাথিক নিরাময়ের বিধান Homeopathic law of cure (সূত্র-২৫-২৯)
সূত্রঃ ২৫। সদৃশ ঔষধের সঠিক শক্তি ও মাত্রা প্রয়োগ করিতে হইবে-
সূত্রঃ ২৬। মানবদেহে দুইটি সদৃশ প্রাকৃতিক রোগ থাকিলে-
সূত্রঃ ২৭। কোন ঔষধ সমূলে রোগ বিনাশ করে-
সূত্রঃ ২৮। আরোগ্য সাধনের সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য-
সূত্রঃ ২৯। সদৃশনীতি অনুসারে আরোগ্য সাধনের পদ্ধতি-
(১০) প্রাকৃতিক রোগ ও ঔষধের শক্তি The power of natural disease and medicine (সূত্র-৩০-৩৪)
সূত্রঃ ৩০। পীড়ার প্রাবল্য ও প্রকৃতি অনুসারে ঔষধের শক্তি নির্ধারণ-
সূত্রঃ ৩১। কখন জীবনীশক্তি রোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়-
সূত্রঃ ৩২। ঔষধশক্তি সকল অবস্থায় জীবনীশক্তিকে আবিষ্ট করিতে পারে-
সূত্রঃ ৩৩। রোগশক্তি অপেক্ষা ঔষধশক্তি অধিকতর শক্তিশালী-
সূত্রঃ ৩৪। আরোগ্যক্রিয়ায় ঔষধ হইতে হইবে অধিকতর শক্তিসম্পন্ন এবং সদৃশ-
(১১) অসংগতি আইন Law of dis-similar (সূত্র-৩৫-৪২)
সূত্রঃ ৩৫। বিসদৃশ নীতিতে আরোগ্য হয় না-
সূত্রঃ ৩৬। মানবদেহ একই সময়ে দুইটি বিসদৃশ পীড়া একত্রিত হইলে কি হয়-
সূত্রঃ ৩৭। চিররোগে বিসদৃশ চিকিৎসায় কোন ফল হয় না-
সূত্রঃ ৩৮। দুইটি বিসদৃশ পীড়ার মধ্যে নবাগত পীড়াটি প্রবলতর হইলে-
সূত্রঃ ৩৯। এলোপ্যাথিক ঔষধের প্রচন্ড ক্রিয়ার দ্বারা প্রাচীন পীড়া আরোগ্য লাভ করে না-
সূত্রঃ ৪০। বিসদৃশ পুরাতন পীড়ার সহিত নবাগত পীড়াটি যুক্ত হইয়া জটিল রোগের সৃষ্টি করে-
সূত্রঃ ৪১। দেহস্থ প্রাকৃতিক রোগ ও বিসদৃশ এলোপ্যাথিক কৃত্রিম রোগ পরস্পর মিলিত হইয়া অধিকতর জটিল পীড়া সৃষ্টি করে–
সূত্রঃ ৪২। মানবদেহে একাধিক বিসদৃশ পীড়া উপস্থিত হইলে উহারা দেহে আপন আপন স্থান বাছিয়া লয়-
(১২) দুটি অনুরূপ রোগ একসাথে মিলিত হলে কি হয়? (সূত্র-৪-৫)
সূত্রঃ ৪৩। আরোগ্য সাধনে প্রাকৃতিক শিক্ষা-
সূত্রঃ ৪৪। দুইটি সদৃশ পীড়ার ক্ষেত্রে কি ঘটিয়া থাকে-
সূত্রঃ ৪৫। উৎপত্তি হিসাবে বিভিন্ন কিন্তু প্রকাশ ভঙ্গিমায় ও লক্ষণরাজির মধ্যে প্রচুর সাদৃশ্য থাকিলে তাহারা পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংস করে-
সূত্রঃ ৪৬। সদৃশ নীতিতে পীড়া অপসারণের কতিপয় উদাহরণ-
সূত্রঃ ৪৭। ঔষধ সম্বন্ধে প্রকৃতির শিক্ষা-
সূত্রঃ ৪৮। বিসদৃশ ঔষধ নহে, সদৃশ শক্তিশালী ঔষধ দ্বারাই রোগ দূরীভূত হয়-
সূত্রঃ ৪৯। সদৃশ বিধানমতে প্রকৃতিতে রোগারোগ্য এত কম দেখা যায় কেন?
সূত্রঃ ৫০। বসন্ত ও হাম প্রভৃতি প্রাকৃতিক পীড়া হোমিও ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় না কেন?
সূত্রঃ ৫১। রোগ অপেক্ষা সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন ভেষজ প্রয়োগই সুবিধাজনক
(১৩) ওষুধের বিভিন্ন ব্যবস্থা Different system of medicine (সূত্র-৫২-৬০)
সূত্রঃ ৫২। আরোগ্য সাধনের দুইটি রীতি
সূত্রঃ ৫৩। শান্তভাবে প্রকৃত আরোগ্যলাভ কেবলমাত্র হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতেই ঘটা সম্ভব।
সূত্রঃ ৫৪। কল্পিত রোগবস্তূ খুঁজিয়া বিভিন্ন রোগ নামকরনান্তে মিশ্র ঔষধ ব্যবস্থা করাই এলোপ্যাথিক নীতি-
সূত্রঃ ৫৫। সময় সময় আশু ও ক্ষণস্থায়ী উপশম দান করতে পারার জন্যই এলোপ্যাথি আজও টিকিয়া আছে-
সূত্রঃ ৫৬। বিপরীত বিধান পীড়ার আংশিক উপশম করে মাত্র-
সূত্রঃ ৫৭। অসমলক্ষণ চিকিৎসায় সমগ্রলক্ষণের মধ্যে একটিমাত্র কষ্টকর লক্ষণের চিকিৎসা চলে-
সূত্রঃ ৫৮। এলোপ্যাথিক বা অসমলক্ষণ চিকিৎসার ত্রুটি-
সূত্রঃ ৫৯। অসমলক্ষণ মতে চিকিৎসায় উপশমিত লক্ষণের পুনঃ আবির্ভাবের দৃষ্টান্ত-
সূত্রঃ ৬০। বিসদৃশ অসমলক্ষণযুক্ত ঔষধের ক্রমাগত মাত্রা বৃদ্ধির কুফল-
(১৪) ওষুধের আদর্শ ব্যবস্থা Ideal system of medicine (সূত্র-৬১-৬২)
সূত্রঃ ৬১। নির্মূলভাবে রোগ আরোগ্যের জন্য বিসদৃশ ঔষধ প্রয়োগের পরিবর্তে তদবিপরীত সদৃশ ঔষধ প্রয়োগ করা উচিত-
সূত্রঃ ৬২। বিসদৃশ বিধান ক্ষতিকর কিন্তু সদৃশ বিধান উপকারী-

(১৫) ঔষধের মূখ্য ও গৌণক্রিয়া (সূত্র-৬৩-৭০)
সূত্রঃ ৬৩। ঔষধের মুখ্য ও গৌণ ক্রিয়া-
সূত্রঃ ৬৪। আরোগ্যসাধন প্রক্রিয়া-
সূত্রঃ ৬৫। মুখ্য ও গৌণ ক্রিয়ার উদাহরণ-
সূত্রঃ ৬৬। হোমিও ঔষধে স্বাস্থ্যের পরিপন্থী কোন ক্রিয়া সৃষ্টি হয় না-
সূত্রঃ ৬৭। হোমিও চিকিৎসার কল্যাণকর দিক ও বিসদৃশ চিকিৎসার অকল্যাণকর দিক
সূত্রঃ ৬৮। রোগারোগ্যের জন্য হোমিওপ্যাথিক ঔষধের স্বল্পমাত্রায় যথেষ্ট-
সূত্রঃ ৬৯। বিসদৃশ ঔষধের কর্মকৌশল ও অপকারিতা-
সূত্রঃ ৭০। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সারমর্ম-
(১৬) রোগ সমীক্ষা (সূত্র-৭১-৮২)
সূত্রঃ ৭১। আরোগ্যের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি বিষয়-
সূত্রঃ ৭২। রোগ দুই প্রকার ( অচির রোগ ও চির রোগ)-
সূত্রঃ ৭৩। অচির রোগের প্রকারভেদ-
সূত্রঃ ৭৪। এলোপ্যাথিক ঔষধ সঞ্জাত চিররোগ সর্বাপেক্ষা উৎকট ও শোচনীয়-
সূত্রঃ ৭৫। এলোপ্যাথিক ঔষধজাত চিররোগ সর্বাপেক্ষা অসাধ্য-
সূত্রঃ ৭৬। এলোপ্যাথিক ঔষধজাত স্থায়ী রোগ নিরাময়ের উপায়-
সূত্রঃ ৭৭। রোগসমূহকে অযথা ক্রমিক নাম দেওয়া হয়-
সূত্রঃ ৭৮। প্রাকৃতিক চিররোগ চিররোগবীজ হইতে উৎপন্ন-
সূত্রঃ ৭৯। সিফিলিস ও সাইকোসিস প্রকৃত চিররোগবীজ-
সূত্রঃ ৮০। সিফিলিটিক ও সাইকোটিক রোগ ব্যতীত সকল প্রকৃত চিররোগের জননী সোরা-
সূত্রঃ ৮১। সোরা উপবিষের বহুমুখী প্রকাশ-
সূত্রঃ ৮২। সোরাঘটিত চিররোগের ঔষধ নির্বাচন-

(১৪) রোগীলিপি প্রণয়ন ও রোগলক্ষণ নির্বাচন (সূত্র-৮৩-১০২)
(১৫) উপবিষ স্থায়ী রোগ (সূত্র-১০৩-১০৪)
(১৬) ভেষজ পরিচয় (সূত্র-১০৫-১১৪)
(১৭) ঔষধের পর্যায়ক্রমিক ক্রিয়া (সূত্র-১১৫)
(১৮) লক্ষণ বিকাশে বিভিন্নতা ও ধাতুবৈশিষ্ট্যতা (সূত্র-১১৬-১১৯)
(১৯) ভেষজ পরীক্ষা (সূত্র-১২০-১২৫)
(২০) ঔষধ পরীক্ষার নিয়ম-পদ্ধতী (সূত্র-১২৬-১৪২)
(২১) মেটেরিয়া মেডিকা (সূত্র-১৪৩-১৪৫)
(২২) সর্বাপেক্ষা উপযোগী ও সুনির্বাচিত ঔষধ (১৪৬-১৪৯)
(২৩) অচির রোগের চিকিৎসা (সূত্র-১৫০-১৫৬)
(২৪) সদৃশ বৃদ্ধি বা ঔষধজ রোগ (সূত্র-১৫৭-১৭১)
(২৫) এক দৈশিক চিররোগ সমূহ (সূত্র-১৭২-১৭৩)
(২৬) স্থানীয় রোগ এবং চিকিৎসা (সূত্র-১৭৪-২০৩)
(২৭) ক্রনিক রোগের চিকিৎসা (সূত্র-২০৪-২০৯)
(২৮) মানসিক ব্যাধি ও ইহার চিকিৎসা (সূত্র-২১০-২৩০)
(২৯) সবিরাম রোগ (সূত্র-২৩১-২৩৫)
(৩০) ঔষধ প্রয়োগের সময় (সূত্র-২৩৬-২৪৪)
(৩১) ঔষধ পুনঃপ্রয়োগ প্রণালী (সূত্র-২৪৫-২৫২)
(৩২) পীড়ার বৃদ্ধি ও উপশম (সূত্র-২৫৩-২৫৮)
(৩৩) পথ্য ও পরিচর্যা (সূত্র-২৫৯-২৬৩)
(৩৪) ঔষধ প্রস্তুত প্রণালী (সূত্র-২৬৪-২৭১)
(৩৫) ঔষধের প্রয়োগ ও মাত্রা (সূত্র-২৭২-২৭৪)
(৩৬) ঔষধ শক্তি (সূত্র-২৭৫-২৮৩)
(৩৭) চুম্বক, বিদ্যুৎ, মর্দন ও মেসমেরিজম (সূত্র-২৮৪-২৯১)


(১) চিকিৎসকের উদ্দেশ্য (সূত্র-১-৪)

🎴সূত্রঃ ১। চিকিৎসকের একমাত্র মহৎ উদ্দেশ্য-

চিকিৎসকের মহৎ ও একমাত্র উদ্দেশ্য হলো রোগীকে স্বাস্থ্যে ফিরিয়ে আনা, যাহাকে বলা হয় আরোগ্য বিধান করা।

🎴সূত্রঃ ২। আদর্শ আরোগ্যের শর্তসমূহ-

আরোগ্যবিধানের উচ্চতম আদর্শ হলো দ্রুত, বিনাকষ্টে ও স্হায়িভাবে স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার, কিংবা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে, সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য ও নির্দোষ উপায়ে, সহজবোধ্য নীতির সাহায্যে সমগ্রভাবে রোগের দূরীকরণ ও বিনাশ।

🎴সূত্রঃ ৩। চিকিৎসকের গুণাবলী-

যদি চিকিৎসকের স্পষ্ট বোধ থাকে পীড়ায় অর্থাৎ প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে কি সারতে হবে ( ব্যাধি সম্বন্ধে জ্ঞান), যদি তিনি জানেন ভেষজগুলোতে অর্থাৎ প্রত্যেকটি ভেষজের ভিতরে কি আরোগ্যশক্তি নিহিত আছে ( ভেষজশক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান), যদি তিনি জ্ঞাত থাকেন- রোগীর ভিতরে যা পীড়া বলে নিঃসন্দেহে জানা গেছে তার উপর কেমন করে স্পষ্ট ধারণাযুক্ত নীতি অনুসারে ভেষজের আরোগ্যশক্তিকে প্রয়োগ করতে হয়- যার ফলে আরোগ্যকার্য শুরু হবে এবং ভেষজটির ক্রিয়াপ্রণালী অনুসারে রোগীর উপর প্রয়োগের যোগ্যতা সম্বন্ধে তা সুনির্বাচিত কিনা (ওষুধ নির্বাচন); এবং তা ছাড়া ইহা প্রস্তুত করার ঠিক পদ্ধতি কি পরিমাণে প্রয়োজন (মাত্রা) এবং পুনঃপ্রয়োগ করার উপযুক্ত সময় এবং পরিশেষে প্রত্যেকটি আরোগ্যের ক্ষেত্রে কি বাধা ও তা কি উপায়ে দূরীভূত করা হয় তাতে আরোগ্যবিধান স্থায়ী হতে পারে- চিকিৎসকের এ সব যদি জানা থাকে তা হলে সুবিজ্ঞতা ও বিচারবুদ্ধিসম্মতভাবে কি প্রকারে চিকিৎসা করা যায় তখন তাঁর বোধগম্য হবে এবং তিনি তখন আরোগ্য-নৈপুণ্যে প্রকৃত চিকিৎসক।

🎴সূত্রঃ ৪। প্রকৃত স্বাস্থ্য সংরক্ষক চিকিৎসক-

যে সকল কারণ স্বাস্থ্যের বিশৃঙ্খলা আনয়ন করে এবং পীড়ার উৎপত্তি ঘটায়, স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিগণের নিকট হইতে সেগুলিকে কেমন করিয়া দূরে রাখা যায়, এ সব তথ্য তাঁহার ( চিকিৎসকের) জানা থাকিলে তিনি স্বাস্থ্যসংরক্ষকও বটে।

(২) রোগের মূল কারণ ও উত্তেজক কারণ (সূত্র-৫)

🎴সূত্রঃ ৫। রোগারোগ্যের জন্য চিকিৎসকের রোগের কারণ সম্পর্কিত জ্ঞান-

রোগ আরোগ্য করিবার সহায়তার জন্য চিকিৎসকের জানা প্রয়োজন- অচির রোগোৎপত্তির পক্ষে অতি সম্ভাব্য উদ্দীপক কারণ ( exciting cause) এবং চিররোগের সমগ্র ইতিহাসে বিশেষ বিশেষ জ্ঞাতব্য বিষয়গুলি বাহির করিতে হইবে। ঐ সমস্ত প্রধান কারণগুলি চিররোগের উৎপাদিকা শক্তি। এইসব বিষয়ে অনুসন্ধান করিবার জন্য রোগীর শারিরীক গঠন, তাহার মানসিক ও চরিত্রগত বিশেষত্বসমূহ, রোগীর জীবিকা, তাহার বাসস্থান, বেশভূষ্য, সামাজিক ও গার্হস্থ্য তথ্য, দাম্পত্য ক্রিয়া প্রভৃতি সমস্ত বিষয় বিবেচনা করিতে হইবে।

(৩) রোগ লক্ষণ (সূত্র-৬-৮)

🎴সূত্রঃ ৬। রোগের প্রকৃত পরিচয় ও উহার পর্যবেক্ষণ-

যেইসব মতবাদ অতীন্দ্রিয় সেইসব মতবাদ চাক্ষুষ প্রমাণ করা যায় না বলিয়া কুসংস্কারবিহীন দর্শক তাঁহার সূক্ষদর্শিতা যত প্রখর হোক না কেন, প্রত্যেক রোগে রোগীর মনে ও দেহের কি বাহ্যিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে তাহা ছাড়া আর কিছুই লক্ষ্য করেন না,অর্থাৎ সুস্থাবস্থায় লোকটির কি প্রকার অবস্হা ছিল, এখন রোগ হওয়ার পর কি কি অস্বাভাবিক অবস্হা রোগী অনুভব করিতেছে এবং সেবা শূশ্রুষাকারীরা কি কি উপলব্ধি করিতেছেন ও চিকিৎসক কি কি উপলব্ধি করিতেছেন তাহাই তিনি লক্ষ্য করেন। তাই দেখা যাইতেছে যে এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য লক্ষণগুলিই সম্পূর্ণ রোগ প্রকাশ করিয়া থাকে। এই লক্ষণগুলি দ্বারাই রোগের আকৃতি অংকন করা যায়।

🎴সূত্রঃ ৭। লক্ষণসমষ্টিই উপযুক্ত ঔষধ নির্বাচনের একমাত্র নির্দেশিকা-

কোন রোগের ক্ষেত্র হইতে উদ্দীপক বা পরিপোষক কারণ যখন দূরীভূত করিতে হইবে না তখন পীড়ার লক্ষণ ছাড়া আর কিছু আমরা ধারণা করিতে পারি না। রোগনিরাময় করিবার জন্য যে ঔষধ প্রয়োজন তাহাকে নির্দেশ করিবে একমাত্র সেইসব লক্ষণাবলী (কোন রোগবীজ বা মায়াজম আছে কিনা এবং তার আনুষঙ্গিক অবস্হা সম্বন্ধে অবহিত হইয়া- ৫ম সূত্র)। বিশেষ করিয়া এইসব লক্ষণের সমষ্টিই হইল আভ্যন্তরীণ মূল রোগের অর্থাৎ পীড়িত জীবনীশক্তির বাহিরের প্রতিচ্ছবি এবং এইগুলিই হইবে একমাত্র অবলম্বন যাহার দ্বারা সুনির্বাচিত ঔষধ নির্ণীত হইবে। মোটকথা লক্ষণসমষ্টিই হইবে প্রধান, বস্তুত ইহাই একমাত্র জ্ঞাতব্য বিষয় যাহার সাহায্য চিকিৎসক তাঁহার চিকিৎসানৈপুণ্যে রোগীকে নিরাময় করিয়া স্বাস্হ্যে ফিরাইয়া আনিতে পারেন।

🎴সূত্রঃ ৮। লক্ষণসমষ্টির অবসানই আরোগ্য প্রাপ্তি-

ইহা ধারণাতীত কিংবা পৃথিবীর কোন অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে ব্যাধির সমস্ত লক্ষণ এবং বোধগম্য সমগ্র বিষয় তিরোহিত হইলে স্বাস্থ্য ছাড়া আর কিছু থাকিতে পারে বা থাকা উচিত, অথবা পীড়ার আভ্যন্তরীণ বিকৃতি নির্মূল না হইয়া থাকিতে পারে।

(৪) জীবনীশক্তি (সূত্র-৯-১৬)

🎴সূত্র- ৯। জীবনশক্তির প্রভাবে মানবদেহ সজীব থাকে-

মানুষের সুস্হাবস্হায় অতীন্দ্রিয় জীবনীশক্তি ( অট্যোক্র্যাসি)- যাহাকে ডাইনামিস বলা হয় এবং যাহা এই জড়দেহকে সঞ্জীবিত রাখে- অসীম ক্ষমতায় নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশ করে এবং বোধশক্তি ও কার্যকারিতার দিক দিয়া দেহের সকল অবয়বকে অত্যুত্তমরূপে ও সুসামঞ্জস্যভাবে বজায় রাখে, যাহার ফলে আমাদের অন্তঃস্থিত বিবেকসম্পন্ন মন এই জীবন্ত সুস্হ দেহকে জীবনের উচ্চতর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য স্বাধীনভাবে নিয়োগ করিতে পারে।

🎴সূত্রঃ ১০। জীবনীশক্তি একটি অভৌতিক সত্ত্বা-

জীবনীশক্তিকে বাদ দিয়া জড়দেহের অনুভব করিবার, কার্য সম্পাদন করিবার, আত্মরক্ষা করিবার কোন সামর্থ্য নাই। সমস্ত অনুভবশক্তি দেহ পায় এবং জীবনধারণ ব্যাপার সম্বন্ধীয় সমস্ত কার্য দেহ নিষ্পন্ন করে, কেবল এই অশরীরী সত্তার (প্রাণধারণনীতি) সাহায্যে, এবং ইহা স্বাস্হ্য ও ব্যাধিতে এই জড়দেহকে সঞ্জীবিত রাখে।

🎴সূত্রঃ ১১। রোগ বা জীবনীশক্তির আক্রান্ত অবস্হা-

যখন কোন ব্যক্তি পীড়িত হয় তখন কেবলমাত্র অশরীরী স্বয়ংক্রিয় জীবনীশক্তিই কোন প্রাণবিরোধী পীড়াদায়ক উপাদানের সূক্ষ্ম প্রভাবদ্বারা বিশৃঙ্খলাপ্রাপ্ত হয়। এই প্রাণধারণনীতিই এইরূপ অস্বাভাবিকভাবে বিশৃঙ্খলিতা হইলে দেহের ভিতরে অপ্রীতিকর অনুভূতিসমূহ আসিয়া উপস্হিত হয় এবং দেহকে অস্বাভাবিক গতিপথে পরিচালিত করে ইহাকেই আমরা বলি ব্যাধি। যেহেতু এই শক্তিকে দেখা যায় না এবং কেবল দেহের উপর ক্রিয়া প্রকাশ দ্বারা ইহাকে চিনিতে পারা যায়, সেইজন্য ইহার পীড়াদায়ক বিশৃঙ্খলা ব্যাধিরূপে জানিতে পারা যায় কেবলমাত্র সেই সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনুভূতি ও ক্রিয়ার ভিতর দিয়া যেগুলি পর্যবেক্ষক ও চিকিৎসকের ইন্দ্রিয়গোচরে আসে অর্থাৎ তাহা গোচারীভূত হয় রোগের লক্ষণ দ্বারা অন্য কোন প্রকারেই নহে ।

🎴সূত্রঃ ১২। আক্রান্ত জীবনীশক্তি এক সাথেই বিশৃঙ্খল হয় আবার রোগ-লক্ষণ বিদূরিত হইলে এককালেই স্বাস্থ্য পুনঃস্থাপিত হয়-

কেবলমাত্র অসুস্থ জীবনীশক্তি ব্যাধি উৎপন্ন করতে পারে যাহার ফলে আমার দৃষ্টির বিষয়ীভূত রোগচিত্রে তৎক্ষণাৎ প্রতিফলিত হয় অন্তর্নিহিত সমগ্র পরিবর্তন অর্থাৎ সেই প্রকাশ হইল আভ্যন্তরীণ জীবনীশক্তির সমগ্র ব্যাধিবিশৃঙ্খলা; এক কথায় তাহাই হইল সমগ্র ব্যাধির অভিব্যক্তি। আর, চিকিৎসার ফলে দৃষ্টিগম্য রোগচিত্রের এবং সূস্হ প্রাণক্রিয়া হইতে পৃথক সকল অসুস্হকর পরিবর্তনের অন্তর্ধান নিশ্চয়ই সূচিত করে জীবনীশক্তির অখন্ড সত্তার পুনরুদ্ধার, অতএব সমগ্র দেহের ফিরিয়া পাওয়া স্বাস্হ্য।

🎴সূত্রঃ ১৩। কোন রোগই দেহ হইতে পৃথক বস্তু নহে-

অতএব ব্যাধি সম্বন্ধে (যাহা সার্জারির অন্তর্ভুক্ত নহে) অ্যালোপ্যাথগণের এই যে ধারণা অর্থাৎ সমগ্র জীবনসত্তা এবং দেহ ও তার সঞ্জীবনী প্রাণশক্তি হইতে ব্যাধি পৃথক এবং তাহা যতই তীব্র প্রকৃতির হউক না কেন দেহাভ্যন্তরে লুক্কায়িত থাকা- তাহা সম্পূর্ণ অসঙ্গত এবং কেবল জড়ধর্মী মনই তাহা কল্পনা করিতে পারে। এই ধারণা হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া প্রচলিত চিকিৎসা- পদ্ধতিকে এই সকল ক্ষতিকর প্রেরণা যোগাইয়া আসিতেছে যাহার ফলে এই চিকিৎসা একটি যথার্থ অনিষ্টসাধক (অনারোগ্যকারী) বৃত্তিতে পরিণত হইয়াছে।

🎴সূত্রঃ ১৪। দেহাভ্যন্তরে রোগের অবস্থিতি চিকিৎসকের নিকট ধরা পড়িবেই-

মানুষের দেহাভ্যন্তরে আরোগ্যযোগ্য এমন কোনো অসুস্থতা এবং অদৃশ্য বিশৃঙ্খলা থাকিতে পারে না যাহা যথার্থ পর্যবেক্ষণশীল চিকিৎসকের নিকটে পীড়াসূচক লক্ষণাদির দ্বারা ধরা না পড়ে। এইযে ব্যবস্থা তাহা সর্বজ্ঞানাধার লোকপালক পরমেশ্বরের অসীম করুণারই সম্পূর্ণ অভিপ্রেত ।

🎴সূত্রঃ ১৫ । জীবনীশক্তির অসুস্থতা এবং প্রকাশিত লক্ষণসমষ্টি অভিন্ন-

যে অতীন্দ্রিয় জীবনীশক্তি অদৃশ্য দেহাভ্যন্তরে অবস্থিত থাকিয়া আমাদের দেহকে সঞ্জীবিত রাখে তাহার বিশৃঙ্খলা অবস্থাহেতু পীড়া এবং তাহার দ্বারা সৃষ্ট বাহিরে বোধগম্য লক্ষণসমষ্টি যাহাকে বর্তমান অসুস্থতার প্রতিরূপ বলা যায় তাহাদের উভয়ের সত্তা অখন্ড এবং তাহারা সেই একই বস্তু। বস্তুত প্রাণ প্রিয়া প্রকাশের যন্ত্র হইল এই জড় দেহ, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতিশীল ও নিয়ামত জীবনীশক্তি ধারায় ইহাতে সজীবতার ব্যতিরেকে ইহার কোন সার্থকতা নাই, ঠিক যেমন দেহযন্ত্র ব্যতীত জীবনীশক্তিকে কল্পনা করা যায় না । অতএব একত্র মিলিয়া এক অখণ্ড সত্তা, যদিও সহজে বুঝিবার জন্য আমাদের মন কল্পনার সাহায্যে এই একাত্মতাকে দুইটি ধারণায় পৃথক করিয়া দেখে ।

🎴সূত্রঃ ১৬ । সূক্ষ্ম রোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত সূক্ষ্ম জীবনীশক্তি সূক্ষ্ম ঔষধশক্তি দ্বারাই আরোগ্যপ্রাপ্ত হয়-

আমাদের জীবনীশক্তি সুক্ষ্মধর্মী বলিয়া অতীন্দ্রিয় সূক্ষ্মশক্তির ক্রিয়া ব্যতিরেকে প্রাণক্রিয়ার শৃঙ্খলাভঙ্গকারি বাহিরের বিরুদ্ধশক্তি কর্তৃক আনীত সুস্থ দেহের উপর কোন অনিষ্টকর প্রভাবের দ্বারা তাহা আক্রান্ত বা প্রভাবান্বিত হইতে পারেনা । ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের অতিন্দ্রীয় জীবনে শক্তির উপর ক্রিয়াশীল ভেষজের পরিবর্তনকারী অতিন্দ্রীয় শক্তির ( সূক্ষ্ম ফলোৎপাদক শক্তিসম্পন্ন) প্রভাব ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে ইহার সকল বিকৃতি ( ব্যাধি) দূর করা চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব নয়। দেহের সর্বত্র অবস্থিত অনুভূতিমূলক স্নায়ুমণ্ডলীর সাহায্যে জীবনীশক্তি ভেষজের প্রভাবে সারা দেয়। সুতরাং মনোযোগের সহিত পর্যবেক্ষণশীল ও অনুসন্ধিৎসু চিকিৎসকের নিকটে আরোগ্যবিধানের পক্ষে যতখানি প্রয়োজন ততখানি বিশদভাবে রোগীর স্বাস্থ্যের বোধগম্য পরিবর্তনসমূহ (লক্ষণসমষ্টি) ব্যাধিরূপে ধরা দিলে তাঁহার ব্যবস্হিত ঔষধসমূহের সূক্ষ্ম প্রভাব জীবনীশক্তির উপর প্রতিফলিত হইয়া স্বাস্থ্য ও সাবলীল প্রাণক্রিয়াকে পুনরায় আনয়ন করিতে সমর্থ হয় এবং তাহা কার্যত সম্পন্ন করিয়া থাকে।

(৫) রোগ আরোগ্যের সূত্র (সূত্র-১৭-১৮)

🎴সূত্রঃ ১৭ । রোগলক্ষণ দূরীভূত হইলে সমগ্র পীড়াটিও দূরীভূত হয়-

যেহেতু বোধগোম্য সমগ্র লক্ষণ সমষ্টি দূরীভূত হওয়ার ফলে আরোগ্যলাভের জীবনীশক্তির আভ্যন্তরীণ বিকৃতি – যাহার কারণে এই ব্যাধি- তাহাও যখন একই সময়ে দূরীভূত হয় তখন এই সিদ্ধান্তে আশা যাইতে পারে যে চিকিৎসকের কর্তব্য হইল শুধু সমস্ত লক্ষণ ঠিকভাবে দূরীভূত করা এবং একই সময়ে অন্তর্নিহিত বিশৃঙ্খলাকে অর্থাৎ যাহাকে বলা হয় জীবনীশক্তির অসুস্থতা, অর্থাৎ ব্যাধিই স্বয়ং তাহাকে রদ ও নির্মূল করা । ব্যাধি নির্মূল হয়, স্বাস্থ্য তখন ফিরিয়া আসে- ইহাই হইল চিকিৎসকের উচ্চতম একমাত্র লক্ষ্য অর্থাৎ বিদ্যার বৃথা আস্ফালন কাকুরিয়া রোগীকে সাহায্যদান দ্বারা নিজের যথার্থ উদ্দেশ্য বিষয়ে অবহিত থাকা ।

🎴সূত্রঃ ১৮। লক্ষণসমষ্টিই রোগের নিদর্শন এবং ওষুধ নির্বাচনের একমাত্র নির্দেশক-

রোগের আনুষঙ্গিক হ্রাসবৃদ্ধির লক্ষণসহ রোগের সমগ্র লক্ষণসমষ্টি ছাড়া রোগে এমন আর কিছুরই পরিচয় পাওয়া যায় না যাহার দ্বারা চিকিৎসার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই অবধারিত সত্য হইতে এই অবিসংবাদিত সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ঔষধ নির্বাচনে আমাদের একমাত্র পথপ্রদর্শক হিসাবে প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে অবস্থা ও সমগ্র লক্ষণসমষ্টিই হইবে একমাত্র নির্দেশক ।

(৬) ঔষধ ও আরোগ্য (সূত্র-১৯-২৩)

🎴সূত্রঃ ১৯। ঔষধের স্বাস্থ্য পরিবর্তনকারী শক্তি-

যেহেতু ব্যাধি বলিতে সুস্থ ব্যক্তির স্বাস্থ্যের অস্বাভাবিক বিকৃতির লক্ষণ ছাড়া আর কিছু নয় এবং যেহেতু রোগীর স্বাস্থ্য সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়া আসার মধ্যেই নিহিত থাকে আরোগ্যলাভের একমাত্র সম্ভাবনা, তখন স্পষ্টই বুঝা যায় যে অনুভব ও ক্রিয়ার দিক দিয়া স্বাস্থ্যের কোন পরিবর্তন যদি ঔষুধে না ঘটাইতে পারিত তাহা হইলে ঔষধ কখনই আরোগ্যের সন্ধান করিতে পারিত না । বস্তুত ঔষধের আরোগ্যপ্রধান ক্ষমতার মূলে হইল একমাত্র তাঁহার সেই অন্তর্নিহিত শক্তি , যাহার দ্বারা তাহা মানুষের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ঘটাইতে পারে ।

🎴সূত্রঃ ২০। ঔষধের স্বাস্থ্য পরিবর্তনকারী শক্তির উপলব্ধি-

ভেষজের অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে নিহিত যে সূক্ষ্মশক্তিদ্বারা মানুষের স্বাস্থ্যে বিকৃতি ঘটে তাহা কখনও আমরা যুক্তির বলে ধারণা করিতে পারি না।সুস্থ দেহের উপর তাহার পরিদৃশ্যমান ক্রিয়াশীলতা হইতেই তাহার স্পষ্ট পরিচয় আমরা অভিজ্ঞতাসূত্রে লাভ করিয়া থাকি।

🎴সূত্রঃ ২১। ঔষধের আরোগ্যসাধিকা শক্তির পরিচয়-

ইহা যেমন অনস্বীকার্য যে ভেষজের ভিতরে যে আরোগ্যদায়িনী শক্তি আছে তাহা অনুমানের বিষয় নহে এবং প্রকৃত পর্যবেক্ষকগণ ভেষজের বিশুদ্ধ পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়া মানুষের স্বাস্থ্যের, বিশেষত সুস্থ ব্যক্তির স্বাস্থ্যের বিকৃতিসাধন এবং নানাবিধ স্পষ্ট পীড়ালক্ষণ উৎপাদন ছাড়া তাহার ভেষজত বা আরোগ্যকারী ক্ষমতা বলিতে আর কিছু নির্ণয় করিতে পারেন না, তখন এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে ভেষজ যখন রোগনিরাময়কারীরূপে কার্য করে তখন যে ক্ষমতাদ্বারা অসাধারণ লক্ষণসমূহ উৎপাদন করিয়া মানুষের স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে সেই ক্ষমতার ভিতর দিয়াই তাহার আরোগ্যকারী গুন প্রকাশিত হয় এবং সেই জন্য সুস্থদেহে ভেষজ যে বিকৃতি সাধন করে তাহার উপরেই তাহার অন্তর্নিহিত রোগ আরোগ্যকারী ক্ষমতার সম্ভব্য প্রকাশ নির্ভরশীল বলিয়া আমাদিগকে বিশ্বাস করিয়া লইতে হইবে । তাহা হইলেই প্রত্যেকটি ভেষজের ভিতরে রোগ উৎপাদনকারী শক্তি এবং সেই সঙ্গে রোগ আরোগ্যকারী শক্তি বলিতে কি বুঝায় তাহা জানা সম্ভব হইবে ।

🎴সূত্রঃ ২২। রোগ নির্মূলের জন্য প্রয়োগকারী ঔষধসমূহের প্রকারভেদ-

স্বাস্থ্যে ফিরাইয়া আনার জন্য রোগের লক্ষণসমষ্টি পর্যবেক্ষণ করিয়া তাহা বিদূরিত করা ছাড়া আর যখন কিছুই করিবার নাই এবং ঠিক সেইভাবে সুস্থদেহে পীড়া উৎপাদন এবং রুগ্ন ব্যক্তিকে ব্যাধিমুক্ত করা ছাড়া ভেষজের আরোগ্যকারী ক্ষমতা বলিতে আর কিছু জানা যায় না, তখন এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে ভেষজসমূহই কেবল রোগ আরোগ্য করিতে এবং ব্যাধিসমূহকে ধবংস করিতে সমর্থ, কেননা ভেষজপদার্থ কতকগুলো ক্রিয়া ও লক্ষণ উৎপাদন দ্বারা অর্থাৎ একটা কৃত্রিম ব্যাধির অবস্থা সৃষ্টি করিয়া পূর্ব হইতে অবস্থিত প্রকৃত ব্যাধিরলক্ষণসমূহকে অর্থাৎ যাহা আমরা আরোগ্য করিতে চাই সেগুলিকে বিদূরিত ও বিলুপ্ত করে।অপরপক্ষে ইহা বুঝিতে পারা যায় যে লক্ষণসমষ্টি বিশিষ্ট পীড়া আরোগ্য করিবার জন্য সেই ঔষধকেই (দ্রুত,নিশ্চিত অস্থায়ীভাবে রোগ আরোগ্যের জন্য সাদৃশ বা বিপরীত কোন প্রকার লক্ষণের সহায়তা প্রয়োজন সেই অভিজ্ঞতা অনুসারে)নির্বাচন করিতে হইবে যাহার সদৃশ্য অথবা বিপরীত লক্ষণ সৃষ্টি করিবার প্রবণতা আছে।

🎴সূত্রঃ ২৩। বিসদৃশ ওষুধের রোগারোগ্যের ক্ষমতা নাই-

সকল প্রকার বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা ও নির্ভুল অনুসন্ধান হইতে আমাদের এই প্রতীতী জন্মে যে ব্যাধির বদ্ধমূল লক্ষণসমূহ ঔষধের বিপরীত লক্ষণ দ্বারা দূরীভূত বা বিনষ্ট হওয়া সম্ভবপর নহে (যেমন অ্যান্টিপ্যাথিক, এনঅ্যান্টিওপ্যাথিক বা প্যালিয়েটিভ উপায়ে )। পক্ষান্তরে সামরিক উপায়ে প্রতীয়মান হইলেও পুনরায় সেগুলি দারুণভাবে বৃদ্ধি পাইয়া গুরুতর আকার প্রকাশিত হয় ( ৫৮-৬২ ও ৬৯ সূত্র দ্রষ্টব্য )।

(৭) হোমিওপ্যাথিক বিধান (সূত্র-২৪-২৯)

🎴সূত্রঃ ২৪। রোগলক্ষণের সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন ঔষধই রোগ আরোগ্য করিতে পারে-

অতএব ব্যাধিতে সদৃশ পদ্ধতি ছাড়া ঔষধ প্রয়োগের আর এমন কোনো উপায় নাই যাহা প্রকৃত কার্যকারী বলিয়া বিবেচিত হতে পারে। ইহার (সদৃশ-পদ্ধতির)দ্বারা রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষণসমষ্টির জন্য আমরা সমস্ত ঔষধের মধ্যে (সুস্থ শরীরে পরীক্ষার ফলে যাহাদের নিদান লক্ষণ জানা আছে) এমন একটি ঔষধ অনুসন্ধান করি যাহার বহুলাংশে ঐরূপ রোগীর প্রায় অনুরূপ রোগাবস্থা সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা ও প্রবণতা আছে।

🎴সূত্রঃ ২৫। সদৃশ ঔষধের সঠিক শক্তি ও মাত্রা প্রয়োগ করিতে হইবে-

সুতরাং সকল সতর্ক পরীক্ষার ভিতর দিয়া বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা যাহাকে আরোগ্য-কলার একমাত্র অভ্রান্ত দৈবনির্দেশ বলা যায়- আমাদিগকে এই শিক্ষা দেয় যে প্রকৃতপক্ষে সেই ঔষধ যাহার সুস্থ শরীরের উপর ক্রিয়া-লক্ষণের,চিকিৎসিত রোগীর প্রকাশিত লক্ষণের সহিত সর্বাধিক সাদৃশ্য প্রকাশ করিবার ক্ষমতা আছে, তাহা উপযুক্ত শক্তি ও মাত্রায় দ্রুত ও স্থায়ীভাবে পীড়ার লক্ষণসমূহ কে অর্থাৎ (৬-১৬) সমগ্র পীড়াকে নির্মূল করিয়া স্বাস্থ্য পুনরানয়ন করিতে পারে। সকল ঔষধ, বিনা ব্যতিরেকে,সেই সকল পীড়ার ক্ষেত্রে আরোগ্যদান করিতে পারে যাহাদের লক্ষণাবলী ভেষজের নিজস্ব লক্ষণাবলীর প্রায় সদৃশ; তাহাদের কোনটিকেই অ-রোগমুক্ত রাখে না।

🎴সূত্রঃ ২৬। মানবদেহে দুইটি সদৃশ প্রাকৃতিক রোগ থাকিলে-

ইহা (অর্থাৎ সদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট ওষুধে রোগ নিরাময় হওয়া) নিম্নলিখিত হোমিওপ্যাথিক বিধি বা নিয়মের ওপর নির্ভর করে। ইহা কখনও কখনও অস্পষ্ট অনুমানের বিষয় হইলেও এ পর্যন্ত পুরাপুরিভাবে স্বীকৃতি লাভ করে নাই। প্রতিটি প্রকৃত আরোগ্য যাহা এযাবৎ ঘটিয়াছে তাহা এই নিয়ম অনুসারে। জীবন্ত দেহে সংক্রমিত একটি দুর্বল ব্যাধি অধিকতর বলশালী অপর একটি ব্যাধির সংক্রমণ দ্বারা স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হয় যদি শেষোক্তটি (জাতিতে বিভিন্ন হইলেও) তাহার প্রকাশ লক্ষণে প্রথমোক্তটির খুব সদৃশ হয়।

🎴সূত্রঃ ২৭। কোন ঔষধ সমূলে রোগ বিনাশ করে-

অতএব ঔষধসমূহের আরোগ্যকারী ক্ষমতা নির্ভর করে তাহাদের সেই সকল লক্ষণসমূহের উপর যাহা রোগলক্ষণের সদৃশ অথচ তাহার অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী (১২-২৬)। তাহার ফলে প্রত্যেকটি রোগের পীড়া সুনিশ্চিত ও নির্ভুলভাবে দ্রুত ও স্থায়ী রূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও দূরীভূত হয় এমন একটি ঔষধ দ্বারা যাহা (মনুষ্যদেহে ) সর্বাধিক সদৃশ ও পূর্ণাঙ্গ অথচ অপেক্ষা অধিকতর ক্ষমতাসম্পন্ন লক্ষণসমষ্টি সৃষ্টি করতে সমর্থ।

🎴সূত্রঃ ২৮। আরোগ্য সাধনের সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য-

যেহেতু প্রাকৃতিক এই আরোগ্যবিধান জগতের প্রত্যেকটি বিশুদ্ধ পরীক্ষানিরীক্ষা এবং প্রত্যেকটি যথার্থ পর্যবেক্ষণের ভিতর দিয়ে ব্যক্ত, অতএব এই সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত। কেমন করিয়া তাহা ঘটে এবং তাহার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি হইতে পারে তাহাতে কিছু আসে যায় না এবং আমি সেই ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টার দিকে বেশি জোর দেই না। কিন্তু নিম্নলিখিত যুক্তি যেহেতু অভিজ্ঞতার ভিত্তির উপর স্থাপিত সেইজন্য গ্রহণযোগ্যরূপে ধরা যাইতে পারে।

🎴সূত্রঃ ২৯। সদৃশনীতি অনুসারে আরোগ্য সাধনের পদ্ধতি-

প্রত্যেকটি ব্যাধি ( যাহা সম্পূর্ণ সার্জারির অন্তর্ভুক্ত নহে ) যেমন প্রাণশক্তির (জীবনের মৌলিক উপাদানের সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ অসুস্থ পরিবর্তন মাত্র- যাহা অনুভূতি ও ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় – তেমনি প্রত্যেকটি হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য , প্রাকৃতিক ব্যাধি দ্বারা সূক্ষ্মভাবে পীড়িত এই মৌলিক উপাদান , লক্ষণসমষ্টির ঠিক সাদৃশ্য অনুসারে নির্বাচিত শক্তিকৃত ঔষধের প্রভাবে অধিকতর শক্তিশালী তৎসদৃশএকটি কৃত্রিম ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত হয়। ইহার ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল সূক্ষ্ম প্রাকৃতিক ব্যাধির প্রকাশিত তিরোহিত হয়। রোগের এই প্রকাশ প্রাণক্রিয়াকে আর অধিকার করিয়া থাকে না । তাহার স্থানে তখন অবস্থান করে ও প্রভূত করে কেবলমাত্র প্রবলতর কৃত্রিম ব্যাধিসৃষ্ট লক্ষণসমূহ। সেই কৃত্তিম ব্যাধির লক্ষণসমূহের শক্তি শীঘ্রই নিঃশেষ হইয়া যায় এবং রোগী রোগমুক্ত হইয়া আরোগ্যলাভ করে ।জীবনীশক্তি এইভাবে রোগমুক্ত হইয়া তখন সুস্থভাবে প্রাণক্রিয়া সম্পাদন করে চলে। এই যে অতি সম্ভবপর প্রক্রিয়া তাহা নির্ভর করে নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহের উপর।

(৮) প্রাকৃতিক রোগ ও ঔষধজ শক্তি (সূত্র-৩০-৩৮)

🎴সূত্রঃ ৩০। পীড়ার প্রাবল্য ও প্রকৃতি অনুসারে ঔষধের শক্তি নির্ধারণ-

উপযুক্ত ঔষধ দ্বারা প্রাকৃতিক ব্যাধিসমূহ নিরাময় ও পরাভূত হইয়া থাকে, সেজন্য সুস্থ অবস্থায় মানবদেহকে প্রাকৃতিক ব্যাধি অপেক্ষা ভেষজ দ্বারা অধিকতর প্রবলভাবে আক্রান্ত হইতে দেখা যায় (তাহার কতকটা কারণ ঔষধের মাত্রানিয়ন্ত্রণ আমাদের আয়ত্তে থাকে বলিয়া) ।

🎴সূত্রঃ ৩১। কখন জীবনীশক্তি রোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়-

যে বিরুদ্ধ শক্তিসমূহ- যাহা কতকটা আধ্যাত্মিক ও কতকটা ভৌতিক এবং যাহাদের সম্মুখে উন্মুক্ত রহিয়াছে আমাদের পার্থিব অস্তিত্ব এবং যাহাদিগকে বলা হয় পীড়াসৃষ্টিকারি শক্তিসমূহকে-মানুষের সুস্থ দেহকে সর্তবিহীন ভাবে পীড়িত করিবার ক্ষমতা তাদের নাই। কিন্তু আমরা তাহাদের দ্বারা তখনই পীড়িত হই যখন আগন্তুক ব্যাধি কর্তৃক আক্রান্ত হইবার, স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হইবার এবং অস্বাভাবিক অনুভূতি ও ক্রিয়াসমূহের অধীন হইবার ভাব ও প্রবণতা দেহে বিদ্যমান থাকে। অতএব তাহারা (বিরুদ্ধ শক্তিসমূহ) প্রত্যেক ক্ষেত্রে কিংবা সকল সময় ব্যাধি উৎপাদন করিতে পারে না ।

🎴সূত্রঃ ৩২। ঔষধশক্তি সকল অবস্থায় জীবনীশক্তিকে আবিষ্ট করিতে পারে-

কৃত্রিম পীড়া উৎপাদনকারী শক্তিসমূহ যাহাদিগকে আমরা ভেষজ বলি তাহাদের কথা কিন্তু সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।প্রত্যেকটি প্রকৃত ভেষজ সকল সময়েই , সকল অবস্থায়, প্রত্যেকটি জীবন্ত মানুষ্যদেহে ক্রিয়া প্রকাশ করে এবং তাহার ভিতর অদ্ভুত লক্ষণসমূহ সৃষ্টি করে (সর্তবিহীন ভাবে) আক্রান্ত এবং প্রভাবান্বিত হইতে বাধ্য হয়, যাহা-যেমন পূর্বে বলা হইয়াছে-প্রাকৃতিক বিধিসমূহ সম্পর্কে খাটে না ।

🎴সূত্রঃ ৩৩। রোগশক্তি অপেক্ষা ঔষধশক্তি অধিকতর শক্তিশালী-

এই তথ্য অনুসারে ইহা সকল অভিজ্ঞতা দ্বারা অবিসংবাদিত ভাবে স্বীকৃত যে পীড়া উৎপাদিকা শক্তি ও সংক্রামক রোগবিষ অপেক্ষা ভেষজশক্তির দ্বারা জীবন্ত মানুষ্যদেহ আক্রান্ত হওয়া এবং তাহার অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা ও সম্ভাবনা অধিকতর । অর্থাৎ পীড়া উৎপাদিকা শক্তির মানুষের সুস্থ শরীরকে পীড়িত করিবার যে ক্ষমতা তাহা সর্তাধীন, প্রায়ই অত্যন্ত সর্তসাপেক্ষ; কিন্তু ভেষজশক্তির যে ক্ষমতা তাহা সম্পূর্ণ সর্তবিহীন এবং পূর্বোক্তটি অপেক্ষা প্রবলতর ।

🎴সূত্রঃ ৩৪। আরোগ্যক্রিয়ায় ঔষধ হইতে হইবে অধিকতর শক্তিসম্পন্ন এবং সদৃশ-

ঔষধ দ্বারা উৎপন্ন কৃত্রিম ব্যাধির প্রবলতর শক্তিই যে প্রাকৃতিক ব্যাধিসমূহকে সারাইবার একমাত্র কারণ তাহা নহে। রোগ আরোগ্য করিবার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানষ্যদেহে ভেষজজাত এমন একটি কৃত্রিম ব্যাধির সৃষ্টি করা যাহা যে রোগকে সরাইতে হইবে তাহা যথাসম্ভব তাহার সদৃশ হইবে এবং অধিকতর ক্ষমতাপ্রভাবে স্মৃতি ও চিন্তাশক্তিবিহীন স্বয়ংক্রিয় জীবনীশক্তিকে অনুরূপভাবে পীড়িত করিবে। ইহা প্রাকৃতিক পীড়াকে যে শুধু অভিভূত করিবে তাহা নহে, তাহাকে নির্বাপিত করিয়া ধ্বংস করে দিবে। ইহা যেরূপ সত্য যে প্রকৃতিদেবীও নূতন শক্তিশালী বিসদৃশ রোগ প্রবর্তিত করিয়া দেহাধিকৃত কোন পূর্বের রোগকে দূরীভূত করিতে পারেন না সেইরুপ যে ভেষজ সুস্থদেহে অনুরূপ সদৃশ অবস্থা সৃষ্টি করিতে পারে না চিকিৎসায় তাহার আরোগ্যবিধান করার ক্ষমতা ঠিক ততটুকু ।

🎴সূত্রঃ ৩৫। বিসদৃশ নীতিতে আরোগ্য হয় না-

প্রাকৃতিক জগতে বিসদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট দুইটি প্রাকৃতিক ব্যাধি একদেহে একত্র মিলিত হইলে কি ঘটে এবং সাধারণ চিকিৎসাক্ষেত্রে অনুপযুক্ত এলোপ্যাথিক ঔষধসমুহ- যাহা রোগের সদৃশ কৃত্রিম পীড়ার অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে না -তাহ প্রয়োগ করলেই বা কি ফল হয় এই সম্বন্ধে বুঝিবার জন্য তিনটি বিভিন্ন অবস্থার কথা আলোচনা করিব।

🎴সূত্রঃ ৩৬। মানবদেহ একই সময়ে দুইটি বিসদৃশ পীড়া একত্রিত হইলে কি হয়-

মানবদেহের যদি বিসদৃশ লক্ষণসম্পন্ন দুইটি পীড়া মিলিত হয় এবং তাহারা যদি সমশক্তিসম্পন্ন হয় বা পুরাতন পীড়াটি নতুন পীড়া হইতে অধিক শক্তিশালী হয় তাহা হইলে পরে যেই নতুন পীড়াটি মানবদেহে প্রবেশ লাভ করিয়াছে তাহা পূর্বের শক্তিশালী রোগটি দ্বারা বিতাড়িত হয় এবং কিছুতেই শরীরে ক্রিয়া প্রকাশ করিতে সক্ষম হয় না। কোনো রোগী যদি একটি চিররোগে ভুগিতে থাকে, তবে তাহাকে হেমন্তকালীন আমাশয় পীড়া দ্বারা বা অন্য কোনো মহামারী পীড়ায় আক্রান্ত হতে দেখা যায় না ।শ্যামলীর মতে যেখানে স্কা্ভি রোগ খুব বেশী, সেখানে প্লেগ হইতে দেখা যায় না। এমনকি যারা কাউর রোগে ভোগে তাহাদেরও প্লেগ হয় না। জেনার বলেন, যে ছেলে শীর্ণতায় ভুগিতে থাকে, তাহাকে বসন্তের টিকা দিলে ঐ টিকা উঠে না। ভন্ হিলডেন ব্যান্ড এর মতে, যে রোগী যক্ষ্মারোগে ভুগিতেছে তাহাকে প্রবল সংক্রামক জ্বরে সহজে আক্রমণ করতে পারে না।

🎴সূত্রঃ ৩৭। চিররোগে বিসদৃশ চিকিৎসায় কোন ফল হয় না-

তদ্রুপ কোন পুরাতন চিররোগ সাধারণ চিকিৎসার দ্বারা (প্রচলিত এলোপ্যাথি মতে চিকিৎসায় ) অর্থাৎ সেই সকল ঔষধ দ্বারা চিকিৎসায় সুস্থ দেহে যাহাদের ব্যাধির সদৃশ অবস্থা উৎপন্ন করিবার ক্ষমতা নাই, এমনকি সেই চিকিৎসা বহু বৎসর ধরিয়া করা হইলেও — অবশ্য তাহা যদি খুব প্রচন্ড ধরনের না হয়, তাহা ( চিররোগ ) নিরাময় না হইয়া অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকিয়া যায়। দৈনন্দিন চিকিৎসা ক্ষেত্রে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়, সুতরাং উদাহরন দিয়া বলিবার কোন প্রয়োজন নাই।

🎴সূত্রঃ ৩৮। দুইটি বিসদৃশ পীড়ার মধ্যে নবাগত পীড়াটি প্রবলতর হইলে-

নবাগত বিসদৃশ রোগটি যদি বলবত্তর হয় তাহা হইলে নবাগত বলবত্তর পীড়ার সংক্রমণে যতদিন তাহার ভোগকাল শেষ না হয় ততদিন পূর্ব হইতে অবস্থিত দুর্বল পীড়াটি থাকে না এবং পরে সেই পুরাতন পীড়াটি না-সারা অবস্থায় আবার আবির্ভূত হইবে। টূলপিয়াস লক্ষ করিয়াছেন যে একপ্রকার মৃগী রোগে আক্রান্ত দুইটি শিশুর দদ্রুরোগ সংক্রামিত হওয়ার পর রোগটির আক্রমণ বন্ধ ছিল, কিন্তু মাথার চর্মরোগ অন্তর্হিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বের ন্যায় আবার মৃগী রোগ দেখা দিল। স্কোফ দেখিয়েছেন যে স্কার্ভির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে খোসচুলকানি অন্তর্হিত হইয়াছে, কিন্তু পূর্বোক্তটি সারিয়া যাওয়ার পরে পরেরটি আবার দেখা দিয়াছে। এইরূপে প্রবল টাইফাসরোগ আক্রমণের সময় ফুসফুসের যক্ষ্মা থাকে না, পূর্বোক্তটির ভোগ শেষ হওয়ার পরে আবার ফিরেয়া আসে। যক্ষ্মাগ্রস্থ রোগী উন্মাদরোগাক্রান্ত হইলে যক্ষ্মার সমস্ত লক্ষণ তিরোহিত হয়, কিন্তু উন্মত্ততা সারিয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে আবার যক্ষ্মা ফিরিয়া আসে এবং তখন তাহা আরও মারাত্মক হয়।যখন হাম ও বসন্ত উভয়ে একই সময়ে আসিয়া একটি শিশুকে আক্রমণ করে তখন হাম পূর্বে আসিলেও সাধারণত বসন্ত পরে আসা সত্ত্বেও তাহাকে চাপিয়া রাখে এবং বসন্ত সারিয়া না যাওয়া পর্যন্ত হামের ভোগ শুরু হয় না। আবার ম্যাঙ্গেট ইহাও দেখিয়েছেন যে হামের সংক্রমণের ফলে বসন্তের টিকা চারদিন স্থগিত থাকে, এবং হাম সারিয়া যাওয়ার পরে আবার টিকার ভোগ চলিতে থাকে। এমন কি যেখানে টিকা উঠিবার ছয় দিন পরে হাম হইয়াছে, এবং সেই সময়ে প্রদাহান্বিত টিকা একইভাবে থাকে এবং হামের সপ্তাহব্যাপী ভোগকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত টিকার কাজ আরম্ভ হয় না। হামজ্বর যখন ব্যাপকভাবে দেখা দেয় তখন বসন্তের টিকা লওয়ার চতুর্থ কিংবা পঞ্চম দিনেও অনেক লোক ঐ রোগে আক্রান্ত হইয়াছে এবং হামের ভোগকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত টিকা উঠা বন্ধ থাকে এবং তাহার পর আবার যথারীতি টিকা উঠিয়া তাহার ভোগ সমাপ্ত হয়। গলাক্ষতযুক্ত প্রকৃত, মসৃণ বিসর্পজাতীয় সিডেনহামস্কার্লেটিনা গোবীজটিকা লোয়ার চতুর্থ দিনে বন্ধ হইয়া যায় এবং টিকার ভোগকাল শেষ হওয়ার পরে আবার স্কার্লেটিনার পুনরার্বিভাব ঘটে। আবার অন্য এক সময়ে উভয় পিড়াই বোধহয় সামান শক্তিশালী বলিয়া গোবীজটিকা অষ্টম দিনে প্রকৃত, মসৃণ সিডেনহামস্কর্লেটিনা কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং যতদিন স্কার্লেটিনা সারিয়া না যায় ততদিন টিকার লাল ক্ষত দেখিতে পাওয়া যায় না, তাহার পর সঙ্গে সঙ্গেই আবার টিকা ওঠা শুরু হইয়া তাহার ভোগ শেষ হয়। কর্টুম লক্ষ্য করিয়াছেন, হাম গোবীজটিকাকে থামাইয়া রাখে, অষ্টম দিনে যখন গোবীজটিকার প্রায় পূর্ণাবস্হা তখন দেখা দেয়। টিকা তখন ঠিকভাবেই চলিতে থাকে এবং হাম শুকাইয়া না যাওয়া পর্যন্ত টিকার কাজ পুনরায় শুরু হয় নাই, সুতরাং দশম দিনে তাহা যে অবস্থায় দেখিতে পাওয়া উচিত ছিল তাহা ষোড়শ দিনের দিন দেখতে পাওয়া যায়। কুর্টুম ইহাও দেখিয়েছেন যে হাম ওঠার পরেও বসন্তের টিকা উঠিয়াছে, কিন্তু হাম সারিয়া না যাওয়া অবধি ইহার ভোগ শেষ হয় না।আমি নিজেও দেখেছি যে বসন্তের টিকা পূর্ণভাবে ওঠা মাত্র মাম্পস অন্তর্হিত হইয়াছে এবং গোবীজটিকা সম্পূর্ণ না উঠা পর্যন্ত ও তজ্জনিত লাল ক্ষত অন্তর্হিত না হওয়া পর্যন্ত একপ্রকার বিশেষ রোগবীজসৃষ্ট জ্বর ও তৎসহ গালগলা ফোলা পুনরাবির্ভূত হইয়া যথারীতি তাহার সপ্তাহব্যাপী ভোগকাল শেষ করে না। সকল বিসদৃশ ব্যাধি সম্বন্ধেই এই কথা খাটে, বলবত্তর পীড়া দূরের অপেক্ষাকৃত দুর্বল পীড়াকে দমন করিয়া রাখে (তাহারা পরস্পর উভয়কে জটিল করিয়া না ফেলিলে,যাহা তরুণ পীড়াসমূহ সম্বন্ধে কদাচিৎ ঘটে), কিন্তু কখনও পরস্পরকে আরোগ্যদান করিতে পারে না।

(৯) এলোপ্যাথিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা (সূত্র-৩৯-৪৬)

🎴সূত্রঃ ৩৯। এলোপ্যাথিক ঔষধের প্রচন্ড ক্রিয়ার দ্বারা প্রাচীন পীড়া আরোগ্য লাভ করে না-

সাধারণপন্থী চিকিৎসকগণ (অ্যালোপ্যাথিক) এরূপ ঘটনা বহু শতাব্দী ধরিয়া দেখিয়াছেন। তাহারা দেখিয়াছেন যে প্রকৃতিদেবী নিজেও একটি ব্যাধি সৃষ্টি করিয়া- তাহা যতই শক্তিশালী হউক না কেন- দেহস্থিত অন্য একটি বিসদৃশ ব্যাধিক সারাইতে পারেন না। এই সব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও চিররোগকে অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ দ্বারা অর্থাৎ সে সকল ঔষধের ব্যবস্থা দ্বারা-যাহাদের কী প্রকার পীড়া উৎপাদন করিবার ক্ষমতা তাহা ভগবানই জানেন-তাহারা যখন প্রায় সুনিশ্চিতভাবে রোগের বিসদৃশ অবস্থা উৎপাদন করিয়া চিকিৎসা করেন তখন তাহাদের সম্বন্ধে কি মনে করিব ?আর যদি চিকিৎসকগণ এতোকাল মনোযোগের সহিত প্রাকৃতিক বিধানের দিকে লক্ষ না করিয়া থাকেন তাহা হইলেও তাহাদের চিকিৎসার শোচনীয় ফল হইতে এই শিক্ষালাভ করা উচিত ছিল যে তাহারা একটি অনুপযুক্ত মিথ্যা পথ অনুসরণ করিয়া চলিয়াছেন। তাহাদের রীতি অনুসারে তাহারা যখন চিররোগে প্রচন্ড অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করিয়া থাকেন তখন তাহারা কি টের পান না যে তদ্দ্বারা মূল রোগের বিসদৃশ আর একটি কৃত্তিম পীড়া তাহারা সৃষ্টি করিয়াছেন। আর সেই রোগকে যতক্ষণ বজায় রাখা হয় তাহা মূল রোগটিকে সরাইয়া রাখে, স্থগিত রাখে,চাপা দিয়া রাখে এবং যখনই রোগীর দুর্বল শক্তি অ্যালোপ্যাথিকআক্রমণ আর গ্রহণ করিতে পারে না তখনই সেই মূল রোগটির আবার সুনিশ্চিত আবির্ভাব ঘটে। এইরূপেই কডা জোলাপ পুনঃপুন প্রয়োগ করার ফলে নিশ্চিতরূপে অতি সত্বর তাহা অন্তর্হিত হয়,কিন্তু যখন রোগী অন্তের উপর সেই কৃত্তিম পীড়ার বেগ সহ্য করিতে না পারিয়া আর জোলাপ লইতে চাই না তখন হয় চর্মরোগ পূর্বের মতো বাহির হয় কিংবা অন্তর্নিহিত সোরা কোন খারাপ লক্ষণ লইয়া আত্মপ্রকাশ করে; আর তাহার ফলে রোগের মূল ব্যাধি হ্রাসপাওয়া দূরে থাক তাহাকে অধিকন্তু যন্ত্রণাদায়ক অজীর্ণরোগ ও দুর্বলতা আশ্রয় করে। ঠিক এই প্রকারে সাধারণ চিকিৎসকগণ কোন চিররোগ নির্মল করিবার উদ্দেশ্যে যখন শরীরে চর্মের উপর ক্ষত উৎপাদন করেন তখন তদ্দ্বারা তাহাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয় না। সেই উপায় অবলম্বন করিয়া তখনই তাহারা আরোগ্যদান করিতে পারেন না, যেহেতু চর্মের কৃত্রিম ক্ষত অন্তঃস্থিত ব্যাধি হইতে সম্পূর্ণ পৃথক ও বিসদৃশ। কিন্তু (ক্ষতজনিত) কতকগুলি কোষের উত্তেজনা অভ্যন্তরীণ পীড়ার বিসদৃশ হইলেও অন্তত কখন ও প্রবলতর হয়ে, সেইজন্য অভ্যন্তরীণ পীড়াও কখন তদ্দ্বারা দুই এক সপ্তাহ চুপ থাকে কিংবা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইহা কেবল স্থগিত থাকে মাত্র এবং তাহাও খুব অল্প সময়ের জন্য। ইতিমধ্যে রোগীর শক্তি ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে। পেকলিন ও আরও অনেকেই স্বীকার করেন, ক্ষত উৎপাদন দ্বারা বহু বৎসর চাপা থাকলেও ক্ষত সারিবার মুখে মৃগীরোগ আবার ঠিক আবির্ভূত হয় এবং তাহা ও বর্ধিত আকারে।সাধারণ চিকিৎসায় নানা প্রকার নাম-না-জানা ব্যাধির জন্য ব্যবহৃত অজ্ঞাত মিশ্রণ সংবলিত প্রচলিত ব্যবস্থাপত্র অপেক্ষা এই সকল প্রয়োগ যথা, খোসচুলকানির জন্য জোলাপ, মৃগীর জন্য ক্ষত- নিশ্চয়ই অধিকতর বিরুদ্ধধর্মী, অধিকতর বিসদৃশ, অধিকতর ও বলক্ষয়কারী হইতে পারে না। ইহারা রোগীকে কেবল দুর্বল করা ছাড়া আর কিছুই করে না, আর রোগ নিরাময় করিতে না পারিয়া তাহাকে অল্পকালের জন্য দমন বা স্থগিত করিয়া রাখে মাত্র। আর সেগুলিকে দীর্ঘকাল ধরিয়া চালানো হইলে তার অবশ্যম্ভাবী ফল হয় মূল রোগের সহিত আর একটি নূতন পীড়ার সংযোগ।

🎴সূত্রঃ ৪০। বিসদৃশ পুরাতন পীড়ার সহিত নবাগত পীড়াটি যুক্ত হইয়া জটিল রোগের সৃষ্টি করে-

কিংবা নবাগত ব্যাধিটি অনেকদিন ভোগ হওয়ার পরে অবশেষে বিসদৃশ পুরাতন ব্যাধিটির সহিত যুক্ত হইয়া একটি জটিল রোগ সৃষ্টি করে। তাহাদের প্রত্যেকে দেহের একটি বিশিষ্ট স্থান অর্থাৎ যেটির যেরূপ উপযুক্ত সেই সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অধিকার করিয়া বসে এবং বাকি অংশে অন্য বিসদৃশ রোগটিকে ছাড়িয়া দেয়। যেমন, একটি সিফিলিসরোগী সোরাগ্রস্থ হইতে পারে, কিংবা সোরাগ্রস্থ রোগী সিফিলিস দ্বারা সংক্রামিত হইতে পারে। কিন্তু ব্যাধি দুইটি পরস্পরের বিসদৃশ বলিয়া একটি অপরটিকে দূরীভূত কিংবা আরোগ্যদান করিতে পারে না । সোরার উদ্ভেদ যখন প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হয় তখন সিফিলিসের লক্ষণ সমূহ স্থগিত এবং চাপা থাকে । পরে আবার ( সিফিলিস অন্তত সোরার সমান শক্তিশালী বলিয়া) তাহারা উভয়ে একত্রে মিলিত হয় অর্থাৎ প্রত্যেকটি সেই সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অধিকার করিয়া বলে যেগুলি তাহার উপযুক্ত, তাহার ফলে রোগী আরও পীড়িত হয় এবং তাহাকে রোগমুক্ত করা অধিকতর কষ্টসাধ্য হইয়া পড়ে। যখন দুইটি বিসদৃশ অচিরসংক্রামক ব্যাধি মিলিত হয়, যথা বসন্ত ও হাম, তখন একটি সাধারণত অপরদিকে চাপা দিয়া রাখে– ইহা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে । তথাপি এমন প্রচন্ড মহামারী দেখা গিয়াছে যেখানে বিরল হলেও দুইটি বিসদৃশ অঢিররোগের একই সঙ্গে একই দেহে আবির্ভাব ঘটিয়াছে এবং অল্প সময়ের জন্য উভয়ে একত্র মিলিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়।

🎴সূত্রঃ ৪১। দেহস্থ প্রাকৃতিক রোগ ও বিসদৃশ এলোপ্যাথিক কৃত্রিম রোগ পরস্পর মিলিত হইয়া অধিকতর জটিল পীড়া সৃষ্টি করে–

একই দেহে প্রাকৃতরোগসমূহ একত্র মিলিত হইয়া জটিলতা সৃষ্টি করার যে সম্ভাবনা তাহা অপেক্ষা দীর্ঘকাল ধরিয়া অনুপযুক্ত ঔষধ ব্যবহার দ্বারা অসঙ্গত চিকিৎসাব্যবস্থার ফলে ( এলোপ্যাথিক পদ্ধতি ) জটিল রোগ উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়। যে প্রাকৃতিক ব্যাধিকে আরোগ্য করিবার জন্য ইহা ব্যবহার করা হয়, পুনঃপুনঃ প্রয়োগের ফলে সেই অনুপযুক্ত ওষধের প্রকৃতি অনুযায়ী উৎপন্ন এক নতুন, কষ্টসাধ্য রোগ তাহার সহিত সংযুক্ত হয়। উভয়ে ক্রমশ মিলিত হইয়া চিররোগকে জটিল করিয়া তোলে। ঔষধসৃষ্টপীড়া চিররোগটির বিসদৃশ, সুতরাং সদৃশ মতে আরোগ্যদান করিবার ক্ষমতা তাঁহার না থাকায় পুরাতন ব্যাধিটির সহিত আর একটি বিসদৃশ, কৃত্রিম দীর্ঘস্থায়ী নূতন পীড়া জুড়িয়া দিয়া রোগীর একটির স্থলে দুইটি পীড়া উৎপাদন করে অর্থাৎ তাহার ফলে রোগীর যন্ত্রণা আরও বাড়িয়া যায় এবং রোগ আরোগ্য করা দুঃসাধ্য, প্রায় অসাধ্য হইয়া পড়ে।চিকিৎসাসম্বন্ধীয় পত্রিকাদিতে যে সকল রোগের জন্য উপদেশ চাওয়া হয় এবং চিকিৎসাসম্পর্কিত লেখায় অন্যান্য যেসকল বিবরণী প্রকাশিত হয় সেগুলি ইহার সত্যতা বহন করে। ঠিক এইভাবেই প্রায় দেখা যায় উপদংশরোগের সহিত সোরা কিংবা অর্বুদযুক্ত গনোরিয়ার সংমিশ্রণজনিত জটিল পীড়া দীর্ঘকাল ধরিয়া পুনঃপুনঃ পারদঘটিত ঔষধের অযথা বৃহৎ মাত্রায় ব্যবহারেও আরোগ্য হয় না। বরং তাহা দেহের মধ্যে পারদঘটিত পুরাতন পীড়ার পাশেই নিজের স্থান করিয়া লয়। ইতিমধ্যেই বর্ধিত পারদঘটিত রোগের সংগে ইহা মিলিত হইয়া এক বিকট বীভৎস জটিল রোগ সৃষ্টি করে- যাহাকে সাধারণভাবে বলা হয় যৌনব্যাধি। তাহা তখন নিরাময় করা সম্পূর্ণ অসাধ্য যদি নাও হয় তাহা হইলেও অতি কষ্টেই তাহার আরোগ্য বিধান করা সম্ভব হয়।

🎴সূত্রঃ ৪২। মানবদেহে একাধিক বিসদৃশ পীড়া উপস্থিত হইলে উহারা দেহে আপন আপন স্থান বাছিয়া লয়-

পূর্বেই বলা হইয়াছে, প্রকৃতি দেবী নিজেও কোন কোন ক্ষেত্রে একই সময়ে দুইটি (তিনটিও) প্রাকৃতিক ব্যাধি একই দেহে স্থান লাভ করিতে দেন। ইহা লক্ষ্য করবার বিষয়, এইরূপ জটিলতা দুইটি বিসদৃশ রোগের পক্ষেই ঘটা সম্ভব, যাহারা প্রাকৃতিক অমোঘ নিয়মে একটি অপরটিকে দূর করিতে পারে না, ধ্বংস করিতে পারে না এবং নিরাময় করতে পারে না। কিন্তু দৃশ্যত উভয়ে ( কিংবা তিনটিতে) দেহের ভিতরে পৃথকভাবে বাস করে এবং সেই সকল অংশ ও যন্ত্রসমূহ অধিকার করিয়া বসে যেগুলি তাহাদের প্রত্যেকটির উপযুক্ত। এই সকল পীড়ার পরস্পরের মধ্যে কোন সাদৃশ্য না থাকায় এইরূপ ঘটা সম্ভব এবং তাহাতে জীবনসত্তার কোন হানি হয় না।

🎴সূত্রঃ ৪৩। আরোগ্য সাধনে প্রাকৃতিক শিক্ষা-

দুইটি সদৃশ রোগ যখন আসিয়া একত্র মিলিত হয় তখন ফল হয় কিন্তু বিভিন্ন। অর্থাৎ যেখানে পূর্ব হইতে উপস্থিত একটি রোগের সহিত অন্য একটি বলবত্তর সদৃশ রোগ যুক্ত হয় সে ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কেমনভাবে আরোগ্য সম্পাদিত হয় তাহা দেখিয়া কিরূপে আরোগ্য বিধান করা যায় আমরা শিক্ষা লাভ করি।

🎴সূত্রঃ ৪৪। দুইটি সদৃশ পীড়ার ক্ষেত্রে কি ঘটিয়া থাকে-

দুইটি সদৃশ পরস্পরকে বিদূরিত করিতে পারে না (যেমন বিসদৃশ রোগ সম্পর্কে প্রথম ক্ষেত্রে বর্ণিত হইয়াছে) কিংবা তাহাদের একটি অপরটিকে স্থগিত রাখিতে পারে না (যেমন বিসদৃশ রোগ সম্বন্ধে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দেখানো হইয়াছে) যাহাতে নূতন ব্যাধিটিরভোকাল শেষ হওয়ার পরে আবার পুরাতনটি আবির্ভূত হয়। তাহা ছাড়া দুইটি সদৃশ ব্যাধির (যেমন বিসদৃশ ব্যাধি সম্পর্কে তৃতীয় ক্ষেত্রে দেখানো হইয়াছে) একই দেহে পাশাপাশি অবস্থান করা কিংবা উভয়ে মিলিত হইয়া একটি জটিল রোগ উৎপন্ন করার সম্ভাবনাও দেখা যায় না
🎴সূত্রঃ ৪৫। উৎপত্তি হিসাবে বিভিন্ন কিন্তু প্রকাশ ভঙ্গিমায় ও লক্ষণরাজির মধ্যে প্রচুর সাদৃশ্য থাকিলে তাহারা পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংস করে-
না! দুইটি ব্যাধি সমজাতীয় না হইলেও যদি প্রকাশ ও ক্রিয়া উৎপাদনে এবং যন্ত্রণা ও লক্ষণাদির স্ফুরণের তাহাদের উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য থাকে তাহা হইলে যখনই তাহারা দেহাভ্যন্তরে একত্র মিলিত হয় একটি অপরটির ধ্বংসসাধন করিয়া থাকে।
🎴সূত্রঃ ৪৬। সদৃশ নীতিতে পীড়া অপসারণের কতিপয় উদাহরণ-
সদৃশ লক্ষণযুক্ত অন্যান্য বিধি কর্তৃক হোমিওপ্যাথি মতে রোগ নিরাময়ের অনেক দৃষ্টান্ত প্রাকৃত জগৎ হইতে দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য আরো কিছু নিশ্চিত ও সন্দেহাতীত বিষয় সম্বন্ধে বলা ও এমন কয়েকটি ব্যাধি সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিনিবন্ধ করা যেগুলি বরাবর একইভাবে একই নির্দিষ্ট রোগবীজ হইতে উৎপন্ন এবং সেজন্য একটি সুস্পষ্ট নামে পরিচিত।
ইহাদের মধ্যে নানা মারাত্মক লক্ষণযুক্ত ভীতিপ্রদ বসন্তরোগ একটি প্রধান স্থান অধিকার করিয়া আছে এবং তাহা সদৃশ লক্ষণযুক্ত অনেক পীড়াকে বিদূরিত ও আরোগ্যদান করিয়াছে।
বসন্তরোগ কত ক্ষেত্রেই না চক্ষু প্রদাহ সৃষ্টি করিয়াছে, এমনকি অন্ধত্বও! কিন্তু দেখুন, বসন্তের টিকা দিয়া ডিজোটো ও লেরয় প্রত্যেকে একটি করিয়া পুরাতন চক্ষু ওঠা রোগ স্থায়ীভাবে সারাইয়াছিলেন।
ক্লাইন বলেন মাথার চর্মরোগ চাপা পড়ার ফলে উৎপন্ন দুই বৎসরের স্থায়ী অন্ধত্ব ইহার (বসন্ত) দ্বারা সম্পূর্ণ নিরাময় হইয়াছে।
বসন্তরোগের ফলে কত ক্ষেত্রেই না বধিরতা ও শ্বাসকষ্ট দেখা যায়! জে ক্লস দেখিয়াছিলেন, এই রোগের চরম অবস্থায় বহুদিনের পুরাতন ঐ দুইটি রোগ সারিয়ে গিয়াছিল।
অণ্ডকোষফোলা, এমনকি প্রচন্ড ধরনের প্রায়ই বসন্তরোগে দেখা যায়। ক্লাইন লক্ষ্য করেন যে আঘাত জনিত বাম অন্ডকোষের একটি বৃহৎ শক্ত স্ফীতি সাদৃশ্যের জন্য ইহার দ্বারা আরোগ্যপ্রাপ্ত হইয়াছে ।অন্য একজন পর্যবেক্ষক ঐ ধরনের অন্ডকোষস্ফীতি ঐ রোগে সারিয়া যাইতে দেখিয়াছিলেন।

🎴সূত্রঃ ৪৭। ঔষধ সম্বন্ধে প্রকৃতির শিক্ষা-

প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রাখিয়া নিশ্চিতভাবে, দ্রুত ও স্থায়ীরূপে আরোগ্যবিধান করিবার জন্য কোন্ জাতীয় ঔষধ নির্বাচন করা উচিত তাহা উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলি ছাড়া আর কিছুই সহজ ও সন্দেহাতীতভাবে চিকিৎসককে শিখাতে পারে না ।

🎴সূত্রঃ ৪৮। বিসদৃশ ঔষধ নহে, সদৃশ শক্তিশালী ঔষধ দ্বারাই রোগ দূরীভূত হয়-

উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলি হইতে আমরা দেখিতে পাই, প্রাকৃতিক বিধানে কিংবা চিকিৎসকের নৈপুণ্যে-কোন প্রকারেই এবং কোন ক্ষেত্রেই উপস্থিত কোন ব্যাধিকে বিসদৃশ রোগশক্তি দ্বারা-তাহা যতই শক্তিশালী হোক না কেন দূরীভূত করা যায় না । কিন্তু চিরন্তন অমোঘ প্রাকৃতিক নিয়মে- এই পর্যন্ত স্বীকৃত হয় নাই-একটি সদৃশ এবং বলবত্তর শক্তি দ্বারা তাহা দূরীভূত হয়।

🎴সূত্রঃ ৪৯। সদৃশ বিধানমতে প্রকৃতিতে রোগারোগ্য এত কম দেখা যায় কেন?

হোমিওপ্যাথিক রীতিতে এইরূপ যথার্থ প্রাকৃতিক আরোগ্যবিধান আমরা আরও অনেক দেখিতে পাইতাম যদি পর্যবেক্ষকগণ আরও বেশি মনোযোগসহকারে সেদিকে লক্ষ্য রাখিতেন এবং অপরপক্ষে আরোগ্যসহায়ক সদৃশ লক্ষণযুক্ত প্রাকৃতিক রোগ যদি এত কম না থাকিত ।

🎴সূত্রঃ ৫০। বসন্ত ও হাম প্রভৃতি প্রাকৃতিক পীড়া হোমিও ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় না কেন?

আমরা দেখিতে পাই যে শক্তিসম্পন্ন প্রাকৃতির কর্তৃত্বাধীনে সদৃশ রীতিতে আরোগ্য বিধান করিবার যন্ত্ররূপে সূক্ষ্ম রোগবীজজাত স্থায়ী ধরনের পিড়াসমূহ (খোসপাঁচড়া), হাম, বসন্ত প্রভৃতি রোগশক্তি ছাড়া আর বিশেষ কিছুই নাই। ভেষজরূপী সেই সকল ব্যাধি অত্যন্ত মারাত্মক এবং সেই জন্য যে রোগ সারাইবার জন্য তাহাদের প্রয়োগ করা হয় তাহা অপেক্ষা সেইগুলি আরও ভয়ঙ্কর অথবা সেগুলির প্রকৃতি এইরূপ (খোসপাঁচড়ার মতো ) যে রোগ সারাবার পরে তাহাদিগকেই নির্মল করিবার জন্য আবার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। উল্লিখিত উভয় কারণেই সেগুলি হোমিওপ্যাথিক ঔষধরূপে ব্যবহৃত হওয়া কষ্টকর, অনিশ্চিত ও ভীতিপ্রদ। আর যে সকল ব্যাধি দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হয় তাহাদের কয়টিই বা বসন্ত, হাম বা খোসপাঁচড়া রোগের ভিতরে তাহাদের সদৃশ আরোগ্যশক্তি খুঁজিয়া পাইবে? সেই জন্য প্রাকৃতিক বিধানে অতি অল্প কয়েকটি পিড়াই সেই সকল অনিশ্চিত, বিপদসঙ্কুল, হোমিওপ্যাথিক রোগশক্তি দাঁড়া নিরাময় হইতে পারে। তাহা ছাড়া, তাহাদের মাধ্যমে যে আরোগ্যবিধান তাহাতে আরও বিপদ ও যথেষ্ট অসুবিধার কারণ আছে। তাহার এই যে ঐ সকল রোগশক্তির মাত্রাকে ওষুধের মাত্রার মতো অবস্থাঅনুযায়ী কামাইতে পারা যায় না, অথচ অনুরূপ দীর্ঘস্থায়ী পীড়ায় আক্রান্ত রোগীকে বসন্ত, হাম বা খোসপাঁচড়ার মতো ভয়াবহ ও যন্ত্রণাদায়ক পীড়া সম্পূর্ণভাবে ভোগ করিতে হয় এবং সেই রোগকে পরে আবার সারাইতে হয়। তথাপি যাহা দেখা গিয়াছে তাহার শুভ যোগাযোগে হোমিওপ্যাথিক রীতি দ্বারা সম্পন্ন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হোমিওপ্যাথিক রীতি দ্বারা সম্পন্ন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আরোগ্যবিধান দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারে। সেগুলি প্রকৃতির সন্দেহাতীত প্রমাণ এবং তাহার মধ্যে এই শিক্ষা নিহিত আছে, সদৃশ লক্ষণ দ্বারা আরোগ্য বিধান কর ।

🎴সূত্রঃ ৫১। রোগ অপেক্ষা সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন ভেষজ প্রয়োগই সুবিধাজনক
এই আরোগ্য নীতি সকল বুদ্ধিমান ব্যক্তির নিকট স্পষ্টরূপে বোধগম্য হওয়ার পক্ষে এই সকল তথ্যই যথেষ্ট । আবার ইহাও দেখা যায়, স্হূল প্রকৃতির খেয়াল খুশি মাফিক ক্রিয়া পদ্ধতি অপেক্ষা মানুষ কত বেশি সুবিধার অধিকারী। সমস্ত জগতে কত সহস্র সহস্র সদৃশ রোগ উৎপাদনকারী ভেষজদ্রব্য রহিয়াছে যেগুলি মানুষের আয়াত্তাধীনে পীড়িত মানবকে আরোগ্যের জন্য ব্যবহৃত হইতে পারে। তাহাদের মধ্যে খুঁজিয়া পাওয়া যায় সকল প্রকার সম্ভাব্য ক্রিয়াসমন্বিত রোগ উৎপাদক শক্তি,। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য যাহা ধারণাগম্য ও ধারণাতীত অসংখ্য প্রাকৃতিক পিড়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হইতে পারে। ঐ সকল রোগ উৎপাদক ভেষজসমূহের আরোগ্যবিধায়ক ক্রিয়া শেষ হইলে তাহাদের শক্তি জীবনীশক্তি দ্বারা পরাভূত হয় এবং নিজে নিজেই মিলাইয়া যায়। খোসপাঁচড়ার মতো তাহাদিগকে তারাইবার জন্য আর দ্বিতীয়বার চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। সেগুলিকে (ভেষজ) চিকিৎসক চূর্ণীকৃত ও বিভাজিত করিয়া অসীমশক্তির আধাররূপে পরিণত করিতে পারেন এবং তাহাদের মাত্রাকে তিনি এরূপ পরিমাণে হ্রাস করিতে পারেন যে, যে সদৃশ রোগকে সারাইবার জন্য তাহা প্রয়োগ করা হয় তদপেক্ষা (সেইমাত্রা) কিছু বেশি শক্তিশালী অবস্থায় থাকে। তাহার ফলে, এই অতুলনীয় চিকিৎসাপদ্ধতিতেই পুরাতন দুরারোগ্য ব্যাধির মূলোৎপাটন করিবার জন্য দেহের উপর প্রচন্ড প্রতিক্রিয়া আনার প্রয়োজন হয় না। এই প্রণালীতে আরোগ্যলাভ ঘটে শান্তভাবে ও অজ্ঞাতসারে অথচ অনতিবিলম্বে যন্ত্রণাদায়ক প্রাকৃতিক পীড়াকে বাঞ্ছিত স্হায়ী সুস্থতায় রূপায়িত করে।

🎴সূত্রঃ ৫২। আরোগ্য সাধনের দুইটি রীতি
আরোগ্যবিধানের জন্য মাত্র একটি প্রধান পথ খোলা রহিয়াছে। একটি ভিত্তি হইল প্রাকৃতিকে নির্ভুলভাবে পর্যবেক্ষণ, সতর্ক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা- যাহাকে হোমিওপ্যাথিক রীতি বলা হয় (ইচ্ছাপূর্বক এই শব্দটি পূর্বে আমরা কখন ও ব্যবহার করি নাই) এবং দ্বিতীয়টি হলো হেটারোপ্যাথিক বা এলোপ্যাথিক পদ্ধতি যাহাতে এসব কিছু করা হয় না। একটি অপরটির বিপরীত; যিনি দুইটির একটিকেও জানেন না তাহারই এই ভ্রান্তি আসা সম্ভব যে দুইটি পদ্ধতি পরস্পর মিলিত হইয়া পরস্পরের সহিত যুক্ত হতে পারে। তিনিই রোগীর ইচ্ছানুসারে একসময়ে হোমিওপ্যাথিকমতে, অন্য সময়ে এলোপ্যাথিক চিকিৎসা করিয়া নিজেকে হাস্যাস্পদ করেন। এইরূপ চিকিৎসাকে অনুপম হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধ বলা যাইতে পারে।

🎴সূত্রঃ ৫৩। শান্তভাবে প্রকৃত আরোগ্যলাভ কেবলমাত্র হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতেই ঘটা সম্ভব। অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্তসূত্রে আমরা দেখিয়েছি (৭-২৫) যে ইহা নিঃসন্দেহে ঠিক পথ যাহার অনুসরণে কলানৈপুণ্যের ভিতর দিয়া সর্বাপেক্ষা দ্রুত, সুনিশ্চিত ও স্থায়ী আরোগ্যলাভ সম্ভব; যেহেতু এই আরোগ্যকলা প্রকৃতির এক চিরন্তন অভ্রান্ত নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। বিশুদ্ধ হোমিওপ্যাথিক আরোগ্যকলাই একমাত্র নির্ভুল পদ্ধতি, মানুষের কলাকৌশলসাধ্য, আরোগ্যলাভের সরলতম পথ, দুইটি নির্দিষ্ট বিন্দু মধ্যে একটি মাত্র সরল রেখার ন্যায় ধ্রুব।

(১১) হোমিওপ্যাথিক ও এলোপ্যাথিক চিকিৎসার তুলনা (সূত্র-৫৪-৬২)

🎴সূত্রঃ ৫৪। কল্পিত রোগবস্তূ খুঁজিয়া বিভিন্ন রোগ নামকরনান্তে মিশ্র ঔষধ ব্যবস্থা করাই এলোপ্যাথিক নীতি-

এলোপ্যাথিক চিকিৎসা প্রণালীতে রোগের বিরুদ্ধে অনেক কিছুই ব্যবহৃত হয়, কিন্তু সাধারণত সেগুলি অনুপযুক্ত এবং বহুকাল ধরিয়া ইহারা নানাপ্রকার পদ্ধতি নামে অভিহিত হইয়া আধিপত্য বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। ইহাদের প্রত্যেকটি এক এক সময়ে বিশেষভাবে আকার বদলাইয়া যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসাপদ্ধতি বলিয়া নিজেকে গৌরবদান করিয়াছে। এইরুপ পদ্ধতির প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠাতাই নিজের সম্বন্ধে মানবের অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহার সুস্পষ্ট পরিচয় পাইয়াছেন এবং কোন দূষিত বস্তু রোগীর দেহ হইতে বিদূরিত করিতে হইবে এবং তাহার স্বাস্থ্য ফিরাইয়া আনিবার জন্য কিভাবে তাহা করিতে হইবে তদনুসারে তিনি ব্যবস্থাপত্র দিয়াছেন। প্রকৃতির কাছে সরলভাবে জিজ্ঞাসু না হইয়া এবং সংস্কারমুক্ত চিত্তে অভিজ্ঞতার শিক্ষা না লইয়া তাহার এই সকল ব্যবস্থা হইল অসার কল্পনা ও মনগড়া অনুমানপ্রসূত ব্যাধিসমূহকে প্রায় একইভাবে পুনরাবর্তিত অবস্থা বলিয়া হইত। তদনুযায়ী অধিকাংশ পদ্ধতিতেই তাদের কল্পনাগড়া ব্যাধিচিত্তের একটি করিয়া নাম দেওয়া হইত এবং প্রত্যেকটি পদ্ধতিকে বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগের মধ্যে ফেলা হইত। ঔষধসমূহের উপর এমন কতকগুলি ক্রিয়া আরোপ করা হইত যাহা সেই সকল অস্বাভাবিক অবস্থা দূর করিতে পারিবে বলিয়া মনে করা হইত। (তাহা হইতে মেটেরিয়া মেডিকা বিষয়ে এত বেশি পাঠ্য পুস্তকের উৎপত্তি) ।

🎴সূত্রঃ ৫৫। সময় সময় আশু ও ক্ষণস্থায়ী উপশম দান করতে পারার জন্যই এলোপ্যাথি আজও টিকিয়া আছে-

শীঘ্রই কিন্তু সাধারণের এই বিশ্বাস জন্মিলযে এই সকল প্রণালী ও পদ্ধতির প্রত্যেকটি যথাযথ প্রবর্তিত হওয়ার ফলে রোগীর যন্ত্রণা বাড়িয়া চরম সীমায় উঠে। হাতুড়েপদ্ধতি দ্বারা আবিষ্কৃত এই সকল ঔষধ দ্বারা কখন ও কখন ও সাময়িক উপশম যদি পাওয়া না যায়ত এবং তৎক্ষণাৎ তাহার আরামপ্রদ ক্রিয়া রোগীর অনুভবগম্য না হইত তাহা হইলে অনেক আগেই এই সকল এলোপ্যাথিক চিকিৎসককে বিদায় লইতে হইত। এই সকলের জন্যই কিয়ৎ পরিমাণে তাহাদের মান রক্ষা পাইয়াছে।

🎴সূত্রঃ ৫৬। বিপরীত বিধান পীড়ার আংশিক উপশম করে মাত্র-

সতেরো শতাব্দি ধরিয়া গেলেনেরপ্রবর্তিত সাময়িক উপশমদায়ক – বিপরীতকে বিপরীত দিয়া চিকিৎসা (অ্যান্টিপ্যাথি, এনান্টিওপ্যাথি) শিক্ষালাভ করার ফলে চিকিৎসকগণ আশু উপশম প্রদানের ছলে লোকের বিশ্বাসভাজন হইবার করিয়াছিলেন।কিন্তু মূলে এই পদ্ধতি কত সাহায্যে অক্ষম ও ক্ষতিজনক (চিররোগে) তাহা পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখিতে পাইব। এলোপ্যাথগণের অনুসৃত চিকিৎসা প্রণালীর মধ্যে ইহা নিশ্চয়ই একটি যাহার সহিতপ্রাকৃতিক রোগ লক্ষণের একাংশের সুস্পষ্ট আছে; কিন্তু কি জাতীয় সম্বন্ধ? বাস্তবিকই ঠিক সেইটি (ঠিকেরই যথার্থ বিপরীত) যেটিকে সতর্কতার সহিত পরিহার করে চলা উচিত- যদি আমরা চিররোগগ্রস্ত রোগীর সম্বন্ধে ছলনা বা তামাশা করিতে না চাই।

🎴সূত্রঃ ৫৭। অসমলক্ষণ চিকিৎসায় সমগ্রলক্ষণের মধ্যে একটিমাত্র কষ্টকর লক্ষণের চিকিৎসা চলে-

এই ধরনের অসমলক্ষণ প্রথায় চিকিৎসা কার্য পরিচালনা করার জন্য সমগ্র রোগলক্ষণের মধ্যে সবচাইতে কষ্টকর লক্ষণটি লইয়া অন্যান্য লক্ষণগুলি অবজ্ঞা করা হয়। সাধারণ চিকিৎসক এই যন্ত্রণাদায়ক লক্ষণটি দূর করার জন্য, বিপরীত লক্ষণ মতে চিকিৎসা কার্য পরিচালনা করেন এবং উক্ত ঔষধ রোগলক্ষণের বিপরীত অবস্থা উৎপাদন করেন বলিয়া তিনি অবগত আছেন। এইভাবে ঔষধ নির্বাচনের পর তিনি অতিসত্বর উপকারের আশা করেন। সব ধরনের যন্ত্রণার অবসানের জন্য তিনি অতি মাত্রায় আফিম প্রয়োগ করেন। কেননা আফিম সত্ত্বর অনুভব শক্তিকে বিনষ্ট করিয়া ফেলে। এই ঔষধটি সব রকমের তরল ভেদে ব্যবহার করা হয়। কারণ ইহা শীঘ্রই অন্ত্রনালীর মল সঞ্চালন গতি রোধ করে এবং উহার অবসাদ আনিয়া দেয়। অবসাদকর অচেতন নিদ্রা আনয়ন করে বলিয়া নিদ্রাহীনতার জন্যও এই ঔষধটি দেওয়া হয়। কারণ আফিম অতিশীঘ্র মস্তিষ্কের অবসাদসূচক অচৈতন্যাবস্থায়কর নিদ্রা উৎপাদন করে। এই পদ্ধতির চিকিৎসক কোষ্ঠকাঠিন্য হলে জোলাপ দেন হাত পুড়িয়া গেলে ঠাণ্ডা জলে রোগীর হাত ডুবাইয়া দেন। ইহাতে জলের শীতলতার জন্যই পোড়ার জ্বালা আশু নিবারিত হয়। রোগী যখন উত্তাপহীনতার জন্য শীতবোধ করে তখন তাকে গরম জলে স্নান করান যেন তাহার শরীর গরম হইয়া উঠে। দীর্ঘদিনের দুর্বলতার জন্য মদের ব্যবস্থা করেন, যাহাতে রোগী মুহূর্তের মধ্যে সবল ও প্রফুল্ল হয়ে উঠে। এইভাবে আরও অনেক গুলি বিপরীত ক্রিয়া সৃষ্টিকারী ঔষধ ব্যবহার করেন কিন্তু উক্ত ঔষধগুলি ছাড়া তাহার আর অল্পই জানা আছে। কারণ খুব অল্প সংখ্যক ঔষধেরই বিশেষ ক্রিয়া (প্রাথমিক) সাধারণ তন্ত্রে জানা আছে।

🎴সূত্রঃ ৫৮। এলোপ্যাথিক বা অসমলক্ষণ চিকিৎসার ত্রুটি-

এই প্রকার পদ্ধতিতে চিকিৎসার মূল্য নিরূপণ করিতে যাইয়া ইহা যে একটি অত্যন্তযুক্ত লাক্ষনিক পদ্ধতি-যাহাতে চিকিৎসক সমগ্র লক্ষণের মধ্যে কেবলমাত্র একটি লক্ষণ এর দিকেই ঝোঁক দেন এবং সেজন্য রোগীর প্রার্থিত সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের আশা পূর্ণ হয় না-সে বিষয়ে ছাড়িয়া দিলেও অপরপক্ষে আমাদের অভিজ্ঞতা ইহাই কি আমাদিগকে জানাই না যে এন্টি প্যাথিক পদ্ধতিতে চিররোগে ঔষধ প্রয়োগ দ্বারা প্রথমে সাময়িক উপশমের পরে আবার সমগ্র পীড়ার বৃদ্ধি ঘটিয়া থাকে? প্রত্যেক মনোযোগী দ্রষ্টাই স্বীকার করিবেন যে অ্যান্টিপ্যাথিক সাময়িক উপশমের পর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আসিয়াছে বৃদ্ধি, যদিও সাধারণ চিকিৎসক সেই পরবর্তী বৃদ্ধির কারণ রোগীকে অন্যভাবে বুঝাইয়া দেন এবং বলেন যে এই বৃদ্ধির প্রাথমিক রোগের মারাত্মক অবস্থার একটা প্রথম প্রকাশ অথবা অন্য কোন নুতন পীড়া ।

🎴সূত্রঃ ৫৯। অসমলক্ষণ মতে চিকিৎসায় উপশমিত লক্ষণের পুনঃ আবির্ভাবের দৃষ্টান্ত-

এই প্রকার সাময়িক উপশমদায়ক বিরুদ্ধধর্মী ঔষধ দ্বারা চিকিৎসায় স্থায়ী রোগের লক্ষণসমূহের কয়েক ঘণ্টা পরেই পুনরাবির্ভাব, তখন বিড়াল স্পষ্ট বিদ্রূপ বিপরীত অবস্থা আসা ছাড়া আর কিছুই হয় না। দিনের বেলায় অনবরত নিদ্রালুতার জন্য চিকিৎসক কফির ব্যবস্থা করেন। ইহার প্রাথমিক ক্রিয়া হইল সতেজতা আনায়ন করে। ইহার ক্রিয়া শেষ হইয়া গেলে দিবানিদ্রালুতা আবার বাড়িয়া যায়। রোগের অন্যান্য লক্ষণের দিকে দৃষ্টি না দিয়া রাত্রের অনিদ্রার জন্য সন্ধ্যার সময় আফিম ব্যবস্থা করা হয়। তাহার প্রাথমিক ক্রিয়ায় সেইরাত্রে একটা আচ্ছন্নভাব আসলেও পরবর্তী রাত্রিগুলিতে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর জাগরনে কাটাইতে হয়। অন্যান্য রোগলক্ষণের দিকে মনোযোগ না দিয়া পুরাতনয উদারাময়কে বন্ধ করিবার জন্য সেই আফিম আবার দেওয়া হয়। তাহার প্রাথমিক ক্রিয়ার ফল হইল কোষ্ঠবদ্ধতা,উদারাময় সাময়িকভাবে বন্ধ থাকার পরে তাহা আবার খারাপ ভাবে দেখা দেয়। বিভিন্ন প্রকারের প্রচণ্ড যন্ত্রণার পুনঃপুনয়আক্রমণে আফিম দিয়া অল্প সময়ের জন্য তাহা দমন করা হইল অধিকতরভাবে, কখন ও অসহনীয়তীব্রতায় তাহা ফিরিয়া আসে কিংবা তাহা অপেক্ষা আরও খারাপ ব্যাধি তাহার স্থানে আসিয়া জোটে। দীর্ঘস্থায়ী রাত্রিকালীন কাশির জন্য সাধারণ চিকিৎসাক আফিম ছাড়া আর কিছুরই ব্যবস্থা জানেন না। আফিমের প্রাথমিক ক্রিয়ায় হইলো সকল প্রকার উত্তেজনাকে দমন করা, সেজন্য প্রথম রাত্রে কাশি হয়তো বন্ধ থাকে, কিন্তু পরবর্তী রাত্রিসমূহে তাহা আর ও প্রচন্ডভাবে দেখা দেয়। আরও অধিকতর মাত্রায় ব্যবহার করিয়া যদি পুনঃপুন তাহা দমন করা হয় তাহা হইলে জ্বর ও নিশার্ঘম আসিয়া তাহার সহিত যুক্ত হয়। মূত্রাশয়ের দুর্বলতা ও তৎসহ মুত্রাবরোধের প্রতিকারের জন্য এন্টিপ্যাথিক পদ্ধতিতে ক্যান্হারাইডিসপ্রয়োগ করিয়া মূত্রনালী সমূহকে উদ্দীপনা দিবার চেষ্টা করা হয়। তাহার ফলে প্রথমে মূত্রের নিঃসরণ ঘটিলেও পরে মূত্রাশয়কে আর ক্রিয়াশীল করিবার জন্য সম্ভাবনা থাকে না, সেই জন্য তাহার সংকোচন মন্দীভূত হওয়ার পক্ষাঘাত আসন্ন হইয়া পড়ে। বৃহৎ মাত্রায় জোলাপ দিয়া পুনঃপুন মলত্যাগের উত্তেজনা সৃষ্টি করিয়া পুরাতন কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করিবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাহার গৌণ ক্রিয়ার ফলে কোষ্ঠবদ্ধতা আরো বাড়িয়া যায়। সাধারণ চিকিৎসক বহুদিনের স্থায়ী দুর্বলতাকে দূর করিবার জন্য মদ্য ব্যবস্থা করিয়া থাকেন। প্রাথমিক ক্রিয়ায় তাহা সলতা আনিলেও প্রতিক্রিয়া অধিকতর অবসন্নতা লইয়া আসে। তিক্ত ভেষজ ও গরম মসলা দ্বারা পাকস্থলীর বহুদিনের স্থায়ী নিষ্ক্রিয়তা ও দুর্বলতাকে সতেজ ও করিবার চেষ্টা করা হয়,কিন্তু এই প্রাথমিক উপশমের প্রতিক্রিয়ায় পাকস্থলী আর ও নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়ে। বহুদিন স্থায়ী দৈহিক উত্তাপ এর অভাব এবং উষ্ণস্নানে উপশম হয়, কিন্তু পরে রোগী অধিকতর দুর্বল, শীতল ও শীতকাতর হইয়া পড়ে। গুরুতরভাবে দুগ্ধ স্থানে শীতল জল প্রয়োগ করিলে সঙ্গে সঙ্গে উপশম বোধ হয় বটে কিন্তু দুগ্ধযন্ত্রণাপরে অবিশ্বাস্য রূপে বাড়িয়া যায় এবং প্রদাহ আরও অধিকস্থান লইয়া বিস্তৃত হয়। যে সকল ঔষধে হাঁচি জন্মাইয়া সর্দি নিঃসরণ করে সেই পোকার ঔষধ প্রয়োগে বহুদিনের স্থায়ী সর্দিতে নাক বন্ধ থাকা অবস্থা দূর করিবার ব্যবস্থা করা হয়, কিন্তু এই সকল বিরোধের প্রতিক্রিয়ায় অসুখ যে আরও বাড়িয়া যায় তাহা নজরে আসে না, নাক আরও বেশি বন্ধ হইয়া যায়। তড়িৎশক্তির প্রাথমিক ক্রিয়া হইল পেশীসমূহকে উদ্দীপিত করা। এই শক্তির ক্রিয়ায় বহুদিনের দুর্বল, প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গকে অতি দ্রুত ক্রিয়াশীল করা হয়, কিন্তু তাহার গৌণ ফল হইল পেশী সমূহের সকল উত্তেজনার স্তব্ধতা ও সম্পূর্ণ পক্ষাঘাত। শিরা কাটিয়া মস্তকের স্থায়ী রক্ত সঞ্চয় দূর করিবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাহার ফলে রক্ত সঞ্চয় আর ও বেশী হইয়া থাকে। বিভিন্ন প্রকারের টাইফয়েডরোগে দেহযন্ত্র ও মনের যে অসাড়তা ও সেই সঙ্গে অচৈতন্য অবস্থা দেখা যায় তাহার চিকিৎসার জন্য সাধারণ চিকিৎসকগণের অধিকমাত্রায় ভ্যালেরিয়ান প্রয়োগ ছাড়া বিশেষ আর কিছু জানা নাই। কারণ সতেজতা প্রদান করিতে ও স্নায়ুতন্ত্রের গতিশীলতা বৃদ্ধি করে যে সকল ওষুধের ক্ষমতা সার্বাধিক ইহা তাদের অন্যতম। অজ্ঞানতাবশত তাহারা জানেন না যে এই ক্রিয়া প্রাথমিক মাত্র এবং তাহা অন্তর্নিহিত হইলে দেহযন্ত্র সুনিশ্চিতভাবে বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া কবলে পড়ে ও অধিকতর চেতনা হীনতা ও অসারতা আশিয়া দেখা দেয় অর্থাৎ ফলে হয় মানসিক ও দৈহিক পক্ষাঘাত, মৃত্যু। তাহারা লক্ষ্য করেন নাই যে, যেসকল রোগে বিপরীত ক্রিয়াশীল ভ্যালেরিয়ান প্রচুর পরিমাণে দিয়াছেন সেগুলির সুনিশ্চিত পরিমাণ হইয়াছে মৃত্যু। পুরাতনপন্থী চিকিৎসকগণ এই মনে করিয়া আনন্দ বোধ করেন যে, রক্তাভ ফক্সগ্লভের প্রথম মাত্রা প্রয়োগ করিয়াই (যাহার প্রাথমিক ক্রিয়া হইল নাড়ির গতিকে মন্দীভূত করা) রক্তহীন নাড়ীর গতিবেগকে কয়েক ঘণ্টার জন্য মন্হর করিয়া দিতে পারেন। কিন্তু ইহার বেগ আবার শীঘ্র ফিরিয়া আসে। পুনঃপুন মাত্রা বাড়াইয়া ক্রমশ অল্প অল্প বেগ কমতে কমতে শেষে আর উপকার হয় না। বস্তুত প্রতিক্রিয়ায় নাড়ির গতি এত দ্রুত হয় যে গনিয়া উঠিতে পারা যায় না; নিদ্রা, ক্ষুধা, বল চলিয়া যায়, অতি দ্রুত অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু ঘনাইয়া আসে, আর নয়তো উন্মাদরোগ দেখা যায়। এক কথায়, এই প্রকার বিরুদ্ধ চিকিৎসার (অ্যান্টিপ্যাথিক) প্রতিক্রিয়ার ফলে কতবার ব্যাধির বৃদ্ধি হয় এবং খারাপ অবস্থা ঘটে মিথ্যা কল্পনাময় পুরাতনপন্থী চিকিৎসায় তাহার অনুভব হয় না, কিন্তু অভিজ্ঞতা ইহা ভয়ঙ্করভাবে শিখাইয়া দেয়।

🎴সূত্রঃ ৬০। বিসদৃশ অসমলক্ষণযুক্ত ঔষধের ক্রমাগত মাত্রা বৃদ্ধির কুফল-

এই সকল কুফল (যাহা স্বভাবতই অ্যান্টিপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগে উৎপন্ন হয়) উপস্থিত হইলে সাধারণ চিকিৎসক মনে করেন যে,প্রতিবার বৃদ্ধির সময় ঔষুধের আরো একটু চড়া মাত্রা দিলে সেই অসুবিধা অতিক্রম করা যাইবে। তদ্দ্বারা সমানভাবেই রোগকে কিছুকাল চাপা দিয়ে রাখা হয়। কিন্তু ক্রমশই ঔষধের মাত্রা আরও বাড়াইয়া উপশম দিবার প্রয়োজন হয়। তাহার ফলে আর একটি অধিকতর কঠিন রোগের সূত্রপাত হয় কিংবা রোগ প্রায়ই আরোগ্যের বাহিরে চলিয়া যায়, জীবনের আশঙ্কা আসে, এমনকি মৃত্যু ঘটে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী রোগকে তদ্দ্বারা কখনও আরোগ্য হইতে দেখা যায় না।

🎴সূত্রঃ ৬১। নির্মূলভাবে রোগ আরোগ্যের জন্য বিসদৃশ ঔষধ প্রয়োগের পরিবর্তে তদবিপরীত সদৃশ ঔষধ প্রয়োগ করা উচিত-

বিপরীত পদ্ধতিতে ঔষধ প্রয়োগ করিলে যে বিষাদময় ফল হয় সে সম্বন্ধে চিকিৎসকগণের যদি চিন্তা করিয়া দেখিবার ক্ষমতা থাকিত তাহা হইলে তাহারা এই মহান সত্য বহুকাল পূর্বেই আবিষ্কার করিতে পারিতেন যে প্রকৃত আরোগ্য করা অ্যান্টিপ্যাথিক চিকিৎসার ঠিক বিপরীত পদ্ধতিতেই (অর্থাৎ সদৃশ পদ্ধতিতেই) পাওয়া সম্ভব। তাহারা নিঃসন্দেহ হইতে পারিতেন যে রোগলক্ষণের বিপরীত পদ্ধতিতে ঔষধ প্রয়োগের ফলে আসে ক্ষণিকের উপশম এবং তাহা কাটিয়া গেলে দেখা যায় রোগের অবশ্যম্ভাবী বৃদ্ধি এবং তাহার উল্টা পদ্ধতিতে অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতে লক্ষণের সাদৃশ্য ঢাকায় স্থায়ীভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে রোগ মুক্তি সম্ভব, অবশ্য যদি অ্যান্টিপ্যাথিক স্থূল মাত্রার পরিবর্তে সূক্ষ্মমাত্রার সেই সঙ্গে ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু আন্টিপ্যাথিক চিকিৎসার ফলে ঘটে স্পষ্টভাবে রোগের বৃদ্ধি, ব্যবস্থাপত্রে দৈবক্রমে হোমিওপ্যাথিক সম্বন্ধবিশিষ্ট কোন ঔষধ মুখ্যত উপস্থিত না থাকিলে চিকিৎসকের পক্ষে কখনো কোন দীর্ঘস্থায়ী রোগ সম্পূর্ণ আরোগ্য করা সম্ভবপর নহে, অথবা প্রাকৃত জগতে এই যাবত যেসকল আরোগ্যলাভ দ্রুত ও সম্পূর্ণরূপে ঘটিয়াছে তাহা যে সর্বদা পুরাতন ব্যাধির উপর আরেকটি সদৃশ রোগ উৎপন্ন করিয়া, এই সকল তথ্য হইতে এই দীর্ঘ শতাব্দী ধরিয়াও তাঁহারা সেই সত্য উপলব্ধি করিতে পারেন নাই তাহা জানা থাকিলে প্রকৃতই রোগীর কল্যাণসাধন সম্ভব।

🎴৬২। বিসদৃশ বিধান ক্ষতিকর কিন্তু সদৃশ বিধান উপকারী-

ক্ষণিক উপশমকারী এন্টিপ্যাথিক চিকিৎসার অনিষ্টকর ফল এবং তাহার বিপরীত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় সুফল কিসের উপর নির্ভর করে তাহা নিম্নলিখিত– গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে এবং সেই সকল স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলেও আরোগ্য বিধানের জন্য তাকে অপরিসীম প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন নাই।—-ইউরোপ ও অন্যান্য স্থানের চিকিৎসকগণ সকল রোগের জন্য এই সুবিধাজনক চিকিৎসা পদ্ধতিকে গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তাহার মুখ্য কারণ হইলো ইহাতে বড় একটা ভাবনা চিন্তার দরকার হয়না। (যাহা পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা কঠিন কাজ) । বিবেকের দংশন হইতে মুক্তি ও নিজেদেরসান্তনার জন্য এইটুকু শুধু অবহিত হওয়া প্রয়োজন মনে করিতেন যে তাহারা নিজে এই চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কর্তা নহেন এবং সহস্র সহস্র ব্রুসোপন্হী সেই একই পদ্ধতিতে চলেছেন, আর তাহাদের গুরুর শিক্ষা হইল এই যে, যেভাবেই হোক মৃত্যুর পর সব স্তব্ধ হইয়া যায়। এইরূপে বহু সহস্র চিকিৎসক শোচনীয়ভাবে তাহাদের রোগীদের উষ্ণ রক্ত নির্মমভাবে মোক্ষণ করিবার ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হইয়াছেন। লক্ষ লক্ষ রোগী, যাহাদিগকে আরোগ্য দান করা সম্ভবপর হইতে ব্রুসোর পন্থা অনুসরণ করিয়া ক্রমশ তাহাদের প্রাণ হরণ করা হইয়াছে। তাহাদের সংখ্যা নেপোলিয়নের যুদ্ধক্ষেত্রে যত লোক নিহত হইয়াছে তাহা অপেক্ষা বেশি। যে চিকিৎসা দ্বারা চিকিৎসাযোগ্য সকল রোগী সর্বাপেক্ষা কঠিন চিকিৎসা কলাকৌশল এবং অক্লান্ত কর্মী, বিশ্লেষণদক্ষ চিকিৎসকের বিশুদ্ধ বিচার বুদ্ধির সাহায্যে লইয়া স্বাস্থ্য এবং নবজীবন লাভ করিতে পারে, সেই একমাত্র প্রকৃত বিজ্ঞান ও কলা সম্মত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার পৃথিবীর সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে, সেই জন্যই কি ভগবৎ বিধান অনুসারে আরোগ্য দানযোগ্য রোগীগণের মৃত্যু আনয়নকারী ব্রুসোরচিকিৎসা পদ্ধতির হোমিওপ্যাথির পূর্ববর্তী হওয়া প্রয়োজন ছিল?

(১২) ঔষধের মূখ্য ও গৌণক্রিয়া (সূত্র-৬৩-৭০)

🎴সূত্রঃ ৬৩। ঔষধের মুখ্য ও গৌণ ক্রিয়া-

জীবনে শক্তির উপর ক্রিয়াশীল প্রত্যেকটি বস্তু,প্রত্যেকটি ওষুধ জীবনী শক্তিকে অল্পাধিক বিপর্যস্ত করে এবং তার ফলে দীর্ঘকাল কিংবা স্বল্প সময়ের জন্য ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের কিছু পরিবর্তন ঘটায়। ইহাকে মুখ্য ক্রিয়া বলা হয়। যদিও ইহা ঔষধ ও জীবনীশক্তির ক্রিয়ার সম্মিলিত ফল তথাপি ইহার প্রধান হেতু হইল ঔষধ শক্তি। এই ক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের জীবনীশক্তি তাহার নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করিবার চেষ্টা করে। এই যে প্রতিরোধ ক্রিয়া তাহা বস্তুত আমাদের আত্মরক্ষা শক্তিরই স্বধর্ম ও তাহা স্বয়ংক্রিয় এবং তাকে বলা হয় গৌন ক্রিয়া বা প্রতিকূল ক্রিয়া ।

🎴সূত্রঃ ৬৪। আরোগ্যসাধন প্রক্রিয়া-

আমাদের সুস্থ শরীরের উপর কৃত্রিম রোগ উৎপাদক বস্তুসমূহের অর্থাৎ ওষুধেরমুখ্য ক্রিয়া প্রকাশকালে নিম্নলিখিত পন্হানুসার আমাদের জীবনীশক্তিকেএরূপভাবে আচরণ করতে দেখা যায় যেন তাহা কৃত্তিম বহিঃশত্রুর আক্রমণ নিশ্চেষ্টভাবে আগে নিজের উপর গ্রহণ করিয়া নিজের স্বার্থকে প্রবর্তিত হইতে দিতে বাধ্য হইতেছে। তাহার পর যেন পুনরায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ নিজের সাধ্যানুযায়ী ও কৃত্তিম ঔষধ জনিত মুখ্য ক্রিয়ার সমপরিমানে (ক) মুখ্য ও ক্রিয়ার ঠিক বিপরীত স্বাস্থ্যের অবস্থা আনয়ন করে (প্রতিকূল ক্রিয়া, গৌণ ক্রিয়া)—যদি বিপরীত অবস্থা বলিয়া কিছু থাকে, (খ) কিংবা, মুখ্য ক্রিয়ার কোন বিপরীতপ্রাকৃতিক অবস্থা যদি না থাকে তাহা হইলে নিজেকে স্বতন্ত্র করিয়া লইবার চেষ্টা করে অর্থাৎ স্বীয় বলবত্তর শক্তি প্রয়োগ করিয়া ঔষধ জনিত পরিবর্তনকে বিদূরিত করিয়া তাহার স্থানে স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃস্থাপিত করে ( গৌন ক্রিয়া, আরোগ্যবিধায়িনী ক্রিয়া।)

🎴সূত্রঃ ৬৫। মুখ্য ও গৌণ ক্রিয়ার উদাহরণ-

ক) অংশের সিদ্ধান্ত সমূহ সকলের পরিচিত। গরম জলে ডুবানো হাতটি অন্য হাতটি অপেক্ষা প্রথমে বেশি গরম বলিয়া বোধ হয়( মুখ্য ক্রিয়া), কিন্তু তাহা গরম জল হইতে উঠাইয়া ভালো করিয়া শুকাইয়া লইলে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহা ঠান্ডা এবং পরে অন্য হাত অপেক্ষা অধিকতর ঠান্ডা বলিয়া অনুভূত হয় (গৌণক্রিয়া)। অতিরিক্ত পরিশ্রমের পরে দেহে গরম বোধ হয় (মুখ্য ক্রিয়া), কিন্তু পরে ঠান্ডা বোধ হয় ও কাঁপুনি লাগে (যৌনক্রিয়া)। যে লোক গতকাল অত্যধিক মদ খাইয়া উষ্ণ করিয়াছিল (মুখ্য ক্রিয়া) আজ তাহার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস যারপরনাই ঠান্ডা বলিয়া বোধ হইতেছে (প্রতিক্রিয়া, গৌণ ক্রিয়া)। যে বাহুকে অনেকক্ষণ ধরিয়া খুব শীতল জলে ডুবাইয়া রাখা হইয়াছেতাহা প্রথমে অধিকতর ফ্যাকাসে ও শীতল বলিয়া বোধ হয় (মুখ্য ক্রিয়া) কিন্তু ঠান্ডা জল হইতে সরাইয়া লইয়া জল মুছে ফেলিলে তাহা পরে অন্য বাহু অপেক্ষা অধিকতর উষ্ণই শুধু হয় না বরং উত্তপ্ত, লাল ও প্রদাহান্বিত হইয়া উঠে (গৌণ ক্রিয়া, জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়া) । কড়া কফি পান করিলে অত্যাধিক স্ফুর্তি আসে (মুখ্য ক্রিয়া), কিন্তু পরে আলস্য ও তন্দ্রালুতা অনেকক্ষণ ধরিয়া বিদ্যমান থাকে (প্রতিক্রিয়া, গৌণ ক্রিয়া) যদি না আবার নতুন করিয়া কফি পান করিয়া তাহা (ক্ষণিকের জন্য) তারাইয়া দেওয়া হয় (উপশমকারী) । আফিম সেবনজনিত জড়বৎ অঘোর নিদ্রার (মুখ্য ক্রিয়া) পরে পরবর্তী রাত্রে আসে অধিকতর নিদ্রাহীনতা (প্রতিক্রিয়া, গৌণ ক্রিয়া) । আফিম সেবনজনিত কোষ্ঠবদ্ধতা পরে (মুখ্য বা প্রাথমিক ক্রিয়া) উদারাময় আসে (গৌণ ক্রিয়া), আর অন্ত্রের উত্তেজনাজনক জোলাপ দিয়া কোষ্ঠবদ্ধতা দূর করিয়া পরে (মুখ্য বা প্রাথমিক ক্রিয়া) কয়েকদিনব্যাপী কোষ্ঠবদ্ধতা শুরু হয় (গৌণ ক্রিয়া )। এইরূপ সব সময়ই ঘটে, সুস্থ দেহে অধিক মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগের ফলে স্বাস্থ্যে গুরুতর পরিবর্তন আসার পরে যদি তাহার ঠিক বিপরীত অবস্থা থাকে, যেরূপ আলোচিত হইয়াছে, তাহা জীবনীশক্তি কর্তৃক গৌন ক্রিয়ার ভিতর দিয়ে প্রতিফলিত হয়।

🎴সূত্রঃ ৬৬। হোমিও ঔষধে স্বাস্থ্যের পরিপন্থী কোন ক্রিয়া সৃষ্টি হয় না-

সুস্থ দেহের উপর বিশৃঙ্খলা উৎপাদনকারী কোন ঔষধের অতি ক্ষুদ্র হোমিওপ্যাথিক মাত্রায় ক্রিয়ার একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া খুব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হইবে বলিয়া ধারণা হতে পারে, কিন্তু তাহা হয় না। প্রত্যেকটি ঔষধের ক্ষুদ্রমাত্রা নিশ্চিতভাবে যে প্রাথমিক ক্রিয়া উৎপাদন করে তাহা খুব মনোযোগী পর্যবেক্ষকের কাছে ধরা পড়ে বটে কিন্তু জীবন্তদেহ স্বাভাবিক অবস্থা পুনরানয়নের জন্য যতটুকু প্রতিক্রিয়া (গৌণ ক্রিয়া) প্রয়োজন ততটুকুই মাত্র প্রয়োগ করিয়া থাকে।

🎴সূত্রঃ ৬৭। হোমিও চিকিৎসার কল্যাণকর দিক ও বিসদৃশ চিকিৎসার অকল্যাণকর দিক-

এই অখন্ডনীয় সত্যসমূহ—যাহা প্রকৃত জগতে ও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে স্বতই আমাদের চোখে পড়ে—-একদিকে যেমন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উপকারিতা আমাদের নিকট প্রমাণ করেছে, তেমনি অপরদিকে বিরুদ্ধ ক্রিয়াশীল ঔষধ প্রয়োগে অ্যান্টিপ্যাথিক ও উপশমকারী চিকিৎসার ফল ঘোষণা করিতেছে ।

🎴সূত্রঃ ৬৮। রোগারোগ্যের জন্য হোমিওপ্যাথিক ঔষধের স্বল্পমাত্রায় যথেষ্ট-

হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য বিধানে অভিজ্ঞতা আমাদিগকে এই শিক্ষা দেয় যে, লক্ষণের সাদৃশ্যহেতু জীবনীশক্তির ক্ষেত্র হইতে সদৃশ প্রাকৃতিক ব্যাধিকে পরাভূত ও দূরীভূত করিতে এই পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ওষুধের অসাধারণ ক্ষুদ্র মাত্রায় যথেষ্ট। ব্যাধি বিনষ্ট হওয়ার পরে দেহের ভিতরে প্রথমে ঔষধজনিত পীড়া কিছু পরিমাণে অবশিষ্ট থাকে বটে কিন্তু ওষুধের অত্যন্ত স্বল্প মাত্রা প্রয়োগহেতু সেই পীড়া এত ক্ষণস্থায়ী, এত তুচ্ছ এবং তাহা আপনি এত শীঘ্র মিলাইয়া যায় যে স্বাস্থ্য পুনরানয়নের জন্য যতটুকু যথেষ্ট তাহার বেশি প্রতিক্রিয়া এই নগন্য কৃত্রিম পীড়ার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করিবার প্রয়োজন হয় না অর্থাৎ সেটুকু প্রতিক্রিয়া যেটুকু সম্পূর্ণ আরোগ্যবিধানের পক্ষে যথেষ্ট, এবং পূর্বেকার ব্যাধি দূরীভূত হওয়ার পরে তাহা অল্পই প্রয়োজন হয় ।

🎴সূত্রঃ ৬৯। বিসদৃশ ঔষধের কর্মকৌশল ও অপকারিতা-

অ্যান্টিপ্যাথিক (ক্ষণিক উপশমদায়ী) চিকিৎসাপদ্ধতিতে কিন্তু ঠিক ইহার বিপরীত ঘটে। চিকিৎসক কর্তৃক রোগলক্ষণের বিরুদ্ধে ঔষধলক্ষণের প্রয়োগকে (যেমন তীব্র বেদনায় আফিমের মুখ্য ক্রিয়ার ফলে অসাড়তা ও বোধশক্তিহীনতা) একেবারে সম্বন্ধবিহীন কিংবা সম্পূর্ণ বিভিন্ন জাতীয় সম্বন্ধেবিশিষ্ট বলা যায় না । রোগলক্ষণের সহিত ঔষধ লক্ষণ স্পষ্টই একটা সম্বন্ধ সূত্রে আবদ্ধ, কিন্তু যাহা হওয়া উচিত ইহা তাঁহার বিপরীত । এই প্রণালীতে ইহাই অভিপ্রেত যে ঔষুধের বিপরীত লক্ষণদ্বারা রোগলক্ষণ বিনষ্ট হইবে, কিন্তু তাহা কখনই সম্ভবপর নহে । তবে ইহা নিঃসন্দেহে যে, সদৃশ ব্যাধি সৃষ্টি করে বলিয়া হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রোগের যে স্থানে গিয়ে লাগে, বিপরীত পদ্ধতি মতে নির্বাচিত ঔষধ ও ঠিক সেই স্থানে গিয়ে স্পর্শ করে। কিন্তু শেষোক্ত পদ্ধতিতে ঔষধ লক্ষণ হালকাভাবে রোগের বিপরীত লক্ষণের নিকট পৌঁছিয়া তাহাকে জীবনীশক্তির অনুভূতির ক্ষেত্র হইতে কেবল কিছুক্ষণের জন্য সরাইয়া দেয়। সেজন্য বিপরীতধর্মী উপশমদায়ক ঔষুধের ক্রিয়ার প্রথম ভাগে জীবনীশক্তি ঔষধ কিংবা পীড়া এই উভয়ের কোনটির দরুন অস্বস্তিবোধ করে না, মনে হয় যেন তারা পরস্পরকে সূক্ষ্মভাবে প্রশমিত করিয়া ফেলিয়াছে (যেমন, যন্ত্রণার ক্ষেত্রে অসাড়তা উৎপাদক আফিমের ক্রিয়া)। প্রথম কয়েক মুহূর্ত জীবনীশক্তি বেশ সুস্থ অনুভব করে, আফিমের অবসাদ কিংবা ব্যাধির যন্ত্রণা কিছুই অনুভব করে না।

কিন্তু বিপরীতধর্মী ঔষধের লক্ষণ (হোমিওপ্যাথির মতে ) জীবনীশক্তির অনুভূতির দিক দিয়া সদৃশ অথচ বলবত্তর কৃত্রিম ব্যাধির মতো দেহের পীড়িত স্থানটিকে অধিকার করিতে পারে না এবং সেইজন্য হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মত সদৃশ কৃত্রিম ব্যাধি সৃষ্টি করিয়া জীবনীশক্তিকে এরূপভাবে আক্রমণ করতে পারে না যাহাতে তাহা ঠিক প্রাকৃতিক ব্যাধির স্থানটিতে গিয়া প্রবেশলাভ করিতে পারে। ক্ষণিক উপশমদায়ী ঔষধ ব্যাধি হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং তাহার বিপরীত বলিয়া ব্যাধিকে নির্মূল করিতে অক্ষম। যেমন পূর্বে বলা হইয়াছে সূক্ষ্মভাবে পরস্পরের প্রশমন ঘটিয়াছে এইরূপ প্রতীয়মান হওয়ায় প্রথমে জীবনীশক্তি কিছুই অনুভব করিতে পারেনা, কিন্তু প্রত্যেকটি ঔষধিজাত ব্যাধির মতো ইহাও ( এন্টিপ্যাথিক ঔষধ ) আপনাআপনি অন্তর্হিত হইয়া গেলে পড়িয়া থাকে শুধু ব্যাধি- যেমন পূর্বে ছিল। শুধু তাহাই নহে, ও ঔষধ ( যেমন অন্যান্য উপশম দায়ী ঔষধ রোগ সারাবার জন্য বৃহৎ মাত্রায় দেওয়া হয়) তাহার বিপরীত অবস্থা আনয়নের জন্য ( ৬৩,৬৪ সূত্র) জীবনীশক্তিকে বাধ্য করে অর্থাৎ সেই অবস্থা ঔষুধের ক্রিয়ার বিপরীত এবং সেইজন্য তাহা তখনও বিদ্যমান অবিনষ্ট প্রাকৃতিক পীড়ার অনুরূপ। জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়ার ফলে শেষোক্ত পীড়ার সহিত তাহা যুক্ত হইয়া স্বভাবতই পীড়াকে আরো বাড়াইয়া শক্তিশালী করিয়া তোলে। ক্ষণিক উপশমের কাল কাটিয়া গেলে রোগলক্ষণটি ( ব্যাধির একটি অংশ মাত্র) আনুষঙ্গিকভাবে আরো বাড়িয়া যায় এবং এই বৃদ্ধি উপশমদায়ী ঔষধের মাত্রার পরিমাণের অনুপাতে হয়। অতএব (পূর্বোক্ত দৃষ্টান্ত অনুসারে ) যন্ত্রণার উপশমের জন্য আফিমের মাত্রা যত বাড়ান হইবে আফিমের ক্রিয়া চলিয়া গেলেই সেই পরিমাণে পূর্বের যন্ত্রণাকে অতিক্রম করিয়া যন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইবে।

🎴সূত্রঃ ৭০। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সারমর্ম-

পূর্বে যাহা বলা হইয়াছে তাহা হইতে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি যে, রোগ বলিতে চিকিৎসক যাহা কিছু বুঝেন এবং সেজন্য আরোগ্যবিধান প্রয়োজন তাহা রোগীর যন্ত্রণা এবং তাহার স্বাস্থ্যের বোধগম্য পরিবর্তনের মাধ্যমে, এককথায় লক্ষণসমষ্টির ভিতর দিয়া প্রকাশিত হয়। এই লক্ষণসমষ্টির দ্বারা রোগী রোগমুক্তির জন্য উপযুক্ত ঔষধের দাবি জানায়। অপরপক্ষে ইহাকে নির্দেশ করিয়া যাহা কিছু আভ্যন্তরীণ কারণ আরোপ করা হয়, যাহা কিছু রোগ উৎপাদনকারী দুর্জ্ঞেয় বস্তুর কল্পনা করা হয় তাহা অলীক স্বপ্ন ভিন্ন কিছুই নহে। এই যে দৈহিক অসুস্থতা যাহাকে আমরা ব্যাধি বলি ওষুধ প্রয়োগ দ্বারা তাহাকে কেবল আরেকটি আবর্তন এর ভিতর দিয়া স্বাস্থ্যে ফিরাইয়া আনা সম্ভব। সেই ওষুধের আরোগ্যদায়িনী শক্তি শুধু নির্ভর করে মানুষের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন সাধন অর্থাৎ রোগলক্ষণ উৎপাদন করিবার বিশিষ্ট ক্ষমতার উপর এবং তাহা খুব স্পষ্ট ও বিশুদ্ধভাবে জানা যায় ঔষধসমূহের সুস্থ শরীরে পরীক্ষা করিয়া। সকল অভিজ্ঞতা ইহাই শিক্ষা দেয় যে কোন প্রাকৃতিক ব্যাধি কখনোই সেই ওষুধ দ্বারা নিরাময় হয় না, যাহা সুস্থ শরীরে পরীক্ষায় যে রোগ সারাতে হইবে তাহা হইতে ভিন্ন একটা বিসদৃশ রোগ উৎপন্ন করে (অতএব এলোপ্যাথি মতে কখনোই নহে )। এমনকি প্রাকৃত জগতেও এরূপ আরোগ্যবিধান কখনই দেখা যায় না যাহাতে কোন আভ্যন্তরীণ ব্যাধি অন্য একটি বিসদৃশ রোগ সংযোগে- তাহা যতই হোক না- দূরীভূত, বিনষ্ট এবং আরোগ্যপ্রাপ্ত হয়। বরং সকল অভিজ্ঞতা হইতে এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সুস্থ দেহের উপর পরীক্ষার ফলে ঔষধের যেসকল লক্ষণ পাওয়া যায় তাহা রোগের বিপরীত একটিকেই উদ্দেশ্য করিয়া প্রয়োগ করা হলে দীর্ঘস্থায়ী রোগকে কখনো দূরীভূত করা যায় না। তাহাতে কেবল সাময়িক উপশম হয় মাত্র, কিন্তু পরে আবার রোগের বৃদ্ধি ঘটে। এক কথায় বলা যায়, এই প্রকার সাময়িক উপশমদায়ী এনটিবেটিক চিকিৎসা দীর্ঘস্থায়ী গুরুতর রোগের আরোগ্য বিধানে একেবারেই নিষ্ফল।

অতএব, তৃতীয় এবং কেবলমাত্র অন্যতম সম্ভাব্য চিকিৎসাপদ্ধতিকে (হোমিওপ্যাথিক)– যাহাতে কোন প্রাকৃতিক ব্যাধির লক্ষণসমষ্টিকে উদ্দেশ্য করিয়া সুস্থ দেহের উপর অনুরূপ লক্ষণ উৎপাদনকারী ঔষধ উপযুক্ত মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়- বলা যায় একমাত্র ফলদায়ক আরোগ্যপন্থা। তাহার দ্বারা জীবনীশক্তির পীড়াদায়ক সূক্ষ্ম শক্তিবিশিষ্ট ব্যাধিসমূহ সম্পূর্ণরূপে ও স্থায়ীভাবে নিঃশেষিত ও তিরোহিত হইয়া যায়। বলবত্তর সদৃশলক্ষণবিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিক ওষুধই জীবনীশক্তির অনুভূতি ক্ষেত্রে এইরূপ ক্রিয়া আনয়ন করিতে সমর্থ। মুক্ত প্রকৃতির নিকট হইতে আমরা এই পদ্ধতির উদাহরণ পাইতে পারি যেমন, যখন একটি পুরাতন ব্যাধির সহিত একটি নতুন সদৃশ ব্যাধির সংযোগ ঘটে তখন নতুন ব্যাধিটি দ্রুত এবং চিরকালের জন্য বিনষ্ট হইয়া আরোগ্য প্রদান করেন।

(১৩) রোগ সমীক্ষা (সূত্র-৭১-৮২)

🎴সূত্রঃ ৭১। আরোগ্যের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি বিষয়-

এ বিষয়ে যখন কোন সন্দেহ নাই যে মানুষের পীড়া বলিতে কেবল কতগুলি লক্ষণকে বুঝায় এবং সেগুলিকে সদৃশ কৃত্রিম লক্ষণ উৎপাদনকারী ঔষধ এর সাহায্যে বিনষ্ট করিয়া স্বাস্থ্য ফিরাইয়া আনা যায় (প্রকৃত আরোগ্য বিধানের ইহাই পদ্ধতি), তখন আরোগ্যবিধান প্রণালীকে নিম্নলিখিত তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়-

১) আরোগ্য বিধান করিবার জন্য কি জানা আবশ্যক তাহা চিকিৎসক কি রূপে নির্ধারণ করিবেন?

২) প্রাকৃতিক ব্যাধিকে নিরাময় করিবার জন্য উপকরণসমূহের অর্থাৎ ঔষধের রোগ উৎপাদনকারী ক্ষমতা সম্বন্ধে কিভাবে জ্ঞানলাভ করা যায়?

৩) প্রাকৃতিক ব্যাধিসমূহকে দূর করিবার জন্য সেই সকল কৃত্রিম রোগ উৎপাদক বস্তুসমূহকে (ঔষধ) প্রয়োগ করিবার সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত পদ্ধতি কি?

🎴সূত্রঃ ৭২। রোগ দুই প্রকার ( অচির রোগ ও চির রোগ)-

অনুসন্ধানের প্রথম বিষয়টি সম্বন্ধে সাধারণভাবে নিম্নলিখিত প্রাথমিক আলোচনা করা যাইতেছে । মানুষ যেসব রোগে ভোগে সেইগুলি হয় অস্বাভাবিক বিশৃংখলাগ্রস্থ জীবনীশক্তির অসুস্থতাব্যঞ্জক দ্রুত প্রণালী- যাহার ভোগকাল কমবেশি অল্প সময়ের মধ্যে, কিন্তু সবসময়ই নিয়মিত সময়ের মধ্যে শেষ হওয়ার প্রবণতা দেখা যায় এবং সেই গুলিকে বলা হয় অচিররোগ অথবা সেগুলি এরূপ প্রকৃতির যে সামান্যভাবে ও প্রায় অজ্ঞাতসারে সূচনা লইয়া সূক্ষ্মভাবে দেহযন্ত্রকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুসারে পীড়িত করে এবং ক্রমশ সুস্থ অবস্থা হইতে তাহাকে এইরূপভাবে বিচ্যুত করে যে, স্বয়ংক্রিয় জীবনীশক্তি- যাহার কাজ হইল স্বাস্থ্য বজায় রাখা- কেবল প্রথম এবং বিকশিত অবস্থায় সেগুলিকে অসম্পূর্ণ ও অযোগ্যভাবে ব্যর্থ প্রতিরোধ দিলেও নিজের চেষ্টায় তাহাদের ধ্বংসসাধন করিতে অসমর্থ হয় এবং অসহায়ভাবে তাহাদিগকে বর্ধিত হইতে দিয়া নিজেকে- যতদিন মৃত্যু না ঘটে- অধিকতর পীড়িত হইতে দিতে বাধ্য হয়। এই সকল পীড়াকে বলা হয় চিররোগ। তাহাদের উৎপত্তি ঘটে কোন চিররোগবীজের সূক্ষ্ম সংক্রমণ দ্বারা।

🎴সূত্রঃ ৭৩। অচির রোগের প্রকারভেদ-

অচিররোগসমূহ সম্বন্ধে বলা যায়, উহাএই ধরনের যে ব্যক্তিগতভাবে তাহা মানব কে আক্রমণ করে এবং তাহাদের উদ্দীপক কারণসমূহ হইল পারিপার্শ্বিক ক্ষতিকর প্রভাব। অতিভোজন কিংবা অতিস্বল্পাহার দেহের উপর যথেচ্ছাচার, ঠান্ডা লাগান, অত্যাধিক গরম লাগান, অসংযম, শুরু পরিশ্রম প্রভৃতি কিংবা দৈহিক উত্তেজনা, মানসিক উদ্বেগ বা ঐ প্রকার কোনকিছু অচির জ্বররোগসমূহের উদ্দীপক কারণ। বাস্তবিকপক্ষে সেইগুলি কেবল অন্তর্নিহিত সোরার সাময়িক স্ফুরণ ছাড়া আর কিছুই নহে। সেই এচিররোগগুলিয়খুব ভীষণ প্রকৃতির না হইলে এবং সেই গুলিকে শীঘ্র দমন করা গেলে সোরা আবার তাহার সুপ্ত অবস্থায় ফিরে যায় । অথবা সেইগুলি (অচিররোগসমূহ) এইরূপ ধরনের যে কতকগুলি লোক আবহাওয়া অথবা পার্থিব কারনে ক্ষতিকর বস্তুসমূহ দ্বারা একই সময়ে এখানে সেখানে (বিক্ষিপ্তভাবে) আক্রান্ত হয় । সেগুলির দ্বারা পীড়িত হইবার প্রবণতা এককালে অল্প কয়েকটি লোকের মধ্যে দেখা যায় । এই প্রকার সমজাতীয় আরও কতকগুলি ব্যাধি আছে যাহাদের দ্বারা একই কারণে এবং ঠিক অনুরূপ পীড়ায় অনেক লোক আক্রান্ত হইয়া থাকে (মহামারীরূপে) । এই সকল ব্যাধি ঘনবসতিযুক্ত স্থানে দেখা দিলে সাধারণত তাহা সংক্রামকরূপ ধারণ করে। তাহার ফলে প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং একই কারণ হইতে উদ্ভূত বলিয়া সকল পীড়িত ব্যক্তির একই প্রকার উপসর্গ আনয়ন করে এবং অচিকিৎসিত অবস্থায় থাকিলে একটা নিয়মিত সময়ের মধ্যে হয় রোগীর মৃত্যু ঘটে নতুবা রোগ সরিয়া যায় । যুদ্ধ, জলপ্লাবন ও দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি সঙ্কট প্রায়ই তাহাদের উদ্দীপক কারণ এবং উৎপাদনের হেতু। কখনও কখনও সেইগুলি এক বিশেষ ধরনের অচির রোগবীজ যাহা একইভাবে বারবার ফিরে আসে (সেই জন্য বিশেষ পরিচিতি কোন নামে খ্যাত) । তদ্দ্বারা জীবনে একবার মাত্র আক্রান্ত হয়, যেমন বসন্ত, হাম, হুপিংকাশি, সিডেনহামের পুরাতন মসৃণ রক্তবর্ণ স্কর্লেটজ্বর মাম্পস প্রভৃতি ।

🎴সূত্রঃ ৭৪। এলোপ্যাথিক ঔষধ সঞ্জাত চিররোগ সর্বাপেক্ষা উৎকট ও শোচনীয়-

হায়! চিররোগসমূহের মধ্যে এমন কতকগুলি রোগকে গণ্য করিতে হয় যেগুলি সাধারণত দেখা যায় এবং যেগুলি দীর্ঘকাল ধরিয়া এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অধিক ও অধিকতর মাত্রায় প্রচন্ড ঔষধসকল ব্যবহারের ফলে উৎপন্ন হয়। ক্যালোমেল, করোসিভ সাবলিমেট, পারদঘটিত মলম, সিলভার নাইট্রেট, আয়োডিন এবং তাহার মলম, আফিম, ভ্যালেরিয়ান, সিঙ্কোনা ছাল এবং কুইনিন, ফক্সগ্লোভ, প্রুসিক অ্যাসিড, সালফার ও সালফিউরিক অ্যাসিড, নিত্য ব্যবহৃত বিরেচকসমূহ, শিরাকর্তন, রক্তমোক্ষণ, জোক লাগান, কৃত্তিম ক্ষত প্রভৃতি কুফলে ঐ প্রকার রোগের উৎপত্তি ঘটে এবং যার দ্বারা জীবনীশক্তিকে কখনও কখনও নির্দয়ভাবে বলহীন করা হইয়া থাকে এবং ইহা একেবারে অভিভূত না হইলে এরূপভাবে পীড়িত হইয়া পড়ে (প্রত্যেকটি পদার্থের বৈশিষ্ট্য অনুসারে) যে, ঐ সকল বিরুদ্ধ ও হানিকর আক্রমণ হইতে বাচার জন্য দেহাভ্যন্তরে অবশ্যই একটি বিদ্রোহের সৃষ্টি করে এবং হয়না কোন অংশ হইতে উত্তেজনা ও অনুভবশক্তি হরণ করে বা অতিমাত্রায় তাহা বর্ধিত করে, কোন অংশকে প্রসারিত বা সংকুচিত করে, শিথিল বা শক্ত করে, এমনকি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ও বাহিরে বা ভিতরে ত্রুটিপূর্ণ যান্ত্রিক পরিবর্তন আসে (দেহের বাহির ও ভিতর অকর্মণ্য করিয়া দেয়); আর তাহা করে ঐ সকল ধ্বংসাত্বক শক্তির নিত্য নব বিরুদ্ধ আক্রমণ দ্বারা সম্পূর্ণ বিনাশের কবল হইতে জীবনকে রক্ষা করিবার জন্য।

🎴সূত্রঃ ৭৫। অ্যালোপ্যাথির অনারোগ্যদায়ক প্রথায় (বিশেষ করে বর্তমান সময়ে) মানুষের স্বাস্থ্যের উপরে এইরূপ ক্রমাগত আক্রমণ সকল প্রকার রোগের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শোচনীয় ও অসাধ্য। দুঃখের সহিত আমি আরও বলি যে, তাহাদের খুব বাড়াবাড়ি অবস্থায় আরোগ্যবিধানকল্পে কোন ঔষধ নির্ধারণ বা নির্বাচন করা স্পষ্টত অসম্ভব।

🎴সূত্রঃ ৭৬। কেবলমাত্র প্রাকৃতিক রোগের জন্য দয়াময় ঈশ্বর হুমিওপেথির ভিতর দিয়া আরোগ্য বিধান করিয়াছেন। কিন্তু মানুষ্যদেহের বাহিরে ও ভিতরে বৎসরের পর বৎসর অবিরাম-ভাবে ঐ সকল ক্ষতিকর ঔষধ দিয়ে চিকিৎসার দ্বারা যে ধ্বংস ও বিকৃতি সাধিত হয় তাহার সহিত প্রতিকার জীবনে শক্তিকেই করিতে হইবে (ভিতরে যদি কোন চিররোগবীজ লুকাইয়া থাকে তাহা নির্মূল করবার জন্য যথোপযুক্ত সাহায্য দেওয়া প্রয়োজন) ইহা সম্ভব, যদি জীবনীশক্তি ঐরূপ ক্ষতিকর ক্রিয়ার পূর্ব হইতেই অত্যাধিক দুর্বল হইয়া না পড়িয়া থাকে এবং কতিপয় বৎসর অবাধে এই বৃহৎ কার্যকরী বার অবসর পায়। অনারোগ্য দায়ক এলোপ্যাথিক চিকিৎসা হইতে প্রায়শ উৎপন্ন ঐসকল অসংখ্য বিপর্যস্ত অবস্থাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরাইয়া আনার জন্য মানুষের আয়ত্তাধীন এ কোন চিকিৎসা নাই এবং থাকিতে পারে না।

🎴সূত্রঃ ৭৭। পরিহার্য দূষণীয় প্রভাবসমূহ এর অধীনে ক্রমাগত থাকিয়া লোকে যে রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহাকে অযথা চিররোগ আখ্যা দেয়া হয়। অনিষ্টকর মদ্যাদি বা খাদ্যে আসক্ত হইয়া, স্বাস্থ্যনাশকারী বিভিন্ন প্রকার অসংযত আচরণের লিপ্ত হইয়া, জীবনধারণের প্রয়োজনীয় বস্তু সমূহ হইতে সুদীর্ঘকাল বঞ্চিত থাকিয়া, অস্বাস্থ্যকর স্থানে বিশেষত জলাজমিতে, গুহা বা আবদ্ধ গৃহে বাস করিয়া, ব্যায়াম ও মুক্তবাতাস বর্জন করিয়া, শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের স্বাস্থ্য নষ্ট করিয়া, সর্বদা মানসিক দুশ্চিন্তায় কাটাইয়া এই প্রকার ব্যাধি উৎপন্ন হয়। যদি কোন চিররোগবীজ দেহের ভিতর লুকাইয়া না থাকে তাহা হইলে এই প্রকার স্বকৃত অসুস্থ অবস্থা, উন্নততর জীবনযাপন আরম্ভ করিলে, আপনাআপনি দূরীভূত হয় ও তজ্জন্য সেগুলিকে চিররোগ বলা যায় না।

🎴সূত্রঃ ৭৮। যথার্থ প্রাকৃতিক চিররোগ সেই গুলিকে বলা হয় যাহা কোন চিররোগবীজ হইতে উৎপন্ন এবং যাহা যথোপযুক্ত ঔষধ দিয়া না সরাইলে দৈহিক ও মানসিক সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা সত্ত্বেও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে থাকে এবং ক্রমাবনতির পথে চলে অধিকতর যন্ত্রণা দিয়া রোগীকে সারাজীবন কষ্ট দেয়। কচি কিৎসা হইতে উৎপন্ন পীড়াসমূহ (৭৪ সূত্র) বাদ দিলে এইগুলি সর্বাপেক্ষা অধিক ও মনুষ্যজাতির সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু। কেননা, বলিষ্ঠ দেহ, নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাপন ও জীবনীশক্তির সতেজ ক্রিয়াশীলতা তাহাদিগকে নির্মূল করতে অক্ষম।

🎴সূত্রঃ ৭৯। সিফিলিস ও সাইকোসিস প্রকৃত চিররোগবীজ-

এখন পর্যন্ত সিফিলিসকেই কিছুটা চিররোগবীজোৎপন্ন বলিয়া ধরা হইয়াছে, যাহা অচিকিৎসা অবস্থায় থাকলে জীবনের সমাপ্তির সঙ্গে শেষ হয়। অর্বুদযুক্ত সাইকোসিস ( প্রমেহ) ঠিক একইভাবে উপযুক্ত ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা ব্যতীত যাহাকে নির্মূল করা যায় না—-নিঃসন্দেহে চিররোগবীজজাত একটি বিশিষ্ট ব্যাধি হইলেও তাহা স্বীকৃত হয় নাই। চিকিৎসকগণ চর্মের উপরকার উদ্ভিদগুলি নষ্ট করিয়াই মনে করিতেন যে তাহারা আরোগ্যদান করিয়াছেন, কিন্তু রোগজনিত ঋতুদোষের একগুঁয়েমিতা তাহাদের দৃষ্টি এড়াইয়া যাইত।

🎴সূত্রঃ ৮০। সিফিলিটিক ও সাইকোটিক রোগ ব্যতীত সকল প্রকৃত চিররোগের জননী সোরা-

এইমাত্র যে দুইটি চিররোগবীজের কথা বলা হইল তাহা অপেক্ষা চিররোগে সোরাবীজের প্রাধান্য ও গুরুত্ব সহস্রগুণ বেশি। পূর্বোক্ত দুইটি তাহাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুসারে ধাতুদোষ প্রকাশ করে, একটি যৌনক্ষত দ্বারা, অন্যটি ফুলকপির ন্যায় অর্বুদ উৎপন্ন করিয়া। সোরাবীজও সমগ্র দেহে সংক্রামিত হওয়ার পরে এক প্রকার বিশেষ চর্মোদ্ভেদের ভিতর দিয়া আত্মপ্রকাশ করে। কখনও সেগুলি ফোস্কাজাতীয় এবং তাহার সঙ্গে থাকে আরামদায়ক সুড়সুড়িযুক্ত অসহ্য চুলকানি (এবং একপ্রকার বিশেষ গন্ধ )। এই ভয়ঙ্কর অভ্যন্তরীণ চিররোগবীজ সোরা বিভিন্ন প্রকার অগণিত পীড়ার একমাত্র প্রকৃত মূলকারণ এবং জনক। এই সকল রূপ রীতি সম্মত নিদানশাস্ত্রসমূহে স্নায়ুদৌর্বল্য, হিস্টিরিয়া, চিত্তোন্মাদ, পাগলামি, বিষণ্নতা, জড়বুদ্ধি, মৃগী ও নানাবিধ তড়কা, র্যাকাইটিস, মেরুদন্ড সংক্রান্ত রোগ, অস্থিক্ষত, ক্যান্সার, গেঁটেবাত, অর্শ, ন্যাবা, নীলরোগ , শোথ, রজঃরোধ, পাকস্থলী নাসিকা ফুসফুস মূত্রাশয় ও জরায়ু হইতে রক্তস্রাব, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্ষত, ধ্বজভঙ্গ ও বন্ধ্যাত্ব, আধকপালে, বধিরতা, ছানি অন্ধতা, মূত্রপাথরি, পক্ষাঘাত, ইন্দ্রিয়াদির অকর্মণ্যতা এবং সহস্র প্রকারের ব্যথা-বেদনা প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ স্বতন্ত্র রোগরূপে পরিচয় পাইয়াছে।

🎴সূত্রঃ ৮১। শতশত বংশপরস্পরায়, লক্ষলক্ষ মানবদেহের ভিতর দিয়া সঞ্চালিত হইয়া অতি প্রাচীন এই সংক্রামক রোগের এইভাবে বিশ্বাসাতীত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আমাদিগকে বুঝাইয়া দেয় মানুষ্য পরিবারের এখন তাহা কত অসংখ্য প্রকারের পীড়া সৃষ্টি করিয়াছেন; বিশেষত যখন আমরা চিন্তা করি, বংশগত ধাতুপ্রকৃতি সংবলিত মানবগোষ্ঠীর বর্ণনাতীত বৈচিত্র ছাড়াও কত বিভিন্ন অবস্থা এই প্রকার নানা চিররোগসমূহ ( সোরার গৌণ লক্ষণসমূহ) সৃষ্টি করার জন্য দায়ী। সুতরাং এইরূপ ক্ষতিকর বিভিন্ন কারণসমূহ সোরাবীজাক্রান্ত বিভিন্ন মানবদেহের উপর প্রকাশ করিয়া যদি অসংখ্য প্রকারের বিকৃতি, ক্ষতি, বিশৃংখলা ও যন্ত্রণা লইয়া আসে তাহা হইলে বিষ্মেয়ের কিছু নাই। পুরাতন নিদান গ্রন্থসমূহে এই সকলকে এযাবৎকাল বিশেষ বিশেষ নাম দিয়া প্রত্যেকটিকে স্বতন্ত্র ব্যাধি বলিয়া ধরা হয়েছে।

🎴সূত্রঃ ৮২। সোরাঘটিত চিররোগের ঔষধ নির্বাচন-

যদিও চিররোগসমূহের প্রধান উৎপত্তিস্থল নির্ণয় এবং সোরার চিকিৎসার জন্য অমোঘ হোমিওপ্যাথিক ঔষধসমুহ আবিষ্কারের সঙ্গে চিকিৎসা প্রণালী, চিকিৎসিতব্য অধিকাংশ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের সীমানার মধ্যে আসিয়া পৌঁছিয়াছে তবুও প্রত্যেকটি চিররোগে ( সোরাজাত ) আরোগ্যদান করিবার জন্য ঔষধ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে লক্ষণ ও বিশেষত্বগুলি সাবধানে সংগ্রহ করার কাজ উক্ত আবিষ্কারের পূর্বের ন্যায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের পক্ষে এখনো অপরিহার্য। কারণ, এই রোগ কিংবা অন্য রোগের প্রকৃত আরোগ্যবিধান যথানিয়মে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যক্তিগত বিশেষত্ব নির্ণায়ক চিকিৎসা ব্যতীত সম্ভব হয়না। এই অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে- রোগ কখনো অচির ও দ্রুতগতিতে বাড়িয়া উঠে এবং কখনো তাহা ধীর গতিতে চলিতে থাকে (চির)- এই পার্থক্য নির্ণয় করিতে হইবে। এরূপ দেখা যায় যে, অচির রোগে প্রধান লক্ষণসমূহ অপেক্ষাকৃত দ্রুত আমাদের কাছে ধরা দেয় এবং আমাদের অনুভবে আসে, সেইজন্য রোগের চিত্র অঙ্কন করিতে অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগে এবং সেইজন্য কয়েকটি অল্প প্রশ্ন করিলেই চলে কারণ সবটাই আপনা হইতেই প্রকাশমান । সেই তুলনায় চিররোগ কয়েক বৎসর ধরিয়া ক্রমবর্ধমানভাবে চলিতে থাকে বলিয়া লক্ষণসমূহ সংগ্রহ করা অধিকতর কষ্টসাধ্য।

🎴সূত্রঃ ৮৩। প্রত্যেকটি রোগীকে ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে এখানে আমি সাধারণ নির্দেশ দেব এবং তাহার প্রত্যেকটির সম্বন্ধে যাহা প্রাসঙ্গিক তাহাই মাত্র চিকিৎসকের স্বরণ রাখিতে হইবে। এইরূপ পরীক্ষাকার্যে চিকিৎসকের পক্ষে যাহা প্রয়োজন তাহা হইল পূর্বসংস্কার হইতে মুক্তি, ইন্দ্রিয় শক্তির অটুট কর্মপটুতা, মনোযোগের সহিত পর্যবেক্ষন এবং রোগচিত্র অংকনে বিশ্বস্ততা।

🎴সূত্রঃ ৮৪। রোগী তাহার পীড়ার ইতিহাস বর্ণনা করিবে, রোগীর কষ্ট সম্বন্ধে যাহা কিছু শুনিয়াছে তাহা রোগীর পরিচর্যাকারীগণ বলিবে, রোগী কিরূপ আচরণ করে এবং তাহারাই বা কি লক্ষ্য করিয়াছে তাহারা তাহাও বলিবে। চিকিৎসক নিজে দেখিবেন, শুনিবেন এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয় সাহায্যে রোগীর ভিতরে কোন পরিবর্তন বা অস্বাভাবিক যাহা কিছু আছে তাহা লক্ষ্য করিবেন। রোগী এবং তাহার বন্ধুগণ যেভাবে বলেন ঠিক সেইভাবে চিকিৎসক সেসকল লিখিয়া লইবেন। তিনি নিজে চুপ করিয়া থাকিয়া তাহাদের যাহা কিছু বলিবার আছে বলিতে দিবেন এবং বক্তব্য অন্য প্রসঙ্গে চলিয়া না গেলে কোনোরূপ বাঁধাই দেবেন না। যাহাতে বক্তাগনের বক্তব্যের প্রয়োজনীয় অংশগুলির লিখিয়া লইতে পারেন সেজন্য রোগীলিপি প্রস্তুত করিবার প্রারম্ভে ধীরে ধীরে বলিবার জন্য তিনি তাঁহাদিগকে উপদেশ দিবেন।

🎴সূত্রঃ ৮৫। রোগী কিংবা তাঁহার বন্ধুগণ কথিত প্রত্যেকটি নতুন নতুন অনুচ্ছেদ লিখিতে আরম্ভ করিবেন-

রোগী কিংবা তাঁহার বন্ধুগণ কথিত প্রত্যেকটি নূতন ঘটনা নূতন অনুচ্ছেদে লিখিতে আরম্ভ করিবেন। ইহাতে লক্ষণগুলি শ্রেণীবদ্ধভাবে একটির নিচে আর একটি আলাদা আলাদাভাবে সাজানো হইবে এবং প্রথমে অস্পষ্ট রূপে কিছু বলা হইয়া থাকিলে ও পরে তাহা আরও পূর্ণাঙ্গ করিয়া বলা হইলে তিনি সেইটির সহিত যোগ করিয়া লইবার সুবিধা পাইবেন।

🎴সূত্রঃ ৮৬। বর্ণনাকারীর স্বতঃস্ফূর্ত বক্তব্য শেষ হওবার পর চিকিৎসক প্রত্যেকটি বিশেষ লক্ষণের দিকে নজর দিবেন এবং সেই সম্বন্ধে আরও সঠিক বিবরণ জানিবার জন্য তাহাকে যেভাবে বলা হইয়াছে সেই ভাবে একটির পর একটি লক্ষণ পড়িয়া শুনাইবেন এবং প্রত্যেকটি সম্বন্ধে আরও বিশেষ তথ্য জানিবার জন্য প্রশ্ন করবেন; যেমন কোন সময়ে এই লক্ষণটি দেখা গিয়েছিল? রোগী এখন যে ঔষধ খাইতেছে তাহার পূর্বে কি এই লক্ষণ ছিল না? ঔষধ ব্যাবহারকালীন ইহা দেখা দিয়েছিল? অথবা ঔষধ বন্ধ করিবার কয়েকদিন পর দেখা দিয়েছে? কি ধরনের বেদনা, ঠিক কেমন বোধ হয়, তাহা কি এই স্থানেই হইয়াছিল? ঠিক কোন জায়গায় হইয়াছিল? যন্ত্রণায় কি আপনা আপনি যখন তখন হইত, না বিভিন্ন সময়ে? যন্ত্রণা কি সদা সর্বদা লাগিয়ে থাকিত? কতক্ষণ তাহা থাকিত?দিবারাত্রির কোন সময়ে এবং দেহের কি প্রকার অবস্থানে তাহা বাড়িত কিংবা সম্পূর্ণ কমিয়া যাইত? সাদা কথায় বলিতে গেলে বর্ণিত বিষয়ের সঠিক প্রকৃতি কিরূপ ছিল?

🎴সূত্রঃ ৮৭। এইরূপে চিকিৎসক প্রতিটি বৃত্তান্ত সঠিক জানতে পারেন কিন্তু তিনি মনে এমন কোন প্রশ্ন করিবেন না যাহা হইতে রোগী হ্যাঁ কিংবা না বলিয়া উত্তর দিবার কোন ইঙ্গিত পায়। তাহা হইলে রোগী আলস্য বা বিভ্রান্তিবশত কিংবা প্রশ্নকর্তাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য হাঁ কিংবা না বলিয়া অসত্য অর্ধসত্য কিংবা ঠিক সত্য নহে এমন কিছু বলিতে প্রবৃত্ত হইবেন। ইহাতে রোগের একটা মিথ্যা চিত্র অঙ্কিত ও অনুপযোগী চিকিৎসা হইবে ।

🎴সূত্রঃ ৮৮। এই সকল স্বেচ্ছাকৃত বর্ণনায় যদি দেহের ক্রিয়াগত কিংবা মানসিক কোন তথ্য বাদ পড়িয়া যায় তাহা হইলে সেই অংশ ও তাহার ক্রিয়া কিংবা মানসিক অবস্থা সম্বন্ধে আর কি বলার আছে তাহা চিকিৎসক জানিয়ে লইবেন। কিন্তু ইহা জানিয়া লইবার সময়ে তাহার প্রশ্ন হইবে সাধারণ ধরনের যাহাতে বর্ণনাকারী সে সম্বন্ধে বিশেষ বিবরণ দিতে বাধ্য হয়।

🎴সূত্রঃ ৮৯। যখন রোগী (ভান করা রোগের ক্ষেত্র ছাড়া অনুভূতির বিবরণের জন্য প্রধানত তাহারই উপর বিশ্বাস স্থাপন করিতে হয়) স্বতঃস্ফূর্ত বিবরণের মাধ্যমে এবং প্রশ্নের উত্তরে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করিয়া রোগের প্রায় যথাযথ একটা চিত্র অঙ্কিত করিয়াছে তখন চিকিৎসক ইচ্ছা করিলে এবং প্রয়োজন বোধ করলে (যদি তিনি মনে করেন যে তাহার প্রয়োজনীয় সকল তথ্য তখন ও পাওয়া যায় নাই ) আরও সঠিক, আর ও বিশেষ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।

🎴সূত্রঃ ৯০। এই সকল বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে চিকিৎসকের লেখা শেষ হইলে তিনি তখন নিজে রোগী সম্বন্ধে কি পর্যবেক্ষণ করেন তাহা লিপিবদ্ধ করিবেন এবং তাহার কতখানি রোগীর সুস্থ অবস্থায় ছিল তাহা নিরূপণ করবেন ।

🎴সূত্রঃ ৯১। পূর্বের ঔষধ ব্যবহারের সময় যে সকল লক্ষণ ও অনুভূতি প্রকাশ পাইয়াছিল তাহা হইতে রোগের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। অপরপক্ষে যে সকল লক্ষণ ও যন্ত্রণা ঔষধ ব্যাবহারের পূর্বে বা কিছুদিন ঔষধ ব্যবহার বন্ধ করিবার পরে দেখা গিয়েছিল তাহা হইতে রোগের আসল প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। এইগুলি চিকিৎসক বিশেষ করিয়া লিখিয়া লইবেন। রোগটি যদি চিররোগ জাতীয় হয় এবং চিকিৎসকের কাছে আসা পর্যন্ত রোগী যদি ঔষধ নয় এমন কিছু দিয়া কিছুদিন রাখিয়া তাহার পরে আরো সঠিকভাবে রোগ লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার সুবিধা জনক। তাহা হইলে, পুরাতন রোগের অবিমিশ্র স্থায়ী লক্ষণগুলি বিশুদ্ধ ভাবে বুঝা যাইবে এবং তদ্বারা রোগের যথার্থ চিত্র পাওয়া সম্ভব হইবে।

🎴সূত্রঃ ৯২। কিন্তু রোগ যদি দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে চলে এবং তাহার গুরুতর অবস্থার জন্য বিলম্ব করা নাচলে তাহা হইলে ঔষধ ব্যাবহারের পূর্বে কি লক্ষণ ছিল জানা সম্ভব না হইলেও ঔষধ জনিত রোগের বিকৃতি চিত্র লইয়াই চিকিৎসককে সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে। ইহা হইতে তিনি অত্যন্ত তখনকার মত রুপ চিত্র সম্বন্ধে একটা সমগ্র ধারণা করিয়া লইতে পারবেন অর্থাৎ ওষুধজ ও মূল রোগের মিশ্রিত একটি চিত্র, যাহা অনুপোযোগী ঔষধ ব্যবহারের ফলে উদ্ভূত এবং মূলরোগ হইতে অধিকতর গুরুত্ব ও সাংঘাতিক এবং সেইজন্য যাহার দ্রুত ও কার্যকরী সাহায্যের প্রয়োজন। এইরূপে তিনি সম্পূর্ণ চিত্র অংকন করিয়া সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দ্বারা ইহার প্রতিকার সাধনে সামর্থ্য হল। তাহার ফলে রোগী যে সকল ক্ষতিকর ঔষধ গলাধঃকরণ করিয়াছে তাহার কবলে তাহাকে আত্মসমর্পণ করতে হয় না।

🎴সূত্রঃ ৯৩। যদি অল্প দিনে কিংবা চিররোগের ক্ষেত্রে বহুকাল পূর্ব হইতে কোন সুনিশ্চিত কারণে রোগের আবির্ভাব ঘটিয়া থাকে তাহা হইলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিংবা সাবধানে প্রশ্ন করা হইলে তাহার উত্তরে তাহারা সে কথা উল্লেখ করিবে ।

🎴সূত্রঃ ৯৪। চিররোগসমূহের অবস্থাবিষয়ে অনুসন্ধান করার সময়ে রোগীর সাধারণ কাজকর্ম, তাহার স্বাভাবিক বসবাস ও খাদ্য , পারিবারিক অবস্থা সম্বন্ধে বিশেষ তথ্য ভালরূপে বিবেচনা করা ও তন্ন তন্ন করিয়া দেখা কর্তব্য। তদ্দ্বারা সেগুলির মধ্যে রোগের কি উৎপাদক বা পরিপোষক কারণ আছে জানা যাইবে এবং তাহা হইলে সেগুলির দূরীকরণ দ্বারা আরোগ্যের পথ সুগম হইবে।

🎴সূত্রঃ ৯৫। চিররোগ সম্বন্ধে উল্লেখিত লক্ষণসমূহ ও অন্যান্য বিষয় যতদূর সম্ভব যত্নসহকারে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে অনুধাবন করিতে হইবে এবং সূক্ষ্মতম বৈশিষ্ট্য গুলি লক্ষ্য করিতে হইবে। কেননা, সেইগুলো অচিররোগে না মিলিলেও সেই সকল পীড়ায় সর্বাধিক পরিচয় বহন করে এবং রোগনিরাময়ের পক্ষে সেগুলির আর প্রয়োজন নাই বলিয়া ছাড়িয়া দেওয়া কর্তব্য নহে। আরো কারণ হইল, দীর্ঘকাল ভুগিতে ভুগিতে রোগী এইরূপ অভ্যস্ত হইয়া পড়ে যে ছোটখাট আনুষঙ্গিক লক্ষণ তাহার গাসহ্য হইয়া যায়, অথচ সেগুলি অত্যন্ত মূল্যবান এবং ঔষধ নির্বাচনের পক্ষে প্রায়ই অত্যাবশ্যক। স্বাস্থ্যের মতো সেগুলিকেও রোগী তাহার অবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলিয়া ধরিয়া লয়, সেগুলির প্রকৃত অনুভূতি রোগী পনের কিংবা কুড়ি বছর ব্যাপী রোগ ভোগে ভুলিয়া যায়। রোগী বিশ্বাস করিতে পারেনা যে মূল ব্যাধির সহিত এই সকল আনুষঙ্গিক লক্ষণের এই সকল অধিক বা অল্প স্বাস্থ্যবিচ্যুতির কোন যোগ থাকিতে পারে।

🎴সূত্রঃ ৯৬। ইহা ছাড়া, রোগীদের প্রকৃতিতে এত পার্থক্য থাকে যে, কেহ কেহ বিশেষত তথাকথিত বিষাদগ্রস্ত, অত্যন্ত অসহিষ্ণুত এবং অধিক যন্ত্রণাকাতর রোগীরা নিজেদের লক্ষণাবলী অতিরঞ্জিত করিয়া বলে যাহাতে চিকিৎসক সেইসকল কষ্টের আরোগ্যবিধানে সচেষ্ট হন।

🎴সূত্রঃ ৯৭। অন্যেরা আবার ইহার বিপরীত চরিত্রের ।তাহারা হয়তো খানিকটা আলস্য, খানিকটা মিথ্যা বিনয় আর কিছুটা মৃদ প্রকৃতি বা মানসিক দুর্বলতার জন্য তাহাদের অনেক লক্ষণ ব্যক্ত করে না, অনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করে কিংবা কতকগুলিকে অনাবশ্যক বলিয়া নির্দেশ করে।

🎴সূত্রঃ ৯৮। একদিকে রোগী তাহার রোগচিত্র তুলিয়া ধরিবার জন্য যে সকল যন্ত্রণা ও অনুভূতির কথা বর্ণনা করে তাহা মনোযোগের সহিত আমাদের যেমন শোনা উচিত ও তাহার বক্তব্যে বিশ্বাস করা উচিত– কেননা তাহার বন্ধু ও পরিচর্যাকারীরা সাধারণত তাহার পরিবর্তিতরূপে ও ভুলভাবে বর্ণনা করিয়া থাকে— তেমনি অপরদিকে সকল পীড়া, বিশেষত চিররোগের প্রকৃত ও সম্পূর্ণ চিত্র ও তাহার বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজন বিশেষ পর্যবেক্ষণ, কৌশল, মানবপ্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান, অনুসন্ধান করার সময়ে সাবধানতা ও প্রচুর ধৈর্য।

🎴সূত্রঃ ৯৯। মোটের উপর অচিররোগ কিংবা যে রোগ অল্পদিন হইয়াছে তাহার সম্বন্ধে অনুসন্ধান চিকিৎসকের কাছে সর্বাপেক্ষা সহজ কারণ, স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ও তাহার বিচ্যুতিসম্বন্ধীয় সকল ব্যাপার অল্পদিনের বলিয়া তখন ও রোগীর ও তাহার বন্ধুদের মনে তাহা টাটকা থাকে এবং তখনও তাহা কৌতূহল ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলিয়া বোধ হয়। এই সকল ক্ষেত্রেও চিকিৎসকের সবকিছু জানা অপরিহার্য হইলেও জিজ্ঞাসা করিতে হয় অনেক কম। স্বতঃপ্রবৃত্তভাবেই সব কথা তাহাকে বলা হয়।

🎴সূত্রঃ ১০০। মহামারী ও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত রোগসমূহের লক্ষণ অনুসন্ধানকার্যে পৃথিবীতে সেই নামে কিংবা অন্য নামে আর কখনো সেইরূপ কিছু আসিয়াছে কিনা জানা সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। সেই জাতীয় রোগের নতুনত্ব বা বৈশিষ্ট্য রোগপরীক্ষায় কিংবা চিকিৎসায় কোন পার্থক্য আনে না।

🎴সূত্রঃ ১০১ । এইরূপ হওয়া স্বাভাবিক যে মহামারীর সময়ে প্রথম যে রোগীটি চিকিৎসকের নজরে আসে তাহাতে রোগের সমগ্র রূপ তখনই ধরা পড়ে না । কতকগুলি রোগীকে মনোযোগের সহিত পর্যবেক্ষণ করলে তবেই সমষ্টিগত সমগ্র লক্ষণের সহিত পরিচিত হওয়া যায়। অবশ্য গভীর মনোযোগী চিকিৎসক দুই একটি ক্ষেত্র প্রত্যক্ষ করিয়াও অনেক সময়ে প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে এরূপ জ্ঞান লাভ করিতে পারেন যে তাহার মনে একটা বিশিষ্ট চিত্র মুদ্রিত হইয়া যায় এবং তিনি সদৃশ লক্ষণযুক্ত একটি ঔষধ ও নির্বাচন করতে সমর্থ হন।

🎴সূত্রঃ ১০২। এই প্রকার রোগে বিভিন্ন রোগীর লক্ষণগুলি লিখিয়া লইতে লইতে রোগচিত্র সম্পূর্ণ হয়। তাহা শুধু সুদীর্ঘ কথাসর্বস্ব নহে, প্রকৃত পরিচয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং তাহাতে থাকে সমষ্টিগত রোগের অসাধারণ লক্ষণসমূহ। একদিকে যেমন তাতে সাধারণ লক্ষণ গুলি (যেমন, ক্ষুধাহীনতা, অনিদ্রা প্রভৃতি ) সম্বন্ধে বিশেষত্বপূর্ণ সঠিক বর্ণনা থাকে অপর দিকে তেমনি কতকগুলি বিশেষ লক্ষণ ও, যাহা সচরাচর দেখা যায় না এবং অল্প কয়েকটি রোগেই বিশেষভাবে পরিচিত (অন্তত একই সঙ্গে), পরিস্ফুট হইয়া উঠে এবং সেই রোগের চরিত্রগত লক্ষণ রূপে পরিগণিত হয়। কোন সময়ে কোন একটি মহামারী দ্বারা যাহারা আক্রান্ত হন তাহারা নিশ্চয়ই একই সূত্র হইতে সংক্রমিত হওয়ার ফলে একই পীড়ায় ভুগিয়া থাকেন । কিন্তু এইরূপ একটি মহামারীর সমগ্র প্রসার এবং তাহার লক্ষণসমষ্টি (যে পরিচয়লব্ধ জ্ঞান হইতে লক্ষণাবলীর জন্য সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন করা সম্ভব, সেই জ্ঞান রোগচিত্রের সমগ্র রূপ পর্যবেক্ষন দ্বারা পাওয়া যায়) একটি রোগীকে দেখিয়া জানা যায় না; তাহা বিভিন্ন ধাতু প্রকৃতিতে কতগুলি রোগীরা সমগ্রভাবে লক্ষ্য করিয়া জানা যায়।

(১৫) উপবিষ স্থায়ী রোগ (সূত্র-১০৩-১০৪)

🎴সূত্রঃ ১০৩। সাধারণত অস্থায়ী প্রকৃতির মহামারী সম্বন্ধে যে কথা এখানে বলা হইল আদি রোগবীজজনিত রোগ সম্বন্ধে— যেগুলি (বিশেষত সোরা) মূলে একই থাকে বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে -তাহাদের লক্ষণসমূহ আরও বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে হইবে। কারণ তাদের ক্ষেত্রেও একটি রোগীর মধ্যে আংশিক লক্ষণ পাওয়া যায়; দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং আরও অন্যান্য রোগীতে অন্য কতকগুলি লক্ষণ দেখা যায় এবং সেগুলি ও (বিশিষ্টভাবে) সমগ্র রোগের লক্ষণ সমষ্টির অংশ মাত্র। অতএব এইরূপ একটি চিররোগের বিশেষত সোরার লক্ষণবৈচিত্র পাওয়া সম্ভব কেবল ব্যক্তিগতভাবে অনেকগুলি চিররোগীকে পর্যবেক্ষণ করিয়া। এই প্রকার রোগ সমূহ কে সম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও তাদের সমষ্ঠিগত চিত্র ব্যতীত হোমিওপ্যাথি মতে সমগ্র ব্যাধিকে নিরাময় করিবার জন্য ঔষধ (যথা সোরাবিষঘ্ন) আবিষ্কার করা সম্ভব নহে । এইরূপ চিররোগাক্রান্ত অনেক রোগীর আবার এই সকল ওষুধই প্রকৃত মহৌষধ।

🎴সূত্রঃ ১০৪। রোগের বিশিষ্ট পরিচালক লক্ষণাবলী অথবা অন্য কথায় যে প্রকার রোগই হউক না তাহার সঠিকভাবে চিত্রাঙ্কন একবার হইয়া গেলে কার্যের সর্বাপেক্ষা কঠিন অংশ শেষ হয়। চিকিৎসা পরিচালনার জন্য রোগের চিত্রটি, বিশেষত চিররোগ হইলে তাহা চিকিৎসকের সম্মুখে সর্বদা থাকে। তিনি তখন রোগের সকল দিক অনুসন্ধান করিয়া বিশেষ লক্ষণগুলি বাছিয়া লইতে পারেন এবং সমগ্র রোগকে প্রতিরোধ করিবার জন্য বিশুদ্ধভাবে পরীক্ষিত ভেষজভান্ডার হইতে হোমিওপ্যাথিক ঔষধরূপ একটি সদৃশ কৃত্রিম রোগশক্তিকে নির্বাচিত করিয়া প্রয়োগ করিতে পারেন। চিকিৎসা চলিতে থাকা কালে ঔষধ কতটা কাজ করিল এবং ঔষধ দ্বারা রোগীর অবস্থার কতটা পরিবর্তন ঘটিয়াছে যখন তিনি নির্ধারণ করিতে চাহেন তখন আবার প্রথম রোগী দেখিবার সময় যে সকল লক্ষণ লিপিবদ্ধ করা হইয়াছিল তাহার মধ্যে হইতে যেগুলির উপশম হইয়াছে সেগুলিকে কাটিয়ে দিতে পারেন। তখন কি বাকি রহিল তাহা দেখা যাইবে এবং কোন নতুন লক্ষণ দেখা গেলে তাহা যোগ করিয়া লইতে হইবে।

(১৬) ভেষজ পরিচয় (সূত্র-১০৫-১১৪)

🎴সূত্রঃ ১০৫। প্রকৃত চিকিৎসকের প্রয়োজনীয় দ্বিতীয় বিষয় হইল প্রাকৃতিক ব্যাধির আরোগ্যসাধনের উপায়সমূহ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ ; ঔষধসমূহের রোগ উৎপাদনকারী ক্ষমতা সম্বন্ধে অনুসন্ধান। তদ্দ্বারা চিকিৎসাক্ষেত্রে তাহার মধ্য হইতে এমন একটি ঔষধ নির্বাচন করা সম্ভব হইবে যাহার লক্ষণসমষ্টির তালিকা হইতে যে প্রাকৃতিক ব্যাধিকে নিরাময় করিতে হইবে তাহার যতদূরসম্ভব সদৃশ একটি কৃত্রিম ব্যাধি সৃষ্টি করা যায়।

🎴সূত্রঃ ১০৬। নানা ওষুধের রোগ উৎপাদন করিবার ক্রিয়া সমগ্রভাবে অবশ্যই জানিতে হইবে । অর্থাৎ অধিকাংশ প্রাকৃতিক ব্যাধির জন্য তাহার মধ্য হইতে উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন করিয়া বাহির করিবার পূর্বে যতদূর সম্ভব তাহাদের প্রত্যেকটির কি ব্যাধিলক্ষণ প্রকাশ করিবার, বিশেষত সুস্থদেহে স্বাস্থ্যের কি পরিবর্তন সৃষ্টি করিবার শক্তি আছে, তাহা সমস্তই জানিয়া লইতে হইবে।

🎴সূত্রঃ ১০৭। ইহা নির্ধারণ করিতে যাইয়া ওষুধসমূহ যদি কেবল রুগ্ন ব্যক্তিদের উপর পৃথকভাবে একটি করিয়া ও প্রয়োগ করা হয় তাহা হইলে ও তাহাদের প্রকৃত ক্রিয়া সম্বন্ধে সঠিকভাবে কিছুই জানা যাইবে না। কারণ, ঔষধ প্রয়োগের ফলে স্বাস্থ্যের যে বিশেষ পরিবর্তন আশা করা যায় তাহা রোগ লক্ষণের সঙ্গে মিশিয়া যায় এবং সেই জন্য সুস্পষ্টভাবে সেইগুলি লক্ষ্য করা সম্ভব হয় না।

🎴সূত্রঃ ১০৮। অতএব, সুস্থ মানুষের উপর ছাড়া আর কোন উপায় ঔষধ সমূহের বিশেষ ক্রিয়া সঠিকভাবে জানা যাইতে পারে না । এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কতকগুলি ঔষধ পরিমিত মাত্রায় সুস্থ মানব দেহের উপর প্রয়োগ ও পরীক্ষা ছাড়া আর কোন নিশ্চিত স্বাভাবিক পন্থা নাই। তাহা হইলে, উহাদের প্রভাবে দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কি পরিবর্তন, কি লক্ষণ ও নিদর্শন প্রত্যেকটি দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হইল অর্থাৎ কি প্রকারের পীড়া উৎপন্ন করিবার ক্ষমতা ও প্রবণতা আছে তাহা জানা যাইবে। যেহেতু ইহা প্রমাণিত হইয়াছে (২৪-২৭) যে, ঔষধ সমূহের রোগ আরোগ্যকারী ক্ষমতা তাহাদের মানবদেহের সুস্থ অবস্থাকে পরিবর্তিত করিবার ক্ষমতা মধ্যেই নিহিত আছে এবং তাহার পর্যবেক্ষণের ভিতর দিয়াই আরোগ্যকারী ঔষধের ক্ষমতার প্রকাশ জানা যায়।

🎴সূত্রঃ ১০৯। আমিই সর্বপ্রথমে এই পথ উন্মুক্ত করিয়াছি এবং তাহা এইরূপ অধ্যাবসায়ের সহিত অনুসরণ করিয়াছি যাহা মানুষের কল্যাণময় সেই মহান সত্যের উপর সুদৃঢ় প্রত্যয় হইতে উথিতএবং তাহার পরিপুষ্ট। সেই প্রত্যয় হইল, একমাত্র হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ দ্বারাই মানুষের ব্যাধিসমূহের সুনিশ্চিত আরোগ্য সম্ভব।

🎴সূত্রঃ ১১০ । আমি আর ও দেখিয়াছি যে ভুলবশত অধিকমাত্রায়, আত্মহত্যা বা অপরকে হত্যা করিবার জন্য কিংবা অন্য কোন অবস্থায় ভেষজদ্রব্যসমূহ সুস্থ মানুষের পাকস্থলীতে যাওয়ার ফলে যে সকল লক্ষণ পূর্ববর্তী গ্রন্থকারগণ পর্যবেক্ষণ করিয়াছেন তাহা, সেই একই ভেষজ দ্রব্য আমার এবং অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের উপর পরীক্ষার ফলে যাহা পর্যবেক্ষণ করা গিয়াছে, বেশ মিলিয়া যায়।যাহাতে অন্য কেহ ব্যবহার না করে প্রধানত সেই কারণে ঐ সকল গ্রন্থকার শক্তিশালী ভেষজসমূহের বিষক্রিয়া যেরূপ ঘটিয়াছিল তাহার ইতিবৃত্ত এবং তাহাদের ক্ষতিকর ক্রিয়া প্রামাণ্যভাবে বিকৃত করিয়াছেন।

🎴সূত্রঃ ১১১। ভেষজের বিশুদ্ধ ক্রিয়া সম্বন্ধে আমার পর্যবেক্ষণের সহিত প্রাচীন অভিজ্ঞতার— যদিও তাহা আরোগ্য বিজ্ঞান উপলক্ষ্যে লিপিবদ্ধ করা হয় নাই— যে মিল এবং এই সকল বিবরণের সহিত অন্যান্য লেখকদের একই প্রকারের যে মিল তাহা আমাদের কাছে সহজেই প্রতিপন্ন করে যে ভেষজ পদার্থসমূহ সুস্থ দেহে যে বিকৃতি সাধন করে প্রকৃতির ধ্রুব ও চিরন্তন নিয়ম অনুসারে এবং সেই নিয়মের বশবর্তিহইয়া নিজ নিজ প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে সুনিশ্চিত, নির্ভরযোগ্য ব্যাধিলক্ষণসমূহ উৎপন্ন করতে সমর্থ হয়।

🎴সূত্রঃ ১১২। পুরাতন ব্যবস্থাপত্র সমূহে ঔষধ সমূহের অত্যন্ত অধিক মাত্রার প্রায়ই ভয়ঙ্কর কুফলগুলির মধ্যে আমরা এমন কতকগুলি অবস্থা দেখিতে পায় যেগুলি প্রথম দিকে আবির্ভূত হয় নাই, কিন্তু বিষাদময় পরিণামের শেষের দিকে আসিয়াছে এবং ইহা প্রথমে আসা অবস্থা ঠিক বিপরীত। এই সকল লক্ষণ হইল প্রাথমিক ক্রিয়া (৬০ সূত্র) বা জীবনীশক্তির উপর ঔষধের এর যথার্থ ক্রিয়ার ঠিক বিপরীত অর্থাৎ দেহস্হিত জীবনেশক্তির প্রতিক্রিয়া (৬২-৬৭) । সুস্থ দেহের উপর পরিমিত মাত্রায় পরীক্ষণ হইলে কিন্তু ইহা দেখা যায় না বললেই হয়, অল্প মাত্রায় একেবারেই দেখা যায় না। হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য বিধানে জীবন্ত শরীরে ঔষধ দ্বারা সেইটুকু মাত্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় যে টুকু তৎকালীন স্বাভাবিক সুস্থ অবস্থায় উন্নীত করিবার জন্য প্রয়োজন হয়।

🎴সূত্রঃ ১১৩। ইহার একমাত্র ব্যতিক্রম হইল অবসাদ ঔষধসমুহ । কারণ, তাহারা প্রাথমিক ক্রিয়ার কখনও কখনও চেতনা ও অনুভূতি, কখন ও উত্তেজনা হরণ করিয়া লয়। এমনকি, সুস্থদেহে পরীক্ষণহেতু পরিমিত মাত্রা প্রয়োগেও তাহাদের গৌণ ক্রিয়ার ঘটে অধিকতার অনুভূতিপ্রবণতা (এবং অধিকতর উত্তেজনা) ।

🎴সূত্রঃ ১১৪। এই সকল অবসাদ দ্রব্য ব্যতীত সুস্থ শরীরে পরিমিত মাত্রায় ঔষধের পরীক্ষণে আমরা কেবল দেখিতে পাই তাহাদের প্রাথমিক ক্রিয়া, অর্থাৎ সেই সকল লক্ষণ যাহার ঔষধ মানুষের স্বাস্থ্যের বিশৃঙ্খলা সূচনা করে এবং দেহে দীর্ঘ বা অল্পকালস্থায়ী এক পীড়াবস্তা প্রবর্তন করে।

(১৭) ঔষধের পর্যায়ক্রমিক ক্রিয়া (সূত্র-১১৫)

🎴সূত্রঃ ১১৫। কতকগুলি ঔষধের ক্ষেত্রে এই সকল লক্ষণের মধ্যে এমন অনেকগুলি দেখা যায় যেগুলি আংশিকভাবে বা কোনো বিশেষ অবস্থায় যে সকল লক্ষণ পূর্বে বা পরে আবির্ভূত হইয়াছে ঠিক তাহার বিপরীত, কিন্তু সেইজন্য সেগুলিকে প্রকৃত গৌণ ক্রিয়া বা জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়া মাত্র বলিয়া গণ্য করা উচিত নহে । সেইগুলি হইল প্রাথমিক ক্রিয়ারই অন্তর্গত বিভিন্ন প্রকোল্পের পর্যায়ক্রমিক অবস্থা । তাহাদিগকে পরিবর্তী ক্রিয়া (alternating action) বলা হয় ।

(১৮) লক্ষণ বিকাশে বিভিন্নতা ও ধাতুবৈশিষ্ট্যতা (সূত্র-১১৬-১১৯)

🎴সূত্রঃ ১১৬। ঔষধ দ্বারা কতকগুলি লক্ষণ ঘন ঘন অর্থাৎ বহু লোকের মধ্যে প্রকাশিত হয়, অন্য কতকগুলি লক্ষণ অপেক্ষাকৃত বিরলভাবে কিংবা অল্প কয়টি লোকের মধ্যে, আবার কয়েকটি লক্ষণ কেবলমাত্র খুব অল্প কয়টি সুস্থ দেহে দেখা যায়।

🎴সূত্রঃ ১১৭। তথাকথিত ধাতু প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য (idiosyncracies) শেষোক্ত শ্রেণীর অন্তর্গত। ইহার অর্থ হইল, দেহের কতকগুলি বিশেষ ধাতু যাহা অন্যভাবে সুস্থ হইলে ও কতগুলি দ্রব্য দ্বারা তাহাদের অল্পাধিক পীড়িত হইবার প্রবণতা তাহাতে দেখা যায়।অথচ সেই সকল দ্রব্য ওপর অনেক লোকের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব বিস্তার করে না বা কোন পরিবর্তন আনে না । কিন্তু প্রত্যেককে প্রভাবিত করিবার এই যে অক্ষমতা তাহা কেবল আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান ।যেহেতু মানুষের সুস্থ দেহে এই সকল ও অন্যান্য পীড়ার লক্ষণ উৎপাদন করিতে দুইটি বিষয়ের প্রয়োজন, প্রভাবক পদার্থের সহজাত ক্ষমতা এবং দেহের চৈতন্যদায়িনী জীবনীশক্তির ইহার দ্বারা প্রভাবিত হইবার প্রবণতা সেইহেতু, তথাকথিত ধাতুপ্রকৃতিবিশিষ্ট লোকের স্বাস্থ্যের সুস্পষ্ট শৃংখলার কারণকে শুধুমাত্র তাহাদের গঠন বৈশিষ্ট্যের উপর ন্যস্ত করা যায় না; সেই সকল পীড়া উৎপাদনকারী পদার্থসমূহও— তাহাদের মধ্যে সমস্ত মানবদেহেই একই প্রকার প্রভাব বিস্তার করিবার ক্ষমতা নিহিত আছে, অথচ তাহা এইরূপ যে অতি অল্প কয়েকটি সুস্থ দেহের তাহাদের দ্বারা পীড়িত হইবার প্রবণতা দেখা যায়—সে জন্য দায়ী। এই সকল পদার্থ যে প্রকৃতই প্রত্যেকটি সুস্থ ব্যক্তির উপর ক্রিয়াশীল তাহা ইহা হইতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে,ঔষধ রূপে তাহা যখন ব্যবহৃত হয় তখন তাহারা হোমিওপ্যাথি মতে সকল অসুস্থ ব্যক্তিরই সেই সকল পীড়ালক্ষণ বিষয়ে উপকার সাধন করে যেগুলি তথাকথিত ধাতুপ্রকৃতি গ্রস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতীয়মান লক্ষণসমূহের সদৃশ।

🎴সূত্রঃ ১১৮। ঔষধ ভেদে লক্ষণের বিভিন্নতা দৃষ্ট হয়-

প্রত্যেকটি ঔষধ মনুষ্যদেহের উপর বিশেষ ক্রিয়া প্রদর্শন করে—অন্যজাতীয় ভেষজপদার্থ দ্বারা ঠিক একই প্রকারে প্রকাশিত হয় না।

🎴সূত্রঃ ১১৯। দুইটি ভিন্ন ভেষজ একজাতীয় লক্ষণ প্রকাশ করিতে পারেনা-

প্রত্যেক শ্রেণীর উদ্ভিদ যেমন বাহ্যিক আকারে জীবনধারণ পদ্ধতিতে বৃদ্ধির দিক হইতে স্বাদে-গন্ধে অন্য শ্রেণীর প্রত্যেকটি উদ্ভিদ হইতে স্বতন্ত্র, প্রত্যেকটি খনিজ ও লবণ জাতীয় পদার্থ যেমন বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীক প্রকৃতিতে ও রাসায়নিক গুণাবলীতে অন্য জাতীয় খনিজ ও লবণ জাতীয় পদার্থ হইতে নিশ্চিত ভাবেই পৃথক, ঠিক তেমনভাবে তাহারা রোগ সৃষ্টিকারী শক্তি এবং আরোগ্যকারী শক্তিতেও নিশ্চিতভাবেই পরস্পর সম্পূর্ণ পৃথক ও বিপরীত। এই সমস্ত দ্রব্য অদ্ভূত, পৃথক এবং সুনির্দিষ্ট ধারায় মানবস্বাস্থ্য পরিবর্তন করিতে সমর্থ। কাজেই ইহাদের একটিকে অন্যটির সহিত ভুল করিবার বা মিশ্রিত করিবার কোনো সম্ভাবনা থাকেনা।

(১৯) ভেষজ পরীক্ষা (সূত্র-১২০-১২৫)

🎴সূত্রঃ ১২০। ভেষজের অভ্রান্ত গুনাগুন নির্ণয় করিতে হইলে সুস্থদেহে ইহার পরীক্ষা প্রয়োজন-

অতএব, যে ঔষধের উপর মানুষের জীবন, মৃত্যু, পীড়া ও স্বাস্থ্য নির্ভর করে তাহা সম্পূর্ণভাবে ও সর্বাধিক সাবধানের সহিত চিনিয়া লইতে হইবে এবং এই উদ্দেশ্যে সুস্থ দেহের উপর সযত্ন ও বিশুদ্ধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা তাহাদের ক্ষমতা ও প্রকৃত ক্রিয়া নির্ধারণ করিতে হইবে যাহাতে তাহাদের সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান লাভ করা যায় এবং পীড়ায় তাহাদের প্রয়োগ সম্বন্ধে কোন ভুল না হয়। কারণ, কেবল তাহাদের সঠিক নির্বাচন দ্বারাই সর্বোত্তম পার্থিব সূখস্বরূপ দেহ ও মনের স্বাস্থ্য দ্রুত ও স্থায়ীভাবে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।

🎴১২১। ঔষধের তীব্রতাভেদে ইহাদের বিভাগ ও প্রূভারের বিভিন্নতা-

স্বাস্থ্য বিপর্যয় ক্ষমতার উপর নির্ভর করিয়া ঔষধকে প্রধানতঃ তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- উগ্রবীর্য পদার্থ, মৃদুবীর্য পদার্থ এবং অতি লঘুবীর্য পদার্থ। সুস্থ মানবদেহের উপর ঔষধ এর ফলাফল পরীক্ষা করিবার সময় মনে রাখিতে হইবে যে, উগ্রবীর্য পদার্থগুলি অতি অল্প মাত্রায় প্রয়োগ করলেও বলিষ্ঠ গঠন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটাতে পারে। মৃদুবীর্য পদার্থগুলি স্থল মাত্রায় প্রয়োগ করা দরকার, নতুবা হয়তোবা লক্ষণসমূহ প্রকাশ করিতে অসমর্থ হইতে পারে। অতি লঘুবীর্য পদার্থগুলি নীরোগ অথচ দুর্বল, উত্তেজনাপ্রবণ ও অনুভূতিশীল ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করিতে হইবে। নতুবা স্থুল মাত্রায় হয়তোবা ইহার নিজস্ব লক্ষণ প্রকাশ করিতে অপারগ হইতে পারে।

🎴সূত্রঃ ১২২। সুপরিচিত, বিশুদ্ধ, অকৃত্রিম ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে নিশ্চিত ভেষজ পদার্থ সুস্থদেহে প্রয়োগ করা উচিত-

এই সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষায়—যাহার উপর সমগ্র চিকিৎসা কলার যথার্থ এবং ভাবী মানুশ্য সমাজের কল্যাণ নির্ভর করে—-সম্পূর্ণ সুপরিচিতএবং যাদের বিশুদ্ধতা, ও কৃত্তিমতা ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে আমরা সম্পূর্ণভাবে সুনিশ্চিত এইরূপ ঔষধ ব্যতিরেকে অন্য কোন ঔষধ প্রয়োগ করা উচিত নহে।

🎴সূত্রঃ ১২৩। পরীক্ষার জন্য ঔষধ প্রস্তুত পদ্ধতি-

এই সকল ঔষধের প্রত্যেকটিকে সম্পূর্ণ ও অবিমিশ্র ও অবিকৃত অবস্থায় গ্রহণ করিতে হইবে, দেশীয় গাছ গাছরা হইতে রস টাটকা নিংড়াইয়া লইয়া ও নষ্ট হইয়া যায় সেজন্য তাহার সহিত একটু সুরাসার মিশাইয়া, বিদেশি উদ্ভিজ্জাদি চূর্ণ আকারে বা তাহাদের টাটকা অবস্থায় থাকাকালে সুরাসার সহযোগে নির্যাস টিংচার প্রস্তুত করিয়া এবং পরে নির্দিষ্ট অনুপাতে জল মিশাইয়া এবং লবণ ও আঠাজাতীয় ভেষজকে ব্যবহার করিবার ঠিক পূর্বে জলে গুলিতে হইবে। উদ্ভিদকে যদি কেবল শুষ্ক আবহাওয়ায় সংগ্রহ করা সম্ভব হয় এবং তাহার কার্যকরী শক্তি স্বভাবতই যদি কম হয় তাহা হইলে তাহা ছোট ছোট টুকরা করিয়া কাটিয়া লইয়া ভেষজ অংশ বাহির করিয়া লইবার জন্য তাহার উপর গরম জল ঢালিয়া নির্যাস প্রস্তুত করিয়া লইতে হইবে এবং প্রস্তুত হইবামাত্র গরম থাকিতে থাকিতে খাইতে হইবে, যেহেত নিংড়ানো সকল উদ্ভিজ্জরস এবং সকল জলীয় নির্যাস সুরাসার মিশ্রিত না থাকিলে দ্রুত গুজিয়া উঠে ও পচিয়া যায় এবং তার ফলে তাহাদের সকল ভৈষজ্য গুণ নষ্ট হইয়া যায়।

🎴সূত্রঃ ১২৪। প্রয়োগকৃত ভেষজ বিশুদ্ধ ও একক হইতে হইবে-

এই সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রত্যেকটি ভেষজ পদার্থ সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে এবং বিশুদ্ধ অবস্থায় বাহিরের আর কিছু না মিশাইয়া প্রয়োগ করিতে হইবে।সেই দিন, কিংবা পরবর্তী কিছুদিন বরং ওষুধের গুনাগুন পর্যবেক্ষণের সময়ের মধ্যে ঔষধ জাতীয় আর কিছু গ্রহণ করার চলিবে না।

🎴সূত্রঃ ১২৫। পরীক্ষাকারী বা প্রুভারের খাদ্য ও পানীয় নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত নিয়মাবলী-

যতদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলিবে ততদিন পথ্যকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে। উহা যথাসম্ভব মসলা বর্জিত, কেবল পুষ্টিকর ও সাদা-সিদা ধরনের হওয়া উচিত । কাঁচা তরিতরকারি, মূল, সবরকম স্যালাড ও শাকাদির ঝোল ( যাহা খুব সাবধানতার সহিত তৈয়ারি হইলেও তাহাতে গোলযোগকারি কিছু ভেষজগুণ বর্তমান থাকে) বর্জন করা উচিত । যে সকল পানীয় সর্বদা ব্যবহার করা হয় তাহা যতদূর সম্ভব কম উত্তেজক হওয়া উচিত।

(২০) ঔষধ পরীক্ষার নিয়ম-পদ্ধতী (সূত্র-১২৬-১৪২)

🎴সূত্রঃ ১২৬। ভেষজ পরীক্ষক বা প্রুভারকে বিশ্বস্ত বুদ্ধিমান ও অনুভূতি প্রবণ হইতে হইবে-

যাহার উপর ওষুধের পরীক্ষণ হইবে তাহা কে অবশ্যই বিশ্বাস ভাজন ও বিবেকবান হইতে হইবে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়ে ও দেহের সকল প্রকার অতিরিক্ত পরিশ্রম, সকল প্রকার অমিতাচার ও বিরক্তিকর কামুকতা তাহাকে পরিহার করিয়া চলিতে হইবে । চিত্তচঞ্চলকারী জরুরি কাজের কোন আকর্ষণ তাহার থাকিবে না, সযত্ন আত্মসমীক্ষায় নিজেকে নিবিষ্ট রাখিতে হইবে এবং এইরূপ থাকাকালে কোনমতেই অস্থির হওয়া চলিবে না । তাহার পক্ষে যাহা সুব্যবস্থা সেই অবস্থায় তাহার দেহকে রাখিতে হইবে এবং সঠিকভাবে তাহার অনুভূতি সকল প্রকাশ ও বর্ণনা করিতে পারার মতো তাহার যথেষ্ট পরিমাণে বুদ্ধি থাকা প্রয়োজন।

🎴সূত্রঃ ১২৭। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের উপরই ভেষজ প্রয়োগ করিতে হইবে-

ঔষধ সমুহ পুরুষ ও স্ত্রী উভয় ক্ষেত্রেই পরীক্ষা করিতে হইবে যাহাতে জননেন্দ্রিয় সংক্রান্ত স্বাস্থ্যের পরিবর্তনসমূহ পরিজ্ঞাত হওয়া যায় ।

🎴সূত্রঃ ১২৮। খুব সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণের ফলে লক্ষ্য করা গিয়েছে যে, গুনাগুন পরীক্ষার জন্য ভেষজ পদার্থকে অবস্থায় পরীক্ষণ করা হইলে, তাহাদের অন্তনির্হিত পূর্ণশক্তির বিকাশ প্রায় দেখা যায় না । সেই শক্তি পূর্ণভাবে পরিস্ফুট হয় যখন সেগুলিকে যথাযথভাবে চূর্ণ করিয়া ও ঝাকি দিয়ে উচ্চ শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। স্হূল অবস্থায় যে শক্তি তাহাদের মধ্যে সুপ্তপ্রায় থাকে এই রূপ সহজ উপায় দ্বারা তাহা অবিশ্বাস্য পরিমাণে বর্ধিত হয় এবং ক্রিয়াশীল হইয়া উঠে। যে সকল দ্রব্য অত্যন্ত মৃদু প্রকৃতির বলিয়া ধারণা আছে সেগুলির ও ভেষজ শক্তি এখন নির্ধারণ করার পক্ষে এইটি সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা বলিয়া আমরা মনে করি। যে প্রণালী আমরা অবলম্বন করি তাহাতে খালি পেটে পরীক্ষণ কারীকে প্রত্যহ পশুদের ত্রিশক্তির চারিটি হইতে ছয়টি ছোট বড়ি জলে ভিজাইয়া অল্পাধিক জলে উত্তমরূপে মিশাইয়া দেওয়া হয় এবং কয়েক দিন ধরিয়া এইরূপ ব্যবস্থা চালানো হয় ।

🎴সূত্রঃ ১২৯ । এই মাত্রায় ফল যদি কম হইতে দেখা যায় তাহা হইলে প্রত্যহ আরও কয়েকটি বড়ি ব্যবহার করা যাইতে পারে যে পর্যন্ত না তারা আরো পরিস্ফুট ও জোরালো হয় এবং স্বাস্থ্যের পরিবর্তন আর ও সুস্পষ্ট হয়; কারণ সকল লোক একটি ঔষধ দ্বারা সমান ভাবে প্রভাবিত হয় না, বরং এই বিষয়ে অনেক বিভিন্নতা দেখা যায়। সেই জন্য শক্তিশালী বলিয়া পরিচিত ঔষধের মাত্রা দুর্বল বলিয়া প্রতীয়মান ব্যক্তির উপর কখনও কখনও আদৌ প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায় না; অথচ অপেক্ষাকৃত মৃদু ধরনের ঔষধ দ্বারা সেই ব্যক্তি অত্যন্ত প্রবল ভাবে আক্রান্ত হয়। অপরপক্ষে আবার বেশ বলিষ্ঠ লোকেরা মৃদু বলিয়া প্রতীয়মান ঔষধ দ্বারা অত্যাধিক প্রভাবিত হইয়া পড়ে এবং কড়া প্রকৃতির ঔষধে সামান্য লক্ষণ মাত্র প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে যখন পূর্ব হইতে কিছু জানা যায় না তখন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ঔষধের অল্পমাত্রায় লইয়া আরম্ভ করা সঙ্গত এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দিনে দিনে মাত্রা বাড়ানো যাইতে পারে ।

🎴সূত্রঃ ১৩০। শুরুতেই প্রথম মাত্রার পরিমাণ যদি অনেক বেশী হইয়া যায় তাহা হইলে এই সুবিধা হয় যে, পরীক্ষণকারী লক্ষণগুলির ক্রম বুঝিতে পারে এবং কোন সময়ে প্রত্যেকটির আবির্ভাব ঘটিয়াছে তাহা ঠিক ঠিক লিখিয়া রাখিতে পারে।ঔষধ এর স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভের পক্ষে অত্যাবশ্যক কারণ, তাহা হইলে প্রাথমিক ক্রিয়ার ও পর্যায়গত ক্রিয়ার ক্রম একেবারে নিঃসংশয়ভাবে লক্ষ্য করা যায়। অত্যন্ত পরিমিত মাত্রা দ্বারা ও এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলিতে পারে যদি পরীক্ষাকারীর যথেষ্ট পরিমাণে সূক্ষ্ম অনুভবশক্তি থাকে এবং সে যদি তাহার অনুভূতিসমূহের প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী হয়। ঔষধের ক্রিয়ার ভোগকাল কেবলমাত্র কতকগুলি পরীক্ষার ফল তুলনা করিয়া নির্ধারণ করা সম্ভব

🎴সূত্রঃ ১৩১। কিন্তু যদি কোন কিছু নির্ধারণের জন্য একে ঔষধ ক্রমবর্ধমান মাত্রায় পরপর কয়েকদিন একই লক্ষ্যে দেওয়া হয় তাহা হইলে তদ্দ্বারা সাধারণভাবে ওষুধজনিত পীড়ার বিভিন্ন অবস্থা নিঃসন্দেহে জানিতে পারি, কিন্তু সেগুলি পর পর কিভাবে আসিল তাহা জানিতে পারি না। আর পরবর্তী মাত্রা আরোগ্যকারী রূপে প্রায়ই পূর্ব মাত্রাজনিত একটি না একটি লক্ষণকে দূরীভূত করে কিংবা তাহার পরিবর্তে একটি বিপরীত অবস্থা সৃষ্টি করে। এই রূপ উৎপন্ন লক্ষণ সংশয়মূলক বলিয়া সেগুলিকে বন্ধনীর মধ্যে লেখা উচিত—যে পর্যন্ত না পরবর্তী আর ও বিশুদ্ধ পরীক্ষা দ্বারা নির্ধারিত হয় যে সেগুলি দেহের প্রতিক্রিয়ার (গৌণক্রিয়া) লক্ষণ বা ওষুধজনিত পরিবর্তী ক্রিয়ালক্ষণ ।

🎴সূত্রঃ ১৩২। কিন্তু যখন লক্ষণের পর্যায়ক্রমিক সম্বন্ধে এবং ঔষধের ভোগকালবিষয় লক্ষ নারাখিয়া কেবলমাত্র লক্ষণগুলি নির্ধারণ করা উদ্দেশ্য হয় ( বিশেষ করে মৃদু প্রকৃতির ঔষধের), তখন শ্রেয় পন্থা হইল পরপর কয়েকদিন ধরিয়া মাত্রা বৃদ্ধি করিয়া ঔষধ দেওয়া । এইভাবে অপরিচিত অথচ মৃদুতম ঔষধ এর ক্রিয়া ও প্রকাশিত হইয়া পড়িবে বিশেষতঃ যদি তারা অনুভূতিশীল ব্যক্তির উপর পরীক্ষিত হয়।

🎴সূত্রঃ ১৩৩। ঔষধ জনিত কোন বিশেষ অনুভূতি বা লক্ষণ উপস্থিত হইলে উহার সঠিক পরিচয় পাইবার জন্য বিভিন্ন অবস্থায় অবস্থান করিয়া, আক্রান্ত অঙ্গ সঞ্চালন করিয়া, ঘরের মধ্যে বা মুক্ত বাতাসে হাঁটিয়া, দাঁড়াইয়া, শুইয়া উহা বাড়ে, কমে বা দূরীভূত হয় তাহা পর্যবেক্ষণ করা শুধু উচিত নয় প্রয়োজন ও বটে। যে অবস্থায় লক্ষণটি প্রথম দেখা গিয়েছিল সেই অবস্থা পুনরায় গ্রহণ করিলে লক্ষণ আবার ফিরিয়া আসে কিনা, পানভোজনে, অন্য কোন অবস্থায়, কথা বলায়, কাশিবার হাঁচিবার সময়ে বা দেহের অন্য কোন ক্রিয়ায় লক্ষণটির কোন পরিবর্তন দেখা যায় কিনা তাহা লক্ষ্য করিতে হইবে, আর সেইসঙ্গে ইহা ও জানিতে হইবে যে দিন বা রাত্রির কোন সময়ে তাহা সর্বাপেক্ষা প্রকাশমান হয় । এতদ্বারা প্রত্যেকটি লক্ষণের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির পরিচয় পাওয়া যাইবে ।

🎴সূত্রঃ ১৩৪। বাহ্য প্রভাবসমূহের, বিশেষ করিয়া ভেষজের এরূপ শক্তি আছে, যদ্দারা জীবদেহের স্বাস্থ্যেএকপ্রকার বিশেষ পরিবর্তন উৎপন্ন হইতে পারে এবং তাহা তাহাদেরই নিজস্ব প্রকৃতি অনুসারে । কিন্তু কোন ভেষজের নিজস্ব প্রকৃতিগিত সকল লক্ষণ একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে, একই সঙ্গে, কিংবা একই পরীক্ষাকালে আবির্ভূত হয় না। পরন্তু, কতকগুলি লক্ষণ কাহারো ক্ষেত্রে প্রধানত একবারে আবার কারো ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরীক্ষা কালে আসিয়া উপস্থিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে ওপর এমন কতকগুলি লক্ষণ দেখা যায়, যাহার মধ্যে কিছু হয়তো, চতুর্থ, অষ্টম বা ব্যক্তির মধ্যে প্রকাশ পাইয়াছে যাহা আবার পূর্বেই দ্বিতীয়, ষষ্ঠ বা নবম ব্যক্তির মধ্যে দেখা গিয়েছে এবং একইভাবে চলিতে থাকে। উপরন্ত সেইগুলির একই সময়ে আবির্ভাব নাও ঘটতে পারে।

🎴সূত্রঃ ১৩৫। কেবল বিভিন্ন ধাতুবিশিষ্ট স্ত্রী-পুরুষের উপযুক্ত ক্ষেত্রে বহু পর্যবেক্ষণ দ্বারা কোন ভেষজসৃষ্ট ব্যাধির সমগ্র প্রকাশকে সম্পূর্ণ করিয়া তোলা যায়। রোগ উৎপাদনকারী ক্ষমতা অর্থাৎ স্বাস্থ্যকে পরিবর্তন করিবার যথার্থ শক্তি সম্বন্ধে কোন ভেষজ সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষিত হইয়াছে বলিয়া আমরা তখনই নিশ্চিত হইতে পারি যখন পরবর্তী পরীক্ষাকগণ তাহার ক্রিয়া হইতে আর বিশেষ নূতন কিছুই না এবং প্রায় সকল লক্ষণ এ দেখিতে পান যেগুলি পূর্ববর্তী পর্যবেক্ষণ করিয়াছেন।

🎴সূত্রঃ ১৩৬। যেমন পূর্বে বলা হইয়াছে, একটি ভেষজকে সুস্থ দেহে পরীক্ষণ করা হইলে কোন একটি ক্ষেত্রে যে সকল পরিবর্তন আনয়ন করিতে সমর্থ যদিও তাহার সকল গুলি উৎপাদন করিতে পারে না এবং দৈহিক ও মানসিক ধাতু প্রকৃতির তারতম্য অনুসারে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ইহা প্রয়োগ করা হয়লেই কেবল ইহা সম্ভব হয়, তথাপি প্রকৃতির এক শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় নিয়ম অনুসারে প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষেত্রে সকল লক্ষণ উৎপন্ন করিবার প্রবণতা সেই ভেষজের মধ্যে বিদ্যমান থাকে (সূত্র১১৭) । সেই প্রবনতার জন্য তাহার সকল গুণ—-এমন কি, যেগুলি সুস্থ শরীরে কদাচিৎ প্রকাশ পায়—তাহা সদৃশ লক্ষণ অনুসারে প্রয়োগ করা হইলে প্রত্যেকটি পীড়িত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। তাহা তখন হোমিওপ্যাথি মতে নির্বাচিত বলিয়া ক্ষুদ্রতম মাত্রাতে ও রোগীর রোগীর ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক পীড়ার খুব সদৃশ একটি কৃত্রিম অবস্থার সৃষ্টি করে—যাহা দ্রুত ও স্থায়ীভাবে রোগমুক্ত করিয়া তাহাকে আরোগ্য প্রদান করে।

🎴সূত্রঃ ১৩৭। পর্যবেক্ষণের সুবিধার জন্য যদি আমরা এমন একজনকে নির্বাচিত করি যে সত্যপ্রিয়, সর্বপ্রকারে সংযমী, সুক্ষ্ম বোধশক্তিসম্পন্ন এবং যিনি তাঁহার অনুভূতি সম্পর্কে একান্ত মনোযোগী তাহা হইলে কতকটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ঔষধের মাত্রা যত বেশি পড়িবে ততই তাহার প্রাথমিক লক্ষণ গুলি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠিবে এবং জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়া বা গৌনক্রিয়ার সহিত মিশ্রিত না হইয়া সর্বাপেক্ষা জ্ঞাতব্য কেবলমাত্র সেই সকল লক্ষণই আবির্ভূত হইতে থাকিবে। কিন্তু যখন অপরিমিত বৃহৎ মাত্রা ব্যবহার করা হয়, তখন লক্ষণ গুলির মধ্যে কতকগুলি গৌণ ক্রিয়ার ফল ও যে শুধু থাকিবে তাহাই নহে, প্রাথমিক ক্রিয়া ও এত তাড়াহুড়ো ও ব্যস্ত ভাবে আসিয়া উপস্থিত হইবে যে, কিছুই সঠিকভাবে তখন লক্ষ্য করা সম্ভব হইবে না। ইহার সঙ্গে বিপদের সম্ভাবনা জড়িত আছে তাহা ছাড়িয়ে দিলেও যাহার কিছুমাত্র মানবতাবোধ আছে এবং যে মানুষকে ও ভ্রাতৃজ্ঞানে দেখিয়ে থাকে, সে কখনো তাহা অপেক্ষার বিষয় বলিয়া মনে করিবে না।

🎴সূত্রঃ ১৩৮। ঔষধের ক্রিয়াকালে পরীক্ষণকারীর সকল অসুস্থ, আকস্মিক ঘটনা ও স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ( অবশ্য যদি উত্তম ও বিশুদ্ধ পরীক্ষণ এর জন্য ১২৪-১২৭) সূত্রে উদ্বৃত শর্তগুলি মানিয়ে চলা হয়) কেবলমাত্র ঔষধ হইতে উদ্ভূত এবং তাহা ওষুধেরই বিশেষত্ব বলিয়া গণ্য করিতে ও লিপিবদ্ধ করিতে হইবে। যদি পরীক্ষণ কারীর একই প্রকার ঘটনা বহুকাল পূর্বে ও হইয়া থাকে তাহা হইলে ও সেগুলিকে ঔষধেরই লক্ষণ লক্ষণ বলিয়া ধরিতে হইবে। ঔষধের পরীক্ষণ কালে সেগুলির পুনরাবির্ভাব ইহাই নির্দেশ করে যে, সেই ব্যক্তির বিশেষ ধাতু প্রকৃতির জন্য ওই প্রকার লক্ষণের প্রবণতা হইয়াছে। এই ক্ষেত্রে তাহা ঔষধেরই ক্রিয়া । যতদিন স্বাস্থ্যের উপর ঔষুধের মেয়াদ চলিতে থাকে লক্ষণসমূহ আপনা হইতেই উদ্ভূত হয় না, ঔষধ দ্বারাই উৎপন্ন হয় ।

🎴সূত্রঃ ১৩৯। চিকিৎসক নিজের উপর ঔষুধের পরীক্ষণ না করিয়া যদি অন্য কাহারও উপর করেন, তাহা হইলে সেই ব্যক্তি তাহার নিজের অনুভূতি, অসুস্থতাবোধ, আকস্মিক ঘটনা এবং স্বাস্থ্যের পরিবর্তন সম্বন্ধে যেরূপ অভিজ্ঞতা হয় তাহা স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করিবে । ঔষধ সেবনের কত পরে লক্ষণ এর আবির্ভাব ঘটিল এবং তাহা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে তাহার ভোগকালও উল্লেখ করিতে হইবে। পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র চিকিৎসক সেই বিবরণ পরীক্ষা কারীর উপস্থিতিতে দেখিয়ে লইবেন বা পরীক্ষণ যদি কয়েকদিন ধরিয়া চলে তবে তিনি প্রত্যেহ এরূপ করিবেন। প্রত্যেকটি বিষয় টাটকা মনে করার সময়েই তাহার ঠিক প্রকৃতি জিজ্ঞাসা করিয়া লইতে হইবে এবং এই ভাবে প্রাপ্ত খুঁটিনাটি সঠিক বিবরণ লিখিয়া লইতে হইবে অথবা পরীক্ষাকারী যেভাবে চাহে সেইভাবে অদলবদল করিতে লইতে হইবে।

🎴সূত্রঃ ১৪০। যদি সেই ব্যক্তি লিখিতে না পারে তাহা হইলে প্রত্যহ কি ঘটিয়েছে ও কিভাবে ঘটিয়াছে তাহা চিকিৎসককে জানাইতে হইবে। এই বিষয়ে যাহা বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া লিখিতে হইবে তাহা প্রধানত পরীক্ষণকারীর স্বতঃপ্রবৃত্ত বিবরণ হওয়া উচিত, তাহাতে অনুমাননির্ভর কিছুই থাকিবে না এবং কোন প্রশ্ন সোজাভাবে করা হইলে তাহার উত্তর যত কম সম্ভব তাহাতে স্থান পাইবে। দ্রষ্টব্য বিষয়ের অনুসন্ধান এবং প্রাকৃতিক রোগের চিত্রাঙ্গনের জন্য যে সকল সাবধানতার উপদেশ (সূত্র ৮৪-৯৯) আমি বিবৃত করিয়াছে তাহার সকল কিছুই সেই প্রকার সাবধানতার সহিতই নির্ধারণ করিতে হইবে ।

🎴সূত্রঃ ১৪১। সাধারণ ওষুধের বিশুদ্ধ ক্রিয়া দ্বারা মানুষের স্বাস্থ্যের উপর কি পরিবর্তন আসতে পারে এবং তদ্বারা সুস্থ দেহে কি প্রকার কৃত্তিম ব্যাধি ও লক্ষণসমূহ উৎপন্ন হইতে পারে তাহার সর্বোত্তম পরীক্ষণ সম্ভব যদি তাহা স্বাস্থ্যবান, সংস্কারমুক্ত এবং অনুভূতিপ্রবণ চিকিৎসক, এখানে যে সকল যত্ন ও সাবধানতা কথা বলা হইয়াছে উহা মানিয়া, নিজের উপর করেন। নিজের দেহে যাহা-কিছু তিনি প্রত্যক্ষ করেন তাহা তিনি অত্যন্ত সুনিশ্চিত ভাবে উপলব্ধি করিয়া থাকেন।

🎴সূত্রঃ ১৪২। কিন্তু আরোগ্য- প্রদানকল্পে প্রযুক্ত অবিমিশ্র ঔষধের কতকগুলি লক্ষণকে মূল রোগের লক্ষণ সমূহ হইতে এমন কল্যানৈপুণ্যের বিষয়ীভূত এবং যাহারা পর্যবেক্ষণে অত্যন্ত পারদর্শী তাহাদের উপর তাহা ছাড়িয়া দিতে হইবে ।

🎴সূত্রঃ ১৪৩। এইরূপে সুস্থ মানব দেহে অনেকগুলি অবিমিশ্র ঔষধ পরীক্ষা করিয়া কৃত্তিম উৎপাদনকারী রূপে তাহারা যেসকল উৎপাদন ও লক্ষণ সৃষ্টি করিতে সমর্থ সেগুলি যদি যত্ন সহকারে ও বিশ্বস্ততার সহিত আমরা লিখি তবে আমরা প্রকৃত মেটেরিয়া মেডিকা (ভৈষজ্ বিজ্ঞান) পাই । সেটি হইল অবিমিশ্র ও ঔষধসমূহের যথার্থ, বিশুদ্ধ ও বিশ্বাসযোগ্য ক্রিয়া প্রণালীর সংগ্রহ, প্রকৃতি দেবীর একখানি গ্রন্থ, যাহাতে শক্তিশালী ঔষধ সমুহ দ্বারা উদ্ভূত স্বাস্থ্যের বিশেষ পরিবর্তন ও লক্ষণসমূহ যেভাবে পর্যবেক্ষকের কাছে ধরা পড়িয়াছে সেইভাবে লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে এবং যাতে পরে সেই সকল ঔষধ দ্বারা আরোগ্যযোগ্য অনেক প্রাকৃতিক সদৃশ চিত্র সন্নিবেশিত আছে। এককথায় তাহার মধ্যে আছে কৃত্তিম পীড়ার অবস্থা সমূহ যাহা তাহাদের সদৃশ প্রাকৃতিক পীড়ার সুনিশ্চিত ও স্থায়ী আরোগ্যের জন্য একমাত্র প্রকৃত, হোমিওপ্যাথিক অর্থাৎ অমোঘ নিরাময়ের উপায় প্রদান করে।

🎴সূত্রঃ ১৪৪। এই মেটেরিয়া মেডিকা হইতে যাহা কিছু অনুমান নির্ভর, কেবল কথার কথা কিংবা কল্পনাপ্রসূত নিষ্ঠার সহিত বর্জন করিতে হইবে। তাহার প্রত্যেকটি হইবে যত্ন ও সরলতার সহিত জিজ্ঞাসিত প্রকৃতির ভাষা।

🎴সূত্রঃ ১৪৫। বাস্তবিকই কেবলমাত্র মানুষের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন আনয়নকারী বহুসংখ্যক ভেষজের বিশুদ্ধ ক্রিয়া প্রণালীর সহিত সঠিক পরিচয়ের ভিতর দিয়া অগণিত প্রাকৃতিক পীড়ার প্রত্যেকটির জন্য এবং জগতের প্রতিটি ব্যাধির জন্য আমরা একটি উপযুক্ত কৃত্রিম (আরোগ্যদানকারী) পীড়ার সাদৃশ্যযুক্ত একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ আবিষ্কার করিবার যোগ্যতা লাভ করিতে পারি। লক্ষণসমূহের যথার্থতা এবং শক্তিশালী ভেষজসমূহের প্রত্যেকটির ক্রিয়ার দ্বারা সুস্থ দেহের উপরে যে সকল প্রচুর রোগ উপাদানের পরিচয় পাওয়া গিয়েছে তাহাকে ধন্যবাদ; ইতোমধ্যে এখনই অতি অল্পসংখ্যক রোগ আছে যাহার জন্য বিশুদ্ধ ক্রিয়া সম্বন্ধে অধুনা পরীক্ষিত ঔষধ সমূহের মধ্য হইতে একটিকে পাওয়া যায় না । তাহা বিশেষ কোন গোলযোগ সৃষ্টি না করিয়া মৃদু, সুনিশ্চিত ও স্থায়ীভাবে, মিশ্রিত ও অজ্ঞাত ওষুধসমূহ সম্মানিত পুরাতন এলোপ্যাথিক চিকিৎসাকলার সাধারণ ও বিশেষ ভেষজ বিজ্ঞান দ্বারা সাধিত চিকিৎসা অপেক্ষা বহুগুণে নিশ্চিত ও নিরাপদে স্বাস্থ্য পুনঃপ্রদান করিতে পারে । এই প্রকার মিশ্রিত ঔষধ প্রয়োগে কেবল রোগের বৃদ্ধি ছাড়া রোগসমূহ তো নিরাময় হয়ই না, অচিরপীড়াতেও আরোগ্যদানের সহায়ক না হইয়া বাধা সৃষ্টি করে ও প্রায়ই জীবনকে বিপদগ্রস্ত করে ।

(২২) সর্বাপেক্ষা উপযোগী ও সুনির্বাচিত ঔষধ (১৪৬-১৪৯)

🎴সূত্রঃ ১৪৬। প্রকৃত চিকিৎসকের তৃতীয় কর্তব্য হইল হোমিওপ্যাথিক মতে প্রাকৃতিক পীড়ার আরোগ্যপ্রদানকল্পে সেই সকল কৃত্রিম পীড়া উৎপাদক পদার্থের (ঔষধ) বিবেচনাপূর্বক প্রয়োগ যেগুলির বিশুদ্ধ ক্রিয়া নির্ণয়ের জন্য সুস্থ দেহে পরীক্ষণ করা হইয়াছে ।

🎴সূত্রঃ ১৪৭। মানুষের স্বাস্হ্যে পরিবর্তন আনয়ন করিবার ক্ষমতা সম্বন্ধে যে সকল ঔষধের পরীক্ষা করা হইয়াছে তাহাদের মধ্যে যেটিরই লক্ষণসমূহে কোন প্রাকৃতিক পীড়ার লক্ষণসমষ্টির সর্বাপেক্ষা সাদৃশ্য আমরা দেখিব তাহাই সর্বাপেক্ষা উপযোগী, সেই রোগের সর্বাপেক্ষা সুনিশ্চিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এবং তাহাই হইবে সেই রোগের ক্ষেত্রে অব্যর্থ ওষুধ ।

🎴সূত্রঃ ১৪৮। প্রাকৃতিক ব্যাধিকে দেহের ভিতরে কিংবা বাহিরে অবস্থিত অনিষ্টকারী একটি স্হূল বস্তু বলিয়া মনে করা কখনই উচিত নহে ( সূত্র ১১-১৩) । তাহা এক বিরুদ্ধ ধর্মী সূক্ষ্ম শক্তির দ্বারা (ধারণযোগ্য) উৎপন্ন বলিয়া ধরিতে হইবে। এই শক্তি একপ্রকার সংক্রমনের ন্যায় দেহাভ্যন্তরস্থিত অতীন্দ্রিয় মূল জীবনীশক্তির স্বতঃস্ফূরিত সত্তাকে পিশাচের মত উৎপীড়ন দ্বারা কতগুলি পীড়া ও বিশৃঙ্খলা উৎপাদন করতে বাধ্য করিয়া দেহ ধর্মের নিয়মিত ধারাকে বিপর্যস্ত করে। এই গুলিকে বলা হয় লক্ষণ (রোগ) । এখন যদি এই বিরুদ্ধ শক্তির প্রভাবকে, যাহা শুধু এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির হেতু নহে তাহা বজায় রাখিবার ও হেতু, অপসারিত করা যায় যাহা চিকিৎসক যখন একটি কৃত্রিম শক্তি প্রয়োগ করেন, যে কৃত্রিম শক্তি জীবনী শক্তিকে সর্বাপেক্ষা সদৃশ উপায় (হোমিওপ্যাথিক ঔষধ) পরিবর্তিত করতে পারে এবং যাহা ক্ষুদ্রতম মাত্রায় শক্তিতে প্রাকৃতিক পীড়া অপেক্ষা অধিকতর, তাহা হইলে জীবনীশক্তির উপর মূল অনিষ্টকারী শক্তির প্রভাব বলবত্তর সদৃশ কৃত্রিম রোগের কার্যকালে নষ্ট হইয়া যায়। তখন আর জীবনীশক্তির উপর কোন দুষ্ট প্রভাব থাকে না—তাহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যেমন বলা হইয়াছে সেই ভাবে যদি নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ঠিকমতো প্রয়োগ করা হয়, তাহা হইলে সদ্যোবূদ্ধিপ্রাপ্ত অচির প্রাকৃতিক পীড়া—যাহাকে দমন করিতে হইবে—-কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অজ্ঞাতসারেই অন্তর্হিত হইবে। আরও পুরাতন, অধিকতর চিররোগ সমস্ত অস্বাচ্ছন্দ্য সহ তদপেক্ষা কিছু বিলম্বে একই ঔষধের উচ্চতর শক্তির কয়েকমাত্রা ব্যবহারে কিংবা অপর কোন সদৃশতর হোমিওপ্যাথিক ওষুধে প্রশমিত হইবে। অজ্ঞাতসারে সর্বদা দ্রুত পরিবর্তন ভিতর দিয়া স্বাস্থ্য ও আরোগ্য ফিরে আসে। জীবনীশক্তি আবার ব্যাধিমুক্ত হইয়া পূর্বের ন্যায় দেহের সুস্থ প্রাণ প্রিয়া পরিচালনা করিতে সমর্থ হয়, বল ফিরিয়া আসে।

🎴সূত্রঃ১৪৯। দীর্ঘদিনের ব্যাধির (বিশেষত যেগুলি জটিল প্রকৃতির) আরোগ্যের জন্য অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় লাগে। বিশেষ করিয়া এলোপ্যাথির আনাড়ি চিকিৎসার সহিত আরোগ্যবিহীন প্রাকৃতিক পীড়ার সংমিশ্রণে যে সকল চিররোগের সৃষ্টি হয় তাহাদের আরোগ্যের জন্য আরও দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়। নির্লজ্জভাবে রোগীর বলশক্তি ও রসরক্তাদি অপহরণের (শিরাকর্তন, জোলাপ প্রভৃতি), দীর্ঘকালব্যাপী বেশি মাত্রায় প্রচন্ড ঔষধসমূহ ব্যবহারে—যাহা অনুরূপ ব্যাধিতে কার্যকরী হইয়াছে বলিয়া অসার মিথ্যা কল্পনার উপর ভিত্তি করিয়া প্রদত্ত হইয়া থাকে—এবং অনুপযুক্ত ধাতব জলে স্নান প্রভৃতির ন্যায় যে সকল প্রধান ব্যবস্থা এলোপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করিয়া থাকেন তাহলে সেই সকল ব্যাধি আরোগ্যের বাহিরে চলিয়া যায়।

(২৩) অচির রোগের চিকিৎসা (সূত্র-১৫০-১৫৬)

🎴সূত্রঃ ১৫০। কেবল স্বল্পকালে পূর্বে দেখা গিয়েছে এই রূপ এক বা একাধিক লক্ষণের কথা রোগী যদি বলে তাহা হইলে চিকিৎসার যোগ্য পূর্ণাঙ্গ ব্যাধি বলিয়া চিকিৎসকের তাহার উপর কোন গুরুত্ব আরোপ করিবার প্রয়োজন নাই । খাদ্যবস্হায় সামান্য কিছু পরিবর্তন করাই এরূপ অসুস্থতাকে দূরীভূত করিবার পক্ষে সাধারণত যথেষ্ট ।

🎴সূত্রঃ ১৫১। কিন্তু রোগী যখন কোন প্রচণ্ড যন্ত্রণার অভিযোগ করে তখন চিকিৎসক অনুসন্ধান করিলে তাহা ছাড়া অপেক্ষাকৃত সামান্য ধরনের হইলেও আরও কতকগুলি লক্ষণ দেখিতে পাইবেন । সেগুলিকে লইয়া রোগের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাইবে।

🎴সূত্রঃ ১৫২। অচিররোগ যত বেশি গুরুতর হইবে তত বেশি সংখ্যক ও বিশেষ ধরনের লক্ষণ তাহাতে সাধারণত থাকিবে এবং তাহার জন্য তত সুনিশ্চিতভাবে একটি উপযুক্ত ঔষধ পাওয়া যাইবে যদি যথেষ্ট সংখ্যক ঔষধ– যাহাদের মধ্য হইতে তাহা বাছিয়া লইতে হইবে—-এবং তাহাদের সঠিক ক্রিয়া সম্বন্ধে জানা থাকে। বহুসংখ্যক ঔষধের লক্ষণ তালিকা হইতে এমন একটি ঔষধ পাওয়া কঠিন হইবে না যাহার আরোগ্যদায়ক কৃত্তিম বিশেষ রোগ উপাদানসমূহ হইতে প্রাকৃতিক পীড়ার লক্ষণ সমষ্টির সদৃশ একটি চিত্র অংকন করা যায় । এই ঔষধই ঈপ্সিত আরোগ্যদায়ক ঔষধ ।

🎴সূত্রঃ ১৫৩। নির্দিষ্ট আরাগ্যদায়ক হোমিওপ্যাথিক ওষুধের এই অনুসন্ধানে অর্থাৎ প্রাকৃতিক রোগের লক্ষণ সমষ্টির সহিত পরিচিত ঔষধ সমূহের তালিকা মিলাইয়াএকটি কৃত্রিম রোগ শক্তি বাহির করিতে রোগীর অধিকার উল্লেখযোগ্য, অনন্য, অসাধারণ, এবং বিচিত্র (পরিচায়ক) চিহ্ন ও লক্ষণাবলী দিকে কেবলমাত্র লক্ষ রাখিতে হইবে। কারণ আরোগ্য কল্পে সর্বাধিক উপযুক্ত হইতে হইলে বিশেষ করিয়া এইগুলির সহিত নির্বাচিত ঔষধের লক্ষণসমূহের খুব বেশি সাদৃশ্য থাকা চাই। অধিকতর সাধারণ ও অস্পষ্ট লক্ষণসমূহ যেমন, অক্ষুধা, মাথাধরা, দুর্বলতা, নিদ্রায় অস্থিরতা, অস্বস্তি প্রভৃতি যতক্ষণ অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট থাকে এবং ঠিকমতো বর্ণনা করা না হয় ততক্ষণ সে গুলির দিকে লক্ষ্য দিবার প্রয়োজন অতি অল্প। কারণ এই প্রকার সাধারণ ধরনের লক্ষণ প্রায় প্রত্যেকটি রোগেই দেখা যায় এবং প্রায় প্রত্যেকটি ঔষধেই পাওয়া যায়।

🎴সূত্রঃ ১৫৪। যোগ্যতম ঔষধের লক্ষণ তালিকা হইতে যে প্রতিরূপ প্রস্তুত করা হয় তাহার মধ্যে যদি সে সকল বিচিত্র, অসাধারণ, অনন্য এবং বিশিষ্ট (পরিচালক) লক্ষণসমূহ বিদ্যমান থাকে যেগুলি অধিকতম সংখ্যায় ও অধিকতম সাদৃশ্যসহ যে রোগ চিকিৎসা করিতে হইবে তাহার মধ্যে দেখা যায়, তাহা হইলে সেই ঔষধই হইবে সেই রোগে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত আরোগ্যদায়ক হোমিওপ্যাথিক ঔষধ। রোগ যদি খুব বেশি পুরাতন না হয় তাহা হইলে সাধারণত প্রথম মাত্রাতেই বেশি কিছু ভুল যোগ ব্যতীত দূরীভূত ও বিনষ্ট হইবে ।

🎴সূত্রঃ ১৫৫। আমি বলিতেছি, বেশি কিছু গোলযোগ ব্যতীত। কারণ এই যোগ্যতম ওষুধের প্রয়োগ ক্ষেত্রে ওষুধের সেই সকল লক্ষণই ক্রিয়াশীল হয় যেগুলির সহিত ও রোগলক্ষণের মিল আছে। দেহাভ্যন্তরে অর্থাৎ জীবনীশক্তির অনুভূতির ক্ষেত্রে প্রথমোক্ত লক্ষণসমূহ শেষোক্তগুলির (দুর্বলতার) স্থান অধিকার করিয়া ধ্বংস করিয়া ফেলে। কিন্তু হোমিওপ্যাথিক ঔষধের অন্যান্ন লক্ষন, যেগুলি সংখ্যায় প্রায় খুব বেশি, সেই রোগের সহিত কোন প্রকার সম্পর্ক থাকে না বলিয়া আদৌ কার্যকরী হয় না । রোগী প্রতি ঘন্টায় ক্রমশ বোধ করিতে থাকে, সেইজন্য সেগুলি সম্বন্ধে সে প্রায়ই আর কিছু অনুভব করে না কারণ, হোমিওপ্যাথি মতে ব্যবহৃত ঔষধের অত্যন্ত ক্ষুদ্র মাত্রা এত মৃদু যে রোগের সদৃশ নহে এরূপ অন্যান্য লক্ষণ দেহের রোগ মুক্ত স্থানসমূহে উৎপাদন করিতে পারে না এবং সেইজন্য দেহের যে সকল স্হান রোগের সদৃশ লক্ষণ দ্বারা সর্বাধিক আক্রান্ত ও উত্তেজনাগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে সেই সকল স্থানেই হোমিওপ্যাথিক লক্ষণসমূহ ক্রিয়া প্রকাশ করিতে সমর্থ হয়। তাহার ফলে রুগ্ন জীবনীশক্তি সদৃশ অথচ বলবত্তর ঔষধ জনিত পীড়ার বিরুদ্ধেই মাত্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করিতে সমর্থ হয় এবং তদ্বারা মুলব্যাধি বিনষ্ট হয় ।

🎴সূত্রঃ ১৫৬। এমন কোন হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নাই বলিলেই হয় যাহা সুনির্বাচিত হইলেও বিশেষভাবে উপযুক্ত সূক্ষ্ম মাত্রায় প্রযুক্ত না হইলে অত্যন্ত উত্তেজনা ও অনুভূতিপ্রবণ রোগীর ক্ষেত্রে, যতক্ষণ তাহার ক্রিয়া বর্তমান থাকে, অনন্ত একটি সামান্য অস্বভাবিক বিশৃংখলা, কিছু নগণ্য নুন্যতন লক্ষণ উৎপাদন না করে। কারণ ইহা এক প্রকার অসম্ভব যে সমবাহু ও সমকোণ বিশিষ্ট দুইটি ত্রিভুজের মত ঔষধ ও রোগ, লক্ষণের দিক দিয়া, ঠিক একইভাবে পরস্পর মিলিয়া যাইবে। সাধারণ ক্ষেত্রে এই যে তুচ্ছ প্রভেদ তাহা জীবন্ত দেহের প্রচ্ছন্ন ক্রিয়া (শক্তি) দ্বারা সহজেই দূরীভূত হইবে এবং অত্যন্ত দুর্বল না হইলে রোগী তাহা অনুভবই করে না। দেহের উপর বিভিন্ন প্রকার ঔষধের ক্রিয়া, আহারাদির ভুল কিংবা মানসিক উত্তেজনা দ্বারা যদি বাঁধা না পায় তাহা হইলে স্বাস্থ্য উন্নতির পথে চলিতে চলিতে সম্পূর্ণ আরোগ্য পৌঁছায়।

(২৪) সদৃশ বৃদ্ধি বা ঔষধজ রোগ (সূত্র-১৫৭-১৭১)

🎴সূত্রঃ ১৫৭। কিন্তু যদিও ইহা নিশ্চিত যে হোমিওপ্যাথি মতে নির্বাচিত ঔষধ উপযুক্ততা এবং মাত্রায় সূক্ষ্মতার জন্য তাহার সদৃশ অচিররোগকে শান্তভাবে এবং অন্য কোন বিসদৃশ লক্ষণ প্রকাশ না করিয়া অর্থাৎ নতুন কোনো গুরুতর বিশৃঙ্খলা না আনিয়া দূরীভূত ও বিনষ্ট করে, তথাপি মাত্রা যথোচিত ক্ষুদ্র না হইলে এবং যেখানে কয়েক ঘন্টা ধরিয়া মাত্রা কিছু অধিক পরিমাণে দেওয়া হইয়াছে সেখানে প্রায়ই ঔষধ সেবনের অব্যবহিত পরেই প্রথম ঘন্টা কিংবা কয়েক ঘণ্টার জন্য রোগের সামান্য একটা বুদ্ধি দেখা যায় এবং তাহা মূল রোগের এত সদৃশ যে রোগীর কাছে মনে হয় তাহার নিজস্ব রোগেরই বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু তাহা প্রকৃতপক্ষে রোগ অপেক্ষা কিছু বেশি শক্তিশালী অত্যন্ত সদৃশ ওষুধ জনিত রোগ ছাড়া আর কিছুই নহে।

🎴সূত্রঃ ১৫৮। প্রথম কয়েক ঘণ্টার এই সামান্য হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি (যাহা অচিররোগ প্রথম মাত্রাতেই প্রশমিত হইবার প্রায় নিশ্চিত নিদর্শন) ঠিক যে রূপ হওয়া উচিত কারণ একটি প্রাকৃতিক বেঁধে অধিকতর শক্তিশালী হলে যেমন অপর একটি সদৃশ ব্যাধিকে দূরীভূত অভি নষ্ট করে (সূত্র ৪৩-৪৮) সেইরূপ যে ব্যাধিকে নিরাময় করিতে হইবে তাহাকে পরাভূত ও ধ্বংস করিতে হইলে ঔষধজ ব্যাধিকে স্বভাবতই বেশি শক্তিশালী হইতে হইবে।

🎴সূত্রঃ ১৫৯। অচিররোগের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মাত্রা যত ক্ষুদ্র হইবে ব্যাধির প্রথম কয়েক ঘণ্টার এই প্রতীয়মান বৃদ্ধিও ক্ষণস্থায়ী হইবে।

🎴সূত্রঃ ১৬০। কিন্তু যেহেতু হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মাত্রা কে এত ক্ষুদ্র করা যায় না যাহা সামান্য পুরাতন, জটিলতা শূন্য, সদৃশ প্রাকৃতিক ব্যাধিকে প্রশমিত, পরাভূত এমনকি সম্পূর্ণরূপে নিরাময় ও বিনষ্ট করিতে পারে না, সেই হেতু আমরা বুঝতে পারি যে ঠিক মতো নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ, তাহার মাত্রা যদি একেবারে ক্ষুদ্র না হয় তাহা হইলে তাহা সেবনের পরে কেন প্রথম ঘণ্টায় অনুভব যোগ্য এই প্রকার হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি সর্বদাই আনয়ন করে।

🎴সূত্রঃ ১৬১। প্রথম ঘণ্টায় বা কেবল প্রথম কয়েক ঘণ্টায় তথাকথিত হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিক ঔষধের প্রাথমিক ক্রিয়াহেতু মূলরোগের কিছু বৃদ্ধির যে কথা আমি বলেছি অচিররোগ যাহা সম্প্রতি হইয়াছে তাহা সম্বন্ধে সত্য। কিন্তু যেখানে দীর্ঘ প্রিয় ঔষধ সমূহকে বহুদিনের পুরাতন যুগের সহিত লড়াই করতে হয় সেখানে চিকিৎসাকালে মূলরোগের এই রোগ বৃদ্ধি ঘটা উচিত নহে এবং তাহা ঘটে না যদি সুনিশ্চিত ঔষধ যথোচিত ক্ষুদ্র মাত্রায় প্রত্যেকবার কিঞ্চিৎ উচ্চতর নূতন শক্তিতে পরিবর্তিত করিয়া দেওয়া হয়। চির রোগের মূল লক্ষণসমূহের এই প্রকার বৃদ্ধি চিকিৎসার শেষ ভাগে, যখন আরোগ্য প্রায় আসন্ন কিংবা তাহা সম্পূর্ণ সাধিত হইয়াছে তখনই কেবল হইতে পারে।

🎴সূত্রঃ ১৬২। পরিমিত সংখ্যক ওষুধেরই যথার্থ বিশুদ্ধ ক্রিয়া এযাবৎ জানা গিয়াছে বলিয়া কখনও কখনও চিকিৎসাধীন পীড়ার লক্ষণসমূহের অংশমাত্র সুনির্বাচিত ঔষধের লক্ষণ তালিকার মধ্যে দেখা যায়। সেই জন্য অধিকতর উপযুক্ত ঔষধের অভাবে এই অসম্পূর্ণভাবে পীড়া উৎপাদক ঔষধকেই প্রয়োগ করা হয়।

🎴সূত্রঃ ১৬৩। এই ক্ষেত্রে ঔষধ হইতে আমরা পূর্ণাঙ্গ উপদ্রবহীন আরোগ্য লাভ বস্তুত আশা করিতে পারি না। কারণ ঔষধের ব্যবহারকালে এমন কতকগুলি লক্ষণ আসিয়া উপস্থিত হয় যেগুলিকে পূর্বে ঐ রোগে দেখা যায় নাই। সেইগুলি হইল ঔষধের অনুপযুক্ততা হেতু অতিরিক্ত লক্ষণ ( accessory symptoms) । ইহা কিন্তু রোগের অনেকখানি অংশ ( রোগলক্ষণের সহিত ঔষুধ লক্ষণের যতখানি মিল আছে) নির্মল করিয়া আরোগ্য সূচনা করিবার কোন বাধা হয়না। তথাপি ঐসকল অতিরিক্ত লক্ষণ বাদ দিয়া তাহা ঘটে না। অবশ্য ওষুধের মাত্রা যথেষ্ট পরিমাণে অল্প থাকিলে ঐসকল লক্ষণ পরিমিত ভাবেই দেখা যায়।

🎴সূত্রঃ ১৬৪। সর্বোত্তম সুনির্বাচিত ঔষধের মধ্যে কয়েকটি মাত্র সাদৃশ্য থাকলেও তাহা আরোগ্যের পথে বাধা হয় না যদি ঔষধের সেই কয়েকটি লক্ষণ প্রধানত রোগের অসাধারণ এবং অদ্ভুত ধরনের বৈশিষ্ট্য নির্দেশক (পরিচয়জ্ঞাপক) লক্ষণ হয় । এরূপ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন উপদ্রব ছাড়াই আরোগ্য হয় ।

🎴সূত্রঃ ১৬৫। কিন্তু যদি নির্বাচিত ঔষধের লক্ষণ সমূহের মধ্যে এমন কোন লক্ষণ না থাকে যাহা সঠিকভাবে রোগের বিশেষ, অদ্ভুত ও অসাধারণ লক্ষণ সমূহের সদৃশ, যদি কেবলমাত্র রোগের সাধারণ, অস্পষ্ট ভাবে বর্ণিত অনিশ্চিত অবস্থাগুলির (বমনভাব, দুর্বলতা, মাথাব্যথা প্রভৃতি) সহিতই ঔষধটি মিল থাকে এবং যদি পরিচিত ঔষধ সমূহের মধ্যে সেটি অপেক্ষা আর কোন সদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট উপযুক্ত ঔষধ না পাওয়া যায়, তাহা হইলে চিকিৎসক এই প্রকার অসদৃশ্ ঔষধ প্রয়োগ দ্বারা কোন আশু সুফল প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন না।

🎴সূত্রঃ ১৬৬। এইরূপ ক্ষেত্র কিন্তু খুবই বিরল। কারণ অধিক সংখ্যক ঔষধের যথার্থ ক্রিয়ার সহিত পরিচয় এখন আমাদের হইয়াছে এবং ঔষধ জনিত কুফল যদি দেখা যায় তাহা হইলে পরবর্তী অধিকতর সদৃশ ঔষধের নির্বাচন দ্বারা তখনই তাহা হ্রাস করা যায়।

🎴সূত্রঃ ১৬৭। এইভাবে অনুপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রথম প্রয়োগ করিয়া যদি ধর্তব্য কিছু অতিরিক্ত লক্ষণ আসিয়া উপস্থিত হয় তাহা হইলে অচিররোগের ক্ষেত্রে প্রথম মাত্রায় ক্রিয়া শেষ করিতে দিই না বা ওষুধের পূর্ণ ক্রিয়া রোগীকে ভোগ করিতে দিই না বরং পরিবর্তিত অবস্থায় নতুনভাবে আমরা রোগ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করি এবং রোগের নতুন চিত্র অঙ্কনের জন্য সাম্প্রতিক লক্ষণগুলির সহিত আদি লক্ষণ সমূহের অবশিষ্টগুলি যোগ করে লই ।

🎴সূত্রঃ ১৬৮। আমরা তখন আরও অধিক ক্ষিপ্রতার সহিত পরিচিত ঔষধ সমূহের মধ্য হইতে আমাদের চিকিৎসাধীন পীড়ার সদৃশ এমন একটি ঔষধ বাহির করিতে পারিব যাহার একমাত্র রোগকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না করিলেও আরোগ্য পথে অনেক আগাইয়া লইয়া যাইবে। এই ঔষধ ও যদি স্বাস্থ্যোদ্ধারের পক্ষে যথেষ্ট না হয় তখন রুগ্নাবস্বায় যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে তাহা বারবার পরীক্ষা করিয়া এবং তজ্জন্য যতসম্ভব উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন করিয়া যে পর্যন্ত আমাদের উদ্দেশ্য অর্থাৎ রোগীর সম্পূর্ণ স্বাস্হ্যলাভ সাধিত না হয় সেই পর্যন্ত এই ভাবে আমরা চলিত থাকিব।

🎴সূত্রঃ ১৬৯। প্রথম রোগ পরীক্ষা এবং প্রথম ঔষধ নির্বাচন করিতে গিয়া যদি আমরা দেখি যে যথেষ্ট সংখ্যক ঔষধের সহিত পরিচয় না থাকাহেতু একটিমাত্র ওষুধের পীড়া উৎপাদনের ভিতরে রোগের সমগ্র লক্ষণ সমষ্টি ধরা পড়িতেছে না, উপযুক্ততার দিক দিয়া দুইটি ঔষধ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতেছে, রোগলক্ষণের একাংশের জন্য একটিকে এবং অপরঅংশের জন্য অপরটিকে উপযুক্ত বলিয়া মনে হইতেছে, তখন সেই দুইটির মধ্যে অধিকতর উপযুক্ত ওষুধটিকে প্রয়োগ করিবার পর রোগীকে পুনরায় পরীক্ষা না করিয়া দ্বিতীয়টিকে প্রয়োগ করা কর্তব্য নহে, দুইটিকে একসঙ্গে দেওয়া আরও অনুচিত (টীকা ২৭২ সূত্র) । কারণ যেঔষধ টিকে প্রথমটির পরেই যোগ্যতর বলিয়া মনে হইয়াছিল ইতিমধ্যে অবস্থার পরিবর্তন হওয়ায় তাহা অবশিষ্ট লক্ষণসমূহের জন্য আর দরকার নাও হইতে পারে। অতএব সে ক্ষেত্রে নূতনভাবে পরীক্ষায় যে লক্ষণ সমষ্টি দেখা যাইবে তজ্জন্য দ্বিতীয় ঔষধটির স্থানে একটি যোগ্যতার সদৃশ ওষুধ নির্বাচন করা প্রয়োজন হইবে।

🎴সূত্রঃ ১৭০। অতএব প্রত্যেক ক্ষেত্রে, যেমন এই ক্ষেত্রে, রোগাবস্তার পরিবর্তন ঘটলে তখনকার অবশিষ্ট লক্ষণগুলি সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে হইবে এবং যে ঔষধটিকে পরবর্তী উপযুক্ত ঔষধ বলিয়া মনে হইয়াছিল সেটির দিকে ঝোঁক না দিয়া অন্য একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ—যাহা উপস্হিত ক্ষেত্রে যথাসম্ভব উপযোগী তাহা নির্বাচন করিতে হইবে। এইরূপ যদি হয়, যদিও তারা প্রায়ই ঘটে না, যে ওষুধটিকে প্রথমে পরবর্তী উপযুক্ত ঔষধ বলিয়া মনে হইয়াছিল তাহা তখন ও অবশিষ্ট রুগ্নাবস্থায় জন্য উপযোগী, তাহা হইলে তাহা আমাদের কাছে আরও নির্ভরযোগ্য এবং অন্য ঔষধ না দিয়া সেইটিকে তখন প্রয়োগ করাই যুক্তিযুক্ত।

🎴সূত্রঃ ১৭১। অযৌন চিররোগ অর্থাৎ যে সকল রোগ খুব সাধারণভাবে সোরা হইতে উৎপন্ন সেই সকল ক্ষেত্রে আরোগ্যের জন্য প্রায়ই আমাদিগকে পরপর কতকগুলি সোরাদোষঘ্ন ঔষধ প্রয়োগ করিতে হয়। পূর্ববর্তী ঔষধটির ক্রিয়া শেষ হইবার পর যে সকল লক্ষণ অবশিষ্ট থাকে তাহার সহিত সদৃশ্য মিলাইয়া আবার পরবর্তী ঔষধ নির্বাচন করা হয়।


(২৫) এক দৈশিক চিররোগ সমূহ (সূত্র-১৭২-১৭৩)

🎴সূত্রঃ ১৭২। রোগ লক্ষণের অত্যন্ত স্বল্পতা হেতু আরোগ্যের পথে অনুরূপ অসুবিধা ঘটিয়া থাকে। ইহা এমন একটি অন্তরায় যাহা আমাদের বিশেষ মনোযোগের বিষয় । কারণ ইহা দূরীভূত হইলে সম্ভাব্য চিকিৎসাপদ্ধতি সমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ এই চিকিৎসা প্রণালী ( যেখানে ইহার যন্ত্র স্বরূপ পরিচিতি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এখনও অসম্পূর্ণ সে ক্ষেত্র ছাড়া) পথে অবস্থিত সকল অন্তরায় দূরীভূত হইবে।

🎴সূত্রঃ ১৭৩। সেই সকল রোগ, যাহাতে লক্ষণ খুব কমই দেখা যায় এবং সেইজন্য দুশ্চিকিৎস্য তাহাকে একতরফা ব্যাধি (one-sided diseases) বলা হয়। ঐ সকল রোগে মাত্র দুই একটি প্রধান লক্ষণ দেখা গেলেও বাকি লক্ষণগুলি ঢাকা থাকে । সেইগুলি প্রধানত চিররোগের পর্যায়ভুক্ত ।

(২৬) স্থানীয় রোগ এবং চিকিৎসা (সূত্র-১৭৪-২০৩)

🎴সূত্রঃ ১৭৪। তাহাদের প্রধান লক্ষণ হয়তো কোন একটি অভ্যন্তরীণ উপসর্গ লইয়া ( যেমন, বহু বৎসরের মাথাধরা, অনেকদিনের উদরাময়, পুরাতন হৃদশূল প্রভৃতি), আর নয়তো বহিরাঙ্গিক কোন পীড়া। শেষোক্ত পীড়া কে সাধারণত স্থানীয় ব্যাধি (local maladies) নামে চিহ্নিত করা হয় ।

🎴সূত্রঃ ১৭৫। প্রথম প্রকারের একতরফা যে রোগ তাহার মূলে হইল চিকিৎসকের অন্তর্দৃষ্টির অভাব এবং যে সকল লক্ষণ প্রকৃতই রহিয়াছে এবং যেগুলির সাহায্যে তাঁহার পক্ষে রোগের পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কন করা সম্ভব সেগুলিকে সম্পূর্ণভাবে আবিষ্কার করিতে না পারা।

🎴সূত্রঃ ১৭৬। তথাপি অল্প সংখ্যক এমন কয়েকটি রোগ আছে যেগুলি খুব সযত্ন প্রাথমিক পরীক্ষার অন্তে (সূত্র ৮৪-৯৮) মাত্র দুই একটি তীব্র প্রচন্ড লক্ষণ দেখা যায়; বাকিগুলি অস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

🎴সূত্রঃ ১৭৭। এরূপ ক্ষেত্র যদিও খুব বিরল তথাপি খুব সফলতার সহিত ইহার চিকিৎসা করিতে হইলে আমাদিগকে প্রথমত সেই কয়েকটি লক্ষণ ধরিয়া সেই ওষুধটি নির্বাচন করিতে হইবে যেটি আমাদের বিবেচনায় সর্বাপেক্ষা সদৃশ।

🎴সূত্রঃ ১৭৮। ইহারা নিঃসন্দেহে কখনও কখনও এ রূপ ঘটে যে, ঠিক হোমিওপ্যাথিক নিয়মে নির্বাচিত সেই ওষুধটি বর্তমান রূপটি কে ধ্বংস করিবার উপযোগী একটি সদৃশ কৃত্রিম রোগ যোগাইয়া দিতে পারে। এইরূপ ঘটা আরও সম্ভবপর হয় যখন এই প্রকার স্বল্প কয়েকটি পীড়ার লক্ষণ স্পষ্ট, নিশ্চিত, অসাধারণ এবং যথাযথ পরিচয়জ্ঞাপক হয় ।

🎴সূত্রঃ ১৭৯। তথাপি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম নির্বাচিত ঔষধ এরূপস্হলে আংশিকভাবে উপযোগী হয় অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গভাবে হয় না, কারণ ঠিক নির্বাচনের পথপ্রদর্শক বেশি লক্ষণ তাহাতে থাকে না ।

🎴সূত্রঃ ১৮০। এই স্তরে যথাসম্ভব সঠিক ভাবে নির্বাচিত, কিন্তু উল্লেখিত কারণে অসম্পূর্ণভাবে সদৃশ ঔষধ তাহার আংশিক সদৃশ রোগের উপায় ক্রিয়ায়—যেমন উল্লিখিত ক্ষেত্রে (সূত্র ১৬২ ও অন্যান্য) যেখানে হোমিওপ্যাথিক ঔষধের সংখ্যা সীমাবদ্ধ বলিয়া পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন সম্ভব হয় না— অতিরিক্ত লক্ষণ প্রদান করে এবং নিজ লক্ষণ শ্রেণী হইতে উদ্ভূত কয়েকটি অবস্থা রোগীর অবস্থার সহিত যুক্ত হয়। সেইগুলি কিন্তু রোগেরই নিজস্ব লক্ষণ, যদিও ইতোপূর্বে সেগুলি কদাচিৎ দেখা গিয়েছে একেবারেই প্রতীয়মান হয় নাই। কতকগুলি লক্ষণ দেখা দেয় যেগুলি রোগী পূর্বে কখনো অনুভব করে নাই কিংবা অপর কতকগুলি যাহা কেবল অস্পষ্টভাবে অনুভূত হইয়াছিল তাহা অধিকতর স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

🎴সূত্রঃ ১৮১। ঐ অতিরিক্ত এবং রোগের সদ্যপ্রকাশিত নতুন লক্ষণাবলী সেই ঔষধ প্রয়োগের ফলে ঘটিয়েছে এই রূপ ধরিয়া লইলে আপত্তির কিছু নাই। সেইগুলি যে ঔষধ হইতে উদ্ভূত তাহা নিশ্চিত। কিন্তু সেইগুলি সর্বদা সেই প্রকারেরই লক্ষণ যাহা সেই রোগ নিজে সেই দেহে উৎপাদন করতে পারে এবং প্রযুক্ত ওষুধের সদৃশ লক্ষণ উৎপন্ন করিবার ক্ষমতা আছে বলিয়া তাঁহার সেই সকল লক্ষণকে আনিয়া তাহাদিগকে প্রকাশিত হতে বাধ্য করে। এক কথায়, অধুনা প্রতীয়মান সমগ্র লক্ষণ সমষ্টিকে রোগেরই নিজস্ব এবং তাহাকে তৎকালীন বাস্তব অবস্থা বলিয়া ধরিয়া লইয়া তদনুসারে আমাদের পরবর্তী চিকিৎসা পরিচালিত করিতে হইবে।

🎴সূত্রঃ ১৮২। ঔষধের অসম্পূর্ণ নির্বাচন—যাহা এই ক্ষেত্রে লক্ষণের স্বল্পতা হেতু তাই অবশ্যম্ভাবী—এইরূপে রোগ লক্ষণের পূর্ণ প্রকাশে সহায়তা করে এবং এই উপায় ও অধিকতর উপযুক্ত দ্বিতীয় হোমিওপ্যাথিক ওষুধের আবিষ্কার সহজ করিয়া দেয় ।

🎴সূত্রঃ ১৮৩। সেই জন্য যখনই প্রথম ঔষধের মাত্রা আর কাজ না করে (যদি নুতন আবির্ভূত লক্ষণসমূহ এর গুরুত্ব হেতু দ্রুত সাহায্যের প্রয়োজন না হয় যাহা হোমিওপ্যাথিক ঔষধের অতি ক্ষুদ্র মাত্রার জন্য এবং সুদীর্ঘ একান্ত বিরল) তখনই আবার নূতন করিয়া রোগ পরীক্ষা করিয়া তখনকার রোগের অবস্থা লিপিবদ্ধ করিতে হইবে এবং তদনুসারে একটি দ্বিতীয় হোমিওপ্যাথিক ঔষধ, যাহা তখনকার অবস্থার ঠিক উপযুক্ত, নির্বাচন করিতে হইবে। এই অবস্থায় লক্ষণসমূহ সংখ্যাই অধিক এবং পূর্ণাঙ্গ হওয়ায় অধিকতর উপযোগী ঔষধ তখন পাওয়া যায়।

🎴সূত্রঃ ১৮৪। এইরূপ ভাবে ঔষধের প্রত্যেকটি নতুন মাত্রার ক্রিয়া শেষ হইলে যখন তাহার উপযোগিতা ও উপকারিতা আর থাকে না, তখন রোগের বাকি অবস্থার অবশিষ্ট লক্ষণগুলি আবার নূতন করিয়া লিখিতে হইবে এবং তখনকার প্রতীয়মান লক্ষণগুলি এর জন্য যতদূর সম্ভব উপযোগী আরেকটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ অনুসন্ধান করিতে হইবে। যতদিন আরোগ্য সম্পূর্ণ না হয় ততদিন এই ভাবে চলিতে হইবে।

🎴সূত্রঃ ১৮৫। একতরফা ব্যাধিসমূহের মধ্যে তথাকথিত স্থানীয় ব্যাধিগুলি একটি প্রধান স্থান অধিকার করে আছে; যে সকল পরিবর্তন এবং পীড়া দেহের বহির্ভাগে দেখা যায় সেই গুলিকে এই আখ্যা দেওয়া হয়। এই পর্যন্ত শিক্ষালয় এই ধারণাই চলিয়া আসিতেছে যে, এই সকল অংশই কেবল পীড়িত, দেহের বাকি অংশের সহিত পীড়ার কোন যোগ নাই। অনুমানসাপেক্ষ এই অসঙ্গত মতবাদ অত্যন্ত বিপজ্জনক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রবর্তন করিয়াছে।

🎴সূত্রঃ ১৮৬। তথাকথিত ঐ সকল স্থানীয় ব্যাধি যেগুলি কিছুকাল আগে মাত্র বাহ্যক্ষত হইতে উৎপন্ন হইয়াছে সেই গুলিকে তবুও প্রথম দিষ্টিতে স্হানীয় ব্যাধি নাম দেওয়া চলে। সেই ক্ষেত্রে কিন্তু ঐ ক্ষত নিশ্চয়ই অত্যন্ত তুচ্ছ এবং তেমন কিছু গুরুতর নহে কারণ বাহির হইতে যে আঘাত দেহের উপর লাগে তা যদি প্রচন্ড হয় তাহলে সমগ্র জীবসত্তা সমবেদনা প্রকাশ করে, জ্বরাদি লক্ষণ দেখা দেয়। এই প্রকার ব্যাধির চিকিৎসা অস্ত্রোপচারের বিধানে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়, আক্রান্ত স্থানে যতোটুকু বাহ্য প্রতিকার প্রয়োজন ঠিক ততটুকুর জন্য। তাহাতে যে আরোগ্য হয়—-যাহা কেবল জীবনী-শক্তির ক্রিয়াশীলতার ভিতর দিয়াই আশা করা যায়—তাহার পথে যে বাহ্য বাধাসমূহ থাকে তাহা স্হূল উপায়ে দূর করা হয় যেমন, সন্ধিচ্যূত স্থানের পুনঃসংযোগ, সেলাই ও ব্যান্ডেজের সাহায্যে ক্ষতের মুখগুলিকে জোড়া লাগানো, বাহির হইতে চাপ দিয়া উন্মুক্ত ধমনীতে রক্ত স্রাব বন্ধ করা, দেহের কোন অংশে কিছু বিধিয়া থাকিলে তাহা টানিয়া বাহির করা, দেহের ভিতরে কোন গহ্বরে প্রদাহকর পদার্থ থাকিলে তাহা বাহির করিয়া দিবার জন্য প্রস্তুত করিয়া দেওয়া, সঞ্চিত রস বা তরল পদার্থ নিঃসারণ করা, ভগ্নাস্তির প্রান্ত গুলিকে সংযুক্ত করা এবং যথোপযুক্ত ব্যান্ডেজের সাহায্যে সেই গুলিকে যথাস্থানে রক্ষা করা প্রভৃতি। কিন্তু এই প্রকার আঘাতে সমগ্র জীবসত্তা যখন আরোগ্য কার্য সমাধানের জন্য জীবনীশক্তির সূকক্রিয়ার প্রয়োজন বোধ করে, জাহা সে সর্বদাই ভূত করিয়া থাকে, যেমন বিস্তৃতভাবে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া, পেশি, শিরা, ধমনী ছিড়িয়া গিয়া প্রবল জ্বড় দেখা দিলে অভ্যন্তরীক ঔষধ প্রয়োগে যখন তাহা দূর করিবার দরকার হয় বা যখন ঝলসানো বা দগ্ধস্হানের বাহ্ যন্ত্রণা হোমিওপ্যাথিক মতে প্রশমিত করা হয়, তখন সূক্ষ্ম শক্তিতত্ত্বপন্থী চিকিৎসকের সেবা এবং তাহার সাহায্যকারী হোমিওপ্যাথির প্রয়োজন উপস্থিত হয়।

🎴সূত্রঃ ১৮৭। কিন্তু বহিরঙ্গে প্রকাশমান ঐসকল ভোগ পরিবর্তন এবং পীড়া বাহ্য আঘাত হইতে উৎপন্ন না হইলে কিংবা সামান্য মাত্র বাহ্য আঘাত তাহাদের উত্তেজনার অব্যবহিত কারণ হইয়া থাকিলে সেইগুলি উদ্ভূত হয় সম্পূর্ণ অন্য প্রকারে। আভ্যন্তরিক কোন ব্যাধি হইলে তাহাদের উৎপত্তিস্থল। সেইগুলিকে কেবল স্থানীয় ব্যাধি বলিয়া ধরা এবং সেই সঙ্গে কেবল অস্ত্রোপচারের সাহায্য পাই সেই রূপে স্থানীয় প্রলেপ কিংবা সেই জাতীয় ঔষধ দ্বারা সেইগুলির চিকিৎসা করা—যাহা পুরাতন চিকিৎসা পন্থিগণ বহু যুগ হইতে করিয়া আসিতেছেন— যেমন অযৌক্তিক তেমনি অনিষ্টকর তাহার ফল।

🎴সূত্রঃ ১৮৮। এই সকল ব্যাধিকে কেবলমাত্র স্থানীয় বলিয়া ধরা হইত এবং সেইজন্য সেইগুলিকে স্থানীয় ব্যাধি আখ্যা দেওয়া হইত, যেন সেই গুলি কেবলমাত্র ঐ সকল স্থানে সীমাবদ্ধ, তাহার সহিত জীবদেহের সম্পর্ক যেন অল্পই কিংবা একেবারেই নাই। ঐ সকল বিশেষ সুস্পষ্ট অংশের পীড়া সম্বন্ধে জীবদেহের বাকি অংশ যেন কোন খবরই রাখে না।

🎴সূত্রঃ ১৮৯। তথাপি অতি অল্প চিন্তা করিলেই ইহা বুঝা যাইবে যে, কোন বাহ্যিক রোগ (যদি তাহা বাহিরের আঘাতজনিত না হয়) উৎপন্ন হইতে পারে না, টিকিয়া থাকিতে পারে না, এমনকি অধিকতর মন্দাবস্থার দিকে যাইতে পারে না যদি না কোন আভ্যন্তরীক কারণ থাকে এবং যদি না সমগ্র জীবসত্তা অসুস্থ থাকার ফলে সহানুভূতিশীল হয়। ইহার উদ্ভব আদৌ সম্ভব পর হইতে না যদি বাকি স্বাস্থ্য তাহা সমগ্রভাবে অনুমোদন না করিত এবং জীবসত্তার বাকি অংশ (দেহের অনুভূতিশীল) তাহাতে অংশগ্রহণ না করিত । বস্তুত দেহের সকল অংশ অনুভূতি ও ক্রিয়ার দিক দিয়া এমন ঘনিষ্ঠ ও একাত্ম ভাবে পরস্পর গ্রথিত যে সমগ্র জীবদেহের ( বিশৃঙ্খলাপ্রাপ্ত) সাহায্য ব্যতীত কে হার উদ্ভব সম্বন্ধে ধারণা করা অসম্ভব’। ঠোঁটের উপর কোন উদ্ভিদ, আঙ্গুলহাড়া কখনই প্রকাশিত হইতে পারে না যদি পূর্ব হইতে এবং তৎকালীন আভ্যন্তরিক অসুস্থতা বিদ্যমান না থাকে।

🎴সূত্রঃ ১৯০। অতএব, বহিরঙ্গে প্রকাশিত যে রোগ বাহিরের অল্প আঘাতে কিংবা কোন আঘাত ব্যতীত উৎপন্ন হইয়াছে তাহার প্রকৃত চিকিৎসা ন্যায়সঙ্গতভাবে, নিশ্চিতরূপে, সাফল্যের সহিত এবং সম্পূর্ণভাবে করিতে হইলে তাহা সমগ্র সত্তার উপর পরিচালিত করিতে হইবে যাহাতে আভ্যন্তরিক ঔষধ প্রয়োগে সর্বাঙ্গীণ ব্যাধি ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়া আরোগ্য সাধিত হয়।

🎴সূত্রঃ ১৯১। ইহা সন্দেহাতীতভাবে অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে যে, সকল ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি বলশালী ঔষধ আভ্যন্তরিক প্রয়োগের পরেই এই প্রকার রোগীর সাধারণ স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করে, বিশেষ করিয়া আক্রান্ত বহিরঙ্গে (সাধারণ চিকিৎসক মন্ডলী যাহাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বলিয়া মনে করেন), এমনকি দেহের সম্পূর্ণ বহিরংশের তথাকথিত স্থানীয় ব্যাধিতেও। ইহা দ্বারা যে পরিবর্তন সাধিত হয় তাহা সমগ্র দেহের স্বাস্থ্যকে ফিরাইয়া আনে এবং সেইসঙ্গে বাহ্য ব্যাধি ও (কোন ব্যাহ্য ঔষধের সাহায্য ব্যতীত) তিরোহিত হয় বলিয়া তাঁহা পরম উপকারী, অবশ্য যদি সমগ্র অবস্থাকে লক্ষ্য করিয়া প্রযুক্ত আভ্যন্তরিক ঔষধ হোমিওপ্যাথিক মতে সঠিক নির্বাচিত হইয়া থাকে।

🎴সূত্রঃ ১৯২। ইহা সর্বাপেক্ষা ভালোভাবে সম্পূর্ণ করা যায় না যখন ঐ রোগ সম্বন্ধে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যাধির ঠিক প্রকৃতি এবং রোগীর স্বাস্হ্যে যে সকল পরিবর্তন, যন্ত্রণা ও লক্ষণ দেখা যায় তাহা এবং ঔষধ ব্যবহার করিবার পূর্বে যেমন দেখা গিয়াছিল সেই সকল একত্রিত করিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রস্তুত করা যায়। যে সকল ঔষধের বিশেষ সামরিক লক্ষণ জানা আছে তাহাদের মধ্যে হইতে পরে লক্ষণ সমষ্টির সদৃশ এমন একটি অনুসন্ধান করা যায় যাহার নির্বাচন ঠিক হোমিওপ্যাথি সম্মত ।

🎴সূত্রঃ ১৯৩। কেবলমাত্র এই ওষুধের আভ্যন্তরিক প্রয়োগ দ্বারা দেহের সাধারণ রুগ্নাবস্হার সহিত স্থানীয় ব্যাধি দূরীভূত হয়। পূর্বেরটির সঙ্গে পরেরটি ও একই সময়ে সারিয়া যায়। তাহা হইতে প্রমাণিত হয় যে স্থানীয় পীড়া দেহের বাকি অংশের ব্যাধির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল এবং সেইজন্য তাহাকে সমগ্রের সহিত অবিচ্ছিন্ন এবং সমগ্র ব্যাধির সর্বপ্রধান গণনীয় বিশিষ্ট লক্ষণসমূহের অন্যতম বলিয়া ধরিতে হইবে।

🎴সূত্রঃ ১৯৪। নবাগত অচিররোগেই হোক কিংবা বহুদিন স্থায়ী স্থানীয় ব্যাধিতেই হউক না কোন বাহ্য ঔষধের মহৌষধি হইলেও এবং সদৃশ লক্ষণহেতু তাহা আভ্যন্তরিক প্রয়োগে হইলেও, আক্রান্ত স্থানে তাহার মর্দন বা বাহ্য প্রলেপের আবশ্যকতা নাই, এমনকি একই সময়ে তাহা আভ্যন্তরিক প্রয়োগ করা হইলেও নহে। কারণ সেই সকল অচির ও স্থানীয় ব্যাধি (যেমন, বিশেষ স্থানের প্রদাহ, ইরিসিপেলাস ) যাহাদের উদ্ভবের সহিত বাহ্য আঘাতের প্রচণ্ডতার ঠিক মিল নাই, আভ্যন্তরিক কোন সূক্ষ্ম কারণ হইতেই যাহা উদ্ভূত, তাহা পরীক্ষিত ঔষধসমূহের সাধারণ ভান্ডার হইতে নির্বাচিত সেই ওষুধের আভ্যন্তরিক প্রয়োগেই সুনিশ্চিতভাবে প্রশমিত হয়, যে ওষুধ বাহির ও ভিতরের প্রতীয়মান স্বাস্থ্য অবস্থার উপযোগী ও লক্ষণসদৃশ; সাধারণত অন্য কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই সকল রোগ যদি সেই ওষুধের কাছে সম্পূর্ণভাবে বশ্যতা স্বীকার না করে এবং পথ্যাদির সুব্যবস্থা সত্ত্বেও যদি আক্রান্ত স্থানের ও সমগ্র শরীরের স্বাভাবিক অবস্থার পুনরুদ্ধারে জীবনীশক্তির অক্ষমতায় অবশেষ থাকিয়া যায় তাহা হইলে সেই অচিররোগ ( যাহা প্রাই ঘটে) সোরাবীজের ফল, যাহা এযাবৎকাল ভিতর লুকাইয়াছিল, কিন্তু এখন প্রবলবেগে বাহির হইয়া স্পষ্ট চিররোগে পরিণত হইতে চলিয়াছে।

🎴সূত্রঃ ১৯৫। এই সকল রোগকে- যাহা মোটেই বিরহ নহে- নির্মূল করিতে হইলে তাহাদের আক্রমণের প্রথম বেগ অনেকটা কমিয়া গেলে অবশিষ্ট লক্ষণের এবং রোগীর পূর্বের রুগ্নাবস্থার প্রতিকারের জন্য যথোচিত সোরাবিষঘ্ন চিকিৎসা ( আমার ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থের উপদেশ অনুসারে ) করিয়া যাওয়া অবশ্যই প্রয়োজন । যে সকল পুরাতন স্থানীয় ব্যাধি স্পষ্টতই যৌন কারণ হইতে উৎপন্ন নহে তাহাদের জন্য সোরাবিষঘ্ন আভ্যন্তরিক চিকিৎসারই একমাত্র প্রয়োজন।

🎴সূত্রঃ ১৯৬। বস্তুত ইহা মনে হইতে পারে যে, লক্ষণসমূহ অনুসারে যথার্থ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ শুধু আভ্যন্তরিক প্রয়োগে নহে তৎসহ ভাজ্য প্রয়োগে এইরূপ রোগসমূহের আরোগ্য সম্পাদন ত্বরান্বিত হইবে, কারণ রোগের স্থানে ওষুধের প্রলেপ লাগাইলে তাহার ক্রিয়া রোগের দ্রুত পরিবর্তন সাধন করে।

🎴সূত্রঃ ১৯৭। সোরাবীজ হইতে উদ্ভূত স্থানীয় ব্যাধি সম্পর্কেই শুধু নয়, সিফিলিস ও সাইকোসিসবীজ হইতে উৎপন্ন ঐ প্রকার ব্যাধি সম্বন্ধেও এই প্রকার চিকিৎসা সমর্থন করা যায় না কারণ, কোন স্থায়ী স্থানীয় ব্যাধিই যেখানে প্রধান লক্ষণ, সেখানে কোন ওষুধের বাহ্য ও আভ্যন্তরিক প্রয়োগ একই সঙ্গে করার বড় অসুবিধা এই যে, এরূপ বাহ্য প্রয়োগের ফলে প্রধান লক্ষণটি ভিতরের ব্যাধি অপেক্ষা দ্রুত লোপ পায় এবং তখন সারিয়া গিয়াছে বলিয়া আমরা প্রতারিত হয়; অথবা অন্তত স্থানীয় লক্ষণটি অকালে অন্তর্হিত হওয়ায় এই একই সময়ে যে আভ্যন্তরিক ওষুধ প্রয়োগ করা হইয়াছিল তদ্দ্বারা সমগ্র ব্যাধি বিনষ্ট হইল কিনা তাহা নির্ণয় করা কেবল কঠিন তাহাই নহে কোন কোন ক্ষেত্রে অসম্ভব।

🎴সূত্রঃ ১৯৮। সেবন করা হইলে যে সকল ঔষধ আরোগ্যদানে সমর্থ, চিররোগবীজজাত ব্যাধির বাহ্য লক্ষণে সেগুলির কেবলমাত্র স্থানীয় প্রয়োগ সেই কারণে একেবারেই সমর্থনযোগ্য নহে। কারণ চিররোগের স্থানীয় লক্ষণটি যদি কেবল স্থানীয় এবং একতরফাভাবে অপসারিত হয়, তাহা হইলে আভ্যন্তরিক চিকিৎসা যাহা স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য তাহা সংশয়ের দুর্বোধ্যতায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে। প্রধান লক্ষণটি ( স্থানীয় ব্যাধি) চলিয়া গেলে থাকে কেবল বিশেষত্বহীন সেই লক্ষণগুলি যেগুলি স্থানীয় ব্যাধি অপেক্ষা কম অপরিবর্তনীয় ও কম স্থায়ী এবং যাহা প্রায়ই অসাধারণত্ববর্জিত বলিয়া রোগচিত্রের স্পষ্ট ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিচয়ের লক্ষণরূপে অত্যন্ত দুর্বল।

🎴সূত্রঃ ১৯৯। যথাযথ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ আবিষ্কৃত হইবার পূর্বে যখন স্থানীয় লক্ষণগুলি ক্ষয়িষ্ণু, শোষক প্রভৃতি ঔষধের বাহ্য প্রয়োগে কিংবা অস্ত্রোপচারে বিনষ্ট করা হইত তখন অবশিষ্ট লক্ষণগুলি অত্যন্ত অস্পষ্ট ও পরিবর্তনশীল থাকায় রোগ আরো বেশি দুঃসাধ্য হইয়া পড়িত। কারণ ঠিকমত ঔষধ নির্বাচন এবং যে পর্যন্ত রোগটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস প্রাপ্ত না হয় সে পর্যন্ত ওষুধটির আভ্যন্তরিক প্রয়োগ করিবার নির্দেশ যেসকল লক্ষণ হইতে পাওয়া যাইত, অর্থাৎ বাহিরের প্রধান লক্ষণ, তাহাকে আমাদের দৃষ্টিবহির্ভূত করা হইয়াছে।

🎴সূত্রঃ ২০০। আভ্যন্তরিক চিকিৎসার জন্য তখনো যদি উহা বিদ্যমান থাকিত তাহা হইলে সমগ্র ব্যাধির জন্য হোমিওপ্যাথিক ঔষধ খুঁজিয়া বাহির করা যাইতে পারিত এবং তাহা পাওয়া যাইলে স্থানীয় ব্যাধির অস্তিত্ব হইতে বুঝা যাইতো যে আরোগ্য সম্পূর্ণ হয় নাই। কিন্তু উহা যথাস্থানে থাকিয়া আরোগ্যলাভ করিলে নিঃসংয়ভাবে প্রমানিত হইত যে রোগটি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হইয়াছে এবং সমগ্র রোগ হইতে ঈপ্সিত আরোগ্যপ্রাপ্তি পূর্ণভাবে সাধিত হইয়াছে । পূ্র্ণ আরোগ্যপ্রাপ্তির পক্ষে ইহাই হইলো অমূল্য ও অপরিহার্য উপায়।

🎴সূত্রঃ ২০১। ইহা স্পষ্ট যে মানুষের জীবনীশক্তি যখন চিররোগগ্রস্থ হয়, যাহাকে উহা সামাজিকভাবে নিজ ক্ষমতায় পরাভূত করিতে অসমর্থ, তখন তাহা দেহের উপরে কোথাও একটি স্থানীয় ব্যাধি উদ্ভবের ব্যবস্থা করে কেবলমাত্র এই উদ্দেশ্যে যে, যে অংশটি জীবনের পক্ষে অপরিহার্য নহে তাহাকে অসুস্থ করা এবং অসুস্থ অবস্থায় রাখা যাহাতে আভ্যন্তরিক ব্যাধিকে প্রশমিত রাখা যায় যাহা অন্যথায় জীবনরক্ষক যন্ত্রসমূহকে ধ্বংস করেছে ( এবং রোগীর প্রাণনাশ করিতে ) পারে। বলিতে গেলে উহা আভ্যন্তরিক ব্যাধিকে প্রতিনিধিরূপে স্থানীয় ব্যাধিতে রূপান্তরিত করিয়া তথায় আকর্ষণ করিয়া রাখে। এই স্থানীয় পীড়ার উপস্থিতি কিছুকালের জন্য আভ্যন্তরিক ব্যাধিকে দমন করিয়া রাখে, যদিও তাহাকে নিরাময় করিতে বা হ্রাস করিতে পারেনা। স্থানীয় রোগ সমগ্র ব্যাধির অংশ ব্যতীত কিছুই নহে, কিন্তু সেই অংশ জীবনীশক্তি কর্তৃক কেবল একমুখী বর্ধিত অবস্থা- আভ্যন্তরিক পীড়ার প্রশমনার্থে যাহা দেহের কম মারাত্মক স্থানে ( বাহিরে ) স্থানান্তরিত হয় মাত্র। কিন্তু ( যেমন পূর্বে বলা হইয়াছে ) এই স্থানীয় লক্ষণ আভ্যন্তরিক ব্যাধির প্রশমন করিলেও সমগ্র ব্যাধির হ্রাস বা আরোগ্যকল্পে জীবনীশক্তির কিছুই লাভ হয় না। অপরপক্ষে তাহা সত্ত্বেও আভ্যন্তরিক ব্যাধি ক্রমশ বাড়িয়াই চলে এবং প্রকৃতিও স্থানীয় লক্ষণকে অধিক হইতে অধিকতর বিস্তার ও বর্ধিত করিতে বাধ্য হয় যাহাতে তাহা বর্ধিত আভ্যন্তরিক ব্যাধির পরিবর্তে যথেষ্টভাবে বিদ্যমান থাকিয়া তাহাকে দমন করিয়া রাখিতে পারে ।আভ্যন্তরিক সোরা যতদিন না আরোগ্যপ্রাপ্ত হয় ততদিন পায়ের ক্ষত খারাপের দিকে চলে, আভ্যন্তরীণ সিফিলিস আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত স্যাঙ্কার বাড়িয়াই চলে, ডুমুরাকৃতি অর্বুদসমূহ সাইকোসিস আরোগ্য প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বৃদ্ধি পাইতে ও উৎপন্ন হইতে থাকে; তাহার ফলে শেষোক্তটির আরোগ্যলাভ অধিকতর কঠিন হইয়া পড়ে, কারণ কালক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে আভ্যন্তরিক পীড়াও বাড়িয়া চলে।

🎴সূত্রঃ ২০২। সমগ্র ব্যাধি সারিয়া যাইবে এই বিশ্বাসে এখন যদি পুরাতন পন্থী চিকিৎসক বাহ্য ঔষধ প্রয়োগে স্থানীয় লক্ষণকে নষ্ট করেন তাহা হইলে আভ্যন্তরিক ব্যাধি এবং অন্যান্য লক্ষণ যাহা পূর্ব হইতে স্থানীয় লক্ষণের পাশাপাশি সুপ্ত অবস্থায় ছিল সেইগুলিকে জাগরিত করিয়া প্রকৃতি তাহার ক্ষতিপূরণ করে, অর্থাৎ আভ্যন্তরিক ব্যাধিকে বাড়াইয়া তোলে। যখন এই রূপ ঘটে তখন ইহা বলা হয়, যদি ভুলক্রমে, স্থানীয় ব্যাধিকে বাহ্য ওষুধ প্রয়োগে দেহাভ্যন্তরে কিংবা স্নায়ুযন্ত্রে ফেরত পাঠান হইয়াছে।

🎴সূত্রঃ ২০৩। এইরূপ স্থানীয় লক্ষণসমূহের প্রত্যেকটির ক্ষতিকর বাহ্য চিকিৎসা, যাহার উদ্দেশ্য হইল দেহের বহির্দেশ হইতে সেইগুলিকে দূর করা, অথচ আভ্যন্তরিক রোগবীজকে অচিকিৎসিত অবস্থায় ফেলিয়া রাখা, যেন নানাপ্রকার মলম-প্রয়োগে সোরাবীষজাত উদ্ভিদকে অপসারিত করা, কস্টিক দ্বারা উপদংশ ক্ষতকে পোড়াইয়া ফেলা, অর্বুদ গুলিকে তাহাদের স্থান হইতে ছুরিকা দ্বারা বন্ধনী বা উত্তপ্ত লৌহ শলাকা দ্বারা ধ্বংস করা- এযাবৎকাল এরূপ ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত হইয়া আসিতেছে যে তাহা মানবের যন্ত্রণাদায়ক পরিচিত-অপরিচিত সকল প্রকার চিররোগের মূল কারণ। ইহা চিকিৎসাজগতের সর্বাপেক্ষা গর্হিত অপরাধমূলক অনুষ্ঠানসমূহের অন্যতম; তথাপি ইহা সাধারণভাবে এযাবৎ গৃহীত হইয়া আসিতেছে এবং শিক্ষাকেন্দ্রসমূহ হইতে একমাত্র উপায় বলিয়া শিক্ষা দেওয়া হইতেছে।

(২৭) ক্রনিক রোগের চিকিৎসা (সূত্র-২০৪-২০৯)

🎴সূত্রঃ ২০৪। যে সকল চিররোগ দীর্ঘকালব্যাপী অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা হইতে উদ্ভূত এবং যে সকল অসংখ্য ব্যাধি যাহা প্রাচীনপন্থী চিকিৎসকগণ কর্তৃক তুচ্ছ রোগের অযৌক্তিক, পৌনঃপুনিক, বিরক্তিকর ও অনিষ্টজনক চিকিৎসা হইতে প্রায়ই উৎপন্ন, সেইগুলিকে বাদ দিলে যে চিররোগগুলি অবশিষ্ট থাকে তাহাদের অধিকাংশের মূল হইল তিনটি চিররোগজীব, আভ্যন্তরিক সিফিলিস, আভ্যন্তরিক সাইকোসিস এবং প্রধানত ও সর্বাপেক্ষা বহুল পরিমাণে আভ্যন্তরিক সোরা। প্রত্যেকটি নিজস্ব প্রাথমিক ও স্থানীয় লক্ষণ প্রকাশিত হইবার পূর্বে ( সোরার ক্ষেত্রে খোস পাঁচড়া, সিফিলিসের স্যাঙ্কার বা বাগী, সাইকোসিসের অর্বুদ ) ইহাদের প্রত্যেকটির সংক্রমণ পূর্ব হইতে সর্বদেহে বিদ্যমান থাকে ও সকল দিকে অনুপ্রবিষ্ট হয়। এই সকল চিররোগবীজঘটিত ব্যাধিসমূহের স্থানীয় লক্ষণগুলিকে যদি অপসারিত করা হয় তাহা হইলে শক্তিশালিনী প্রকৃতি কর্তৃক অনিবার্যভাবে বিকশিত হইয়া তাহারা শীঘ্র বা বিলম্বে সবেগে বাহির হইয়া পড়ে। তাহার ফলে নামহীন অগণিত দুঃখময় চিররোগ বিস্তার লাভ করিয়া শত সহস্র বৎসর ধরিয়া মানবজাতির যন্ত্রণার কারণ হইয়াছে। সেইগুলির একটিও পুনঃপুনঃ উৎপন্ন হইতে পারিত না যদি চিকিৎসকগণ যুক্তিযুক্তভাবে সেইগুলিকে নির্মূল করতে চেষ্টা করিতেন, যদি বাহ্যলক্ষণ অনুসারে স্থানীয় ঔষধ প্রয়োগ না করিয়া প্রত্যেকটির জন্য একমাত্র যথার্থ হোমিওপ্যাথিক ঔষধের আভ্যন্তরিক প্রয়োগের উপর আস্থা রাখিয়া এই তিনটি রুক অফিসকে দেহাভ্যন্তরে বিনষ্ট করিতে পারিতেন।

🎴সূত্রঃ ২০৫। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক চিররোগবীজঘটিত প্রাথমিক লক্ষণসমূহের একটিকে ধরিয়া বা তাহাদের অধিকতর পরিণতিজনিত গৌণ রোগগুলির কোনটিকে লইয়া বাহ্য ওষুধ প্রয়োগে (এমনকি যে সকল বাহ্যবস্তু সূক্ষ্মভাবে কার্য করে তাহাদের দ্বারাও নহে, আবার যেগুলি স্থূলভাবে কার্যকরী তাহাদের দ্বারাও নহে ) কখনও চিকিৎসা করেন না। যে প্রধান রোগবীজকে অবলম্বন করিয়া যখন যেটি আবির্ভূত হয় সেই গুরুত্বপূর্ণ রোগবীজেরই তাহারা চিকিৎসা করিয়ে থাকেন। তাহার ফলে সেটির প্রাথমিক ও গৌণ লক্ষণগুলি আপনা হইতেই তিরোহিত হয়। কিন্তু হায়! পূর্ববর্তী পুরাতনপন্থী চিকিৎসকগণ এই পন্থা অনুসরণ করেন নাই বলিয়া পরবর্তী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক দেখেন যে প্রাথমিক লক্ষণগুলিকে বাহ্য ওষুধ ব্যবহারের পূর্বেই নষ্ট করা হইয়াছে এবং তখন তাহাকে গৌণ লক্ষণ লইয়া বেশি কাজ করিতে হইবে। অর্থাৎ সেই সকল লক্ষণ লইয়া যেগুলি অন্তর্নিহিত রোগবীজের বহিঃস্ফূরণ ও বিকাশ হইতে উৎপন্ন, বিশেষত সেই সকল চিররোগ যাহা অন্তর্নিহিত সোরা উৎপন্ন এবং যাহাদের আভ্যন্তরিক চিকিৎসা, যাহা কোন চিকিৎসকের পক্ষে বহু বর্ষব্যাপি একক মননশীলতা, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দ্বারা পরিস্ফুট হওয়া সম্ভব- তাহাই আমি আমার ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থে নির্দেশ দিবার চেষ্টা করিয়াছি। তাহা আমার পাঠকগণকে দেখিতে বলি।

🎴সূত্রঃ ২০৬। কোন চিররোগ চিকিৎসা শুরু করিবার পূর্বে বিশেষ সতর্কতার সহিত অনুসন্ধান করা আবশ্যক রোগীর কোন যৌনব্যাধি হইয়াছিল কিনা (কিংবা যে অর্বুদযুক্ত গনোরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিল কিনা) তাহা হইলে, যখন কেবল সিফিলিসের লক্ষণ কিংবা বিরল ক্ষেত্রে অর্বুদযুক্ত রোগলক্ষণ বিদ্যমান থাকে তখন কেবল সেইদিকে লক্ষ্য করিয়া চিকিৎসা পরিচালিত করিতে হইবে, যদিও আজকাল এই রোগ এককভাবে কদাচিৎ দেখা যায়। এইরূপ সংক্রমণ যদি পূর্বে ঘটিয়া থাকে তাহা হইলে সোরাগ্রস্ত রোগীর চিকিৎসা করিবার সময়ে সে কথা মনে রাখিতে হইবে কারণ তাহার সহিত সোরা জড়িত থাকে এবং সেই সকল ক্ষেত্রে কেবল সিফিলিসের লক্ষণ পাওয়া যায় না। ইহার কারণ, চিকিৎসক যখনই কোনো পুরাতন যৌনব্যাধির রোগী পান তখনই তাহাকে সর্বক্ষেত্রে কিংবা প্রায়ই সিফিলিসরোগের সহিত সোরাযুক্ত রোগের চিকিৎসা করতে হয়, কারণ, আভ্যন্তরিক কন্ডুয়নপ্রবণতা ( সোরাবীজ ) অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিররোগসমূহের জনক। চিররোগগ্রস্ত দেহে কখনও কখনও উভয় রোগবীজই সাইকোসিস সঙ্গে জড়িত থাকিতে পারে, কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইরূপ প্রায় দেখা যায় যে সোরাই অন্যান্য রোগের একমাত্র মূল কারণ, নাম যাহাই হউক না। উপরন্তু সেইগুলির প্রায়ই এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অপটুতা হেতু ভীষণভাবে বিকৃত, বর্ধিত ও কদর্যরূপে পরিবর্তিত করা হয়।

🎴সূত্রঃ ২০৭। এই সকল বিষয় জানিবার পর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে আরো জানিতে হইবে যে সেই দিন অবধি ঐ চিররোগের কি প্রকার এলোপ্যাথিক চিকিৎসা করা হইয়াছে, প্রধানত কি প্রকার বিকৃতিজনিত ঔষধ অধিক দিন ধরিয়া প্রয়োগ করা হইয়াছে, কি প্রকার খনিজ প্রস্রবণে স্নান করিয়াছে এবং তাহার ফলই বা কি হইয়াছে। এই সকল বিষয় দ্বারা রোগের মূল অবস্থা হইতে অবনতি কিছু পরিমাণে বুঝিয়ে পারা যাইবে। সম্ভবস্থলে এই সকল প্রক্রিয়ার অংশত সংশোধন করা যাইতে পারে কিংবা যে সকল ঔষধ পূর্বে অযথা ব্যবহার করা হইয়াছে সেইগুলো বর্জন করা যাইতে পারে।

🎴সূত্রঃ ২০৮। রোগীর বয়স, তাহার আহারবিহার, বৃত্তি, সাংসারিক পদমর্যাদা, সামাজিক আত্মীয়কুটুম্বিতা প্রভৃতি তারপর পর বিবেচনা করিতে হইবে। এইগুলি তাহার রোগ বৃদ্ধির কারণ কি না কিংবা উহা চিকিৎসার পক্ষে কতখানি সহায়ক বা প্রতিবন্ধক তাহা নির্ধারণ করা যাইতে পারে। এইরূপভাবে তাহার প্রকৃতি ও মানসিক অবস্থা সম্বন্ধেও মনোযোগী হইতে হইবে, যাহাতে বুঝিতে পারা যায় উহা চিকিৎসায় বাধাপ্রদান করিতেছে কি না বা তাহাকে পরিচালনা করা, উৎসাহ প্রদান করা অথবা নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়োজন আছে কি না।

🎴সূত্রঃ ২০৯। ইহা করা হইলে রোগীর সহিত পুনঃ পুনঃ কথাবার্তার ভিতর দিয়া চিকিৎসকে, পূর্ববর্ণিত নির্দেশ অনুসারে, যথাসম্ভব রোগের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করিতে হইবে, যাহাতে বিশিষ্ট পরিচায়ক লক্ষণগুলি স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে উঠে। তদানুসারে তিনি প্রথম সোরাবিষঘ্ন কিংবা সদৃশতম অন্য কোন ঔষধ নির্বাচন করিয়া চিকিৎসা শুরু করিতে ও তাহা চালাইয়া যাইতে পারেন। সৃষ্টি করিয়া তাহা চালাইয়া যাইতে পারে।

(২৮) মানসিক ব্যাধি ও ইহার চিকিৎসা (সূত্র-২১০-২৩০)

🎴সূত্রঃ ২১০। পূর্বে যে সকল ব্যাধিকে একতরফা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছি তাঁহাদের প্রায় সকলগুলিই সোরা হইতে উদ্ভূত। একতরফা লক্ষণের জন্য সেগুলিকে নিরাময় করা অপেক্ষাকৃত কঠিন ব্যাপার, একটিমাত্র প্রধান ও সুস্পষ্ট লক্ষণকে সম্মুখে রাখিয়া অন্য সব রোগলক্ষণ যেন অন্তর্হিত হয় । যেগুলিকে মানসিক ব্যাধি বলা হয় সেগুলিও এই ধরনের। অন্যসব ব্যাধি হইতে পৃথক করিয়া তাহাদিগকে বিশেষ কোনো এক শ্রেনীভুক্ত বলিয়া গণ্য করা হয় না, কারণ তথাকথিত অন্যান্য শারীরিক ব্যাধিগুলিরও সকল ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও মনের অবস্থা পরিবর্তিত হয় এবং যে সকল রোগী চিকিৎসার জন্য আসে তাহাদের সকল ক্ষেত্রেই যদি একটি যথার্থ চিত্র অঙ্কিত করিয়া হোমিওপ্যাথিক মতে চিকিৎসা দ্বারা সাফল্য লাভ করিতে হয় তাহা হইলে রোগীর ধাতুপ্রকৃতি ও তৎসহ লক্ষণসমষ্টি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিতে হইবে।

🎴সূত্রঃ ২১১। ইহা এতদূর সত্য যে মুখ্যত রোগীর প্রকৃতিই অনেক সময়ে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচনে নির্দেশ প্রদান করে। কারণ, নিশ্চিতভাবে একটি পরিচারক লক্ষণ বলিয়া তাহা যথার্থ পর্যবেক্ষনকারী চিকিৎসকের নিকট সর্বাপেক্ষা কম লুক্কায়িত থাকিতে পারে।

🎴সূত্রঃ ২১২। রোগনিরাময়কারী বস্তুসমূহের স্রষ্টা ব্যাধিসমূহের প্রকৃতি ও মনের পরিবর্তনরূপ এই প্রধান বিষয়ের প্রতি বিশেষ মর্যাদা দান করিয়াছেন। কারণ জগতে এমন কোনো শক্তিশালী ভেষজ নাই যাহা পরীক্ষণকারী সুস্থ ব্যক্তির প্রকৃতি ও মনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন না করিতে পারে। প্রত্যেকটি ঔষধই বিভিন্ন প্রণালীতে তাহা করিয়া থাকে।

🎴সূত্রঃ ২১৩। অতএব আমরা কখনই প্রকৃতির অনুগামী হইয়া অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিক মতে আরোগ্য সাধন করিতে সমর্থ হইব না যদি আমরা প্রত্যেকে রোগীর ক্ষেত্রে, এমন কি অচিররোগেও অন্যান্য লক্ষণের সহিত মন ও প্রকৃতির পরিবর্তন সম্পর্কিত লক্ষণ পর্যবেক্ষণ না করি এবং যদি আমরা রোগীর আরোগ্যের জন্য ওষুধাবলীর মধ্য হইতে এমন একটি রোগ উৎপাদিকা শক্তি নির্বাচন না করি যাহা রোগের অন্যান্য লক্ষণের সহিত সদৃশ হওয়া ছাড়াও প্রকৃতি ও মনের ঠিক অনুরূপ অবস্থা উৎপন্ন করিতে পারে।

🎴সূত্রঃ ২১৪। মানসিক ব্যাধির আরোগ্যবিধান সম্পর্কে আমার যে উপদেশ দিবার আছে তাহা অল্পকথায় বলা যাইতে পারে যে, অন্যান্য রোগের মতোই তাহাদেরও একই প্রকার চিকিৎসাব্যবস্থা যথা, এমন একটি ঔষধ দ্বারা যাহার আর সুস্থ ব্যক্তির দেহে ও মনে রোগীর প্রায় সদৃশ পীড়া উৎপাদন করিবার শক্তি আছে। আর অন্য কোন উপায়েই আরোগ্য সম্ভব নহে।

🎴সূত্রঃ ২১৫। তথাকথিত মানসিক ও চিত্তাবেগ সম্পর্কিত প্রায় সকল রোগ শারীরিক ব্যাধি ছাড়া আর কিছুই নহে। ইহাতে প্রত্যেকটির বৈশিষ্ট্য অনুসারে মন ও প্রকৃতিগত বিশৃংখলার লক্ষণই বড় হইয়া উঠে । দৈহিক লক্ষণগুলি ( অল্পাধিক দ্রুতভাবে ) কমিয়া যায় এবং অবশেষে তারা একতরফার বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হয় । তখন তাহা যেন মন বা প্রকৃতির অদৃশ্য সূক্ষ্মযন্ত্রে একটি স্থানীয় ব্যাধি।

🎴সূত্রঃ ২১৬। এরূপ ক্ষেত্র বিরল নহে যেখানে তথাকথিত দৈহিক রোগ- যাহা মারাত্মকরূপে ভীতিজনক যেমন, ফুসফুসে পুঁজ জমা বা অন্য কোন প্রধানযন্ত্রের ক্ষয়ক্ষতি কিংবা অচির প্রকৃতির অন্য কোন রোগ যেমন, প্রসবসম্বন্ধীয়- উন্মত্ততা, একরূপ বিষাদ অবস্থা বা একটা বাতিকে রূপান্তরিত হয় যেখানে পূর্ব হইতে কতকগুলি মানসিক লক্ষণ থাকে যাহার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে ও শারীরিক লক্ষণগুলির বিপদজ্জনক অবস্থা কাটিয়া যাই; পরে প্রায় পূর্ণ স্বাস্থ্য লাভ করে বা লক্ষণগুলি এইরূপ পরিমাণে হ্রাস পায় যে তাহাদের প্রচ্ছন্ন অবস্থিতি কেবলমাত্র অধ্যবসায়শীল ও সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণেই ধরা পড়ে। এইভাবে সেগুলি একতরফা অবস্থায় এবং এমন একটি স্থানীয় ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয় যাহাতে মানসিক বিকৃতির লক্ষণ, যাহা পূর্বে অল্পই ছিল ক্রমশ বৃদ্ধি পাইয়া প্রধান লক্ষণরূপে প্রকাশিত হয় এবং বহুল পরিমানে অন্যান্য (শারীরিক) লক্ষণের তীব্রতাকে সাময়িকভাবে উপশমিত করিয়া তাহাদের স্থান অধিকার করিয়া বসে। সংক্ষেপে বলিতে গেলে, দেহযন্ত্রের স্থূল পীড়াগুলি যেন সূক্ষ্ম মনোময় ক্ষেত্রে এবং আবেগপ্রধান যন্ত্রগুলিতে পরিচালিত হয়, যাহার সন্ধান শরীরস্থানবিদগণ তাহাদের ছুরিকার সাহায্যে এখনো পান নাই এবং কখনো পাইবেন না।

🎴সূত্রঃ ২১৭। এই সকল ব্যাধিতে দৈহিক লক্ষণ এবং আরও বিশেষ করিয়া মন ও প্রকৃতি ঠিকমতো বুঝিবার পক্ষে তাহার প্রধান লক্ষণের বৈশিষ্ট্যসম্পর্কিত সমগ্র ঘটনার সহিত আমাদের মনোযোগের সহিত পরিচিত হইতে হইবে যাহাতে সমগ্র ব্যাধিকে ধ্বংস করিবার জন্য যে সকল ঔষধের বিশুদ্ধ গুনাগুন জানা আছে তাহাদের মধ্য হইতে সদৃশধর্মী রোগউৎপাদিকা ভূমিকা একটি ভেষজ শক্তি নির্ধারণ করা যায় এমন একটি ঔষধ লক্ষণ তালিকায় আমাদের চিকিৎসাধীন রোগীর শুধু শারীরিক নয় মানসিক আবেগ প্রধান অবস্থাও সর্বাধিক প্রকটিত হয়।

🎴সূত্রঃ ২১৮। এই লক্ষণসংগ্রহের মধ্যে প্রথমত থাকিবে একতরফা মানসিক লক্ষণ বৃদ্ধি পাইয়া মানসিক রোগ ও স্বভাবে পরিণত হইবার পূর্বের তথাকথিত শারীরিক রোগের সমগ্র ঘটনাবলির যথাযথ বর্ণনা। ইহা রোগীর বন্ধু-বান্ধবগণের নিকট হইতে জানা যাইতে পারে।

🎴সূত্রঃ ২১৯। সেই সকল পূর্ববর্তী শারীরিক রোগের লক্ষণের সহিত অবশিষ্ট যাহা কিছু তখনও আছে, যদিও সে সকলের অনুভূতি অনেক পরিমাণে হ্রাসপ্রাপ্ত ( কিন্তু যাহা তখনও কোন কোন সময়ে যখন প্রকৃতিস্থ অবস্থা আসে এবং মানসিক রোগের সাময়িক প্রশমন ঘটে তখন প্রাধান্য লাভ করে) তাহার তুলনা করিলে ইহা প্রমাণিত হয় যে যদিও অস্পষ্ট তথাপি তখনও তাহারা বিদ্যমান।

🎴সূত্রঃ ২২০। চিকিৎসক এবং রোগীর বন্ধুগণ কর্তৃক যথার্থভাবে পরিলক্ষিত মন ও স্বভাব ইহার সহিত যোগ করিলে রোগের একটি পূর্ণাঙ্গচিত্র রচনা করা যাইবে।হোমিওপ্যাথি মতে ইহার আরোগ্য সাধনের জন্য সোরাবিষঘ্ন ঔষধসমূহের মধ্য হইতে এমন একটি ঔষধের অনুসন্ধান করিতে হইবে যাহা যথাযথ সদৃশ লক্ষণ, বিশেষত অনুরূপ মানসিক বিকৃতি- যদি মানসিক ব্যাধি বহুদিন ধরিয়া চলিয়া থাকে- উৎপন্ন করিতে সমর্থ।

🎴সূত্রঃ ২২১। কিন্তু যদি রোগীর সাধারণ শান্ত অবস্থায় হঠাৎ উন্মত্ততা কিংবা বাতিক ( ভয়, বিরক্তি, সূরার অপব্যবহারে প্রভৃতি হইতে উৎপন্ন) অচিররোগরূপে দেখা দেয়, যদিও তাহা প্রায় ক্ষেত্রে অগ্নিশিখার মতো অন্তর্হিত সোরা হইতে উদ্ভূত, তথাপি যখন তাহা তীব্রভাবে আসে তখনই তাহাকে সোরাদোষঘ্ন ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা করা উচিত নহে; প্রথমে অন্য শ্রেণীর পরীক্ষিত ( যথা একোনাইট, বেলেডোনা, স্ট্রামোনিয়াম, মার্কারি প্রভৃতি ) উচ্চশক্তির হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ক্ষুদ্র মাত্রায় প্রয়োগ করা উচিত যাহাতে সাময়িকভাবে সোরা দমিত হইয়া পূর্বের সুপ্ত অবস্থায় ফিরিয়া আসে এবং রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলিয়া বোধ হয়।

🎴সূত্রঃ ২২২। কিন্তু সোরাবিষনাশক নহে এইরূপ ওষুধ ব্যবহারে মানসিক বা চিত্তাবেগজনিত পীড়ার তীব্র অবস্থা সারিয়া গেলেও রোগী আরোগ্যলাভ করিয়াছে মনে করা কখনই উচিত নহে। বরং সুদীর্ঘকাল সোরাদোষনাশক চিকিৎসার দ্বারা যাহাতে তাহাকে পুরাতন সোরাবিষ হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত করা যায় সেইজন্য একটুও সময় নষ্ট করা উচিত নহে। সোরাদোষ তখন সুপ্ত হইয়া গিয়াছে সত্য, কিন্তু যে কোনো সময়ে নূতন করিয়া তাহা আবির্ভূত হতে পারে। ইহা করা হইলে আর পুনরাক্রমণের ভয় থাকে না, যদি রোগী তাহার পথ্যাদির বিধিব্যবস্থা ঠিকমতো মানিয়া চলে।

🎴সূত্রঃ ২২৩। কিন্তু যদি সোরাবিষঘ্ন চিকিৎসা করা না হয় তাহা হইলে মানসিক বিকৃতির প্রথম কারণ অপেক্ষা তূচ্ছতর কারণে আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং অধিকতর প্রচণ্ড দ্রুত নূতন আক্রমণ ঘটিবে ইহা আমরা প্রায় নিশ্চিত অনুমান করতে পারি। তখন সোরা প্রায় সম্পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়া সাময়িক কিংবা স্থায়ী মানসিক ব্যধিরূপে পরিণত হয় এবং তখন তাহাকে সোরাবিষঘ্ন ঔষধ দ্বারা আরোগ্য করা অধিকতর কঠিন হয়।

🎴সূত্রঃ ২২৪। মানসিক রোগের যদি সম্পূর্ণভাবে না হইয়া থাকে এবং প্রকৃত শারীরিক ব্যাধি হইতে উৎপন্ন অথবা শিক্ষার দোষ, কুঅভ্যাস, দুর্নীতি, অসংযম, কুসংস্কার বা অজ্ঞতার ফল হইতে উদ্ভূত সেই বিষয়ে যদি সন্দেহ থাকে, তাহা হইলে সিদ্ধান্তে আসিবার জন্য যদি তারা পরবর্তী কারণগুলির মধ্যে কোন একটি হইতে ঘটিয়া থাকে তবে যুক্তিপূর্ণ সহৃদয় অনুরোধ, সান্তনাপূর্ণ প্রতিবাদ, গাম্ভীর্যপূর্ণ আবেদন এবং উপযুক্ত পরামর্শ দ্বারা তাহা প্রশমিত বা সংশোধিত হইবে। কিন্তু সত্যিকার নৈতিক বা মানসিক ব্যাধি যাহা শারীরিক ব্যাধি হইতে উদ্ভূত তাহা অনুরূপ অবস্থায় দ্রুত বৃদ্ধি পাইবে । বিষন্ন রোগী অধিকতর বিষাদগ্রস্ত, কলহপ্রিয় অপ্রবোধনীয় এবং তূষ্ণীভাব বিশিষ্ট হইবে ; বিদ্বেষপরায়ণ উন্মাদ তদ্দারা অধিকতর কুপিত এবং বাচাল নির্বোধের বোকামি আরো বেশি প্রকটিত হইবে।

🎴সূত্রঃ ২২৫। এমন কতকগুলি সুনিশ্চিত চিত্তাবেগপূর্ণ রোগ আছে, যেগুলির কথা ইতোপূর্বে বলা হইয়াছে, যাহা কেবল দৈহিক পীড়া হইতে উদ্ভূত হইয়া ঐ অবস্থায় পরিণত হয় নাই। বরং শরীর একটু অসুস্থ অবস্থায় থাকায় সেইগুলি বিপরীতভাবে আবেগমূলক কারণসমূহ হইতে, এমন অবিরত উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, বিরক্তি, অন্যায় এবং পুনঃপুনঃ বিষম আশঙ্কা ও ভীতিযুক্ত ঘটনা হইতে উদ্ভূত হয় ও বজায় থাকে। এই প্রকার আবেগপ্রধান রোগ সময় দৈহিক স্বাস্থ্যকে নষ্ট করিয়া দেয় এবং তাহা প্রায়ই অধিক পরিমাণে করে।

🎴সূত্রঃ ২২৬। কেবলমাত্র এই প্রকার আবেগপ্রধান ব্যাধিসমূহ, যেগুলির মন হইতে উৎপত্তি ও মনেই স্থিতি, যদি অল্পদিনের হয় এবং দৈহিক অবস্থার বিশেষ ক্ষতিসাধন না করিয়া থাকে, তাহা হইলে মনস্তাত্ত্বিক বিধানসমূহদ্বারা যথা, আশ্বাসপ্রদান, বন্ধুত্বপূর্ণ আবেদন, যুক্তিপূর্ণ পরামর্শ এবং অনেক ক্ষেত্রে সুসম্পাদিত প্রচ্ছন্ন ছলনা দ্বারা দ্রুত সুস্থ মানসিক অবস্থা ফিরাইয়া আনা যাইতে পারে ( এবং তাঁহার সহিত উপযুক্ত আহারবিহারের ব্যবস্থা দ্বারা দৃশ্যত দেহের সুস্থভাবেরও পুনরানয়ন সম্ভব)।

🎴সূত্রঃ ২২৭। কিন্তু এই সকল ক্ষেত্রেও মূল কারণ হইল সোরা, যদিও তাহা কখনো পূর্ণ বিকাশের অবস্থা লাভ করে নাই। সাবধানতার জন্য আপত নীরোগ সেই রোগী পুনরায় যাহাতে ঐরূপ মানসিক রোগগ্রস্থ না হয়, যাহা সহজেই ঘটিতে পারে, তাহাকে নির্মূলকারী সোরাদোষনাশক চিকিৎসার অধীনে রাখা উচিত ।

🎴সূত্রঃ ২২৮। শারীরিক ব্যাধি হইতে উৎপন্ন মানসিক এবং চিত্তাবেগপ্রধান রোগসমূহে- যাহা কেবলমাত্র হোমিওপ্যাথিক সেরাদোষনাশক ওষুধ প্রয়োগে ও তাহার সহিত জীবনযাত্রাকে সুবিন্যস্ত করিয়া নিরাময় করা সম্ভব- সাহায্যকারী বিধিব্যবস্থারূপে চিকিৎসক এবং রোগীর সঙ্গীগণের রোগীর প্রতি উপযুক্ত মনস্তাত্ত্বিক আচরণ সাবধানতার সহিত রক্ষা করা অবশ্যই কর্তব্য। প্রচন্ড উন্মত্ততার সম্মুখে অবিচল সাহস, শান্ত ও দৃঢ় সংকল্প, বিষণ্ন ও অসন্তুষ্ট খেদোক্তির সম্মুখে দৃষ্টি ও ইঙ্গিতে সমবেদনা, অর্থহীন বাচালতায় সম্পূর্ণ অবহেলা না দেখাইয়াও নির্বাক ভাব, বিরক্তিকর ও ঘৃণার্হ ব্যবহারে এবং ঐরূপ কথাবার্তায় সম্পূর্ণ অবহেলা প্রদর্শন করা উচিত। রোগীকে তাহার আচরণের জন্য তিরস্কার না করিয়া আমরা কেবল চারিপাশের দ্রব্যাদির নষ্ট ও ক্ষতি নিবারণ করিবার চেষ্টা করিব। সবকিছু এমনভাবে সাজাইয়া রাখিতে হইবে যাহাতে দৈহিক শাস্তি দিবার বা উৎপীড়ন জাতীয় কিছু করার প্রয়োজন না হয়। এইটুকু অনেক সহজেই সম্পন্ন করা যায় কারণ, ওষুধপ্রয়োগই একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে বলপ্রয়োগ করা সংগত হইতে পারে, কিন্তু সেস্থলে উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের স্বল্পমাত্রা স্বাদগ্রাহ্য নহে বলিয়া রোগের অজ্ঞাতে তাহার পানীয়ের সঙ্গে দেওয়া যাইতে পারে, সুতরাং বলপ্রয়োগের দরকার হয় না।

🎴সূত্রঃ ২২৯। আবার এই প্রকার রোগীদের নিকট প্রতিবাদ, সাগ্রহে বুঝান, রূঢ়ভাবে দোষ সংশোধন ও কটুক্তি করা যেমন অচল, তেমনি দুর্বলতা প্রদর্শন ও ভয়ে নতি স্বীকার করারও কোন স্থান নাই। দুইটিই মানসিক ও চিত্তাবেগজনিত রোগের চিকিৎসায় সমান ক্ষতিকর। এইরূপ রোগীরা প্রায় সকলেই ঔদ্ধত্য, ছলনা ও প্রতারণা ধরিতে পারিলে চটিয়া যায় ও তাহাদের রোগ বৃদ্ধি পায়। তাহাদের যে বুদ্ধিবিবেচনা আছে ও তাহাদের বিশ্বাস করিতেছেন এইরূপ ভান লইয়া চিকিৎসক ও রক্ষীকে সর্বদা চলিতে হইবে। তাহাদের অনুভূতি ও প্রকৃতির পক্ষে বিরক্তিকর সকল বাহ্যপ্রভাব সম্ভবমতো সরাইয়া দেওয়া উচিত। তাহাদের বিষাদময় মন ও মেজাজের জন্য তাহাদের নিকট কোন আমোদ-প্রমোদ উপভোগ্য নহে। একমাত্র আরোগ্যলাভ ছাড়া কোন হিতকর আকর্ষণ, কোন প্রকার পরামর্শ, মনোরম আলাপ-আলোচনা, পুস্তক বা অন্যকিছু তাহাদের ক্ষুব্ধ ও পীড়িত দেহে শৃঙ্খলিত অন্তরাত্মার নিকট প্রাণবন্ত বোধ হয় না। দৈহিক স্বাস্থ্যের যখন ক্রমোন্নতি হয় তখনই শান্তি ও আরামের আলোকরশ্মি তাহাদের মনে প্রতিফলিত হয়।

🎴সূত্রঃ ২৩০। মানসিক ও চিত্তাবেগজনিত রোগের প্রত্যেকটি বিশিষ্ট ক্ষেত্রে (যারা অবিশ্বাস্যরূপে বহু প্রকারের) নির্বাচিত সোরাদোষনাশক ঔষধসমুহ যদি হোমিওপ্যাথি মতে যথাযথভাবে নিরূপিত রোগচিত্রের উপযুক্ত হয় যাহা সম্ভব হইবে যদি এই প্রকারের যথেষ্ট সংখ্যক ওষুধের গুনাগুন জানা থাকে তাহা হইলে সর্বাধিক উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের জন্য অক্লান্ত অনুসন্ধান আরও সহজে করা যায়। যখন আবেগ ও মানসিক অবস্থা এইরূপ রোগীর মুখ্য লক্ষণ তখন তাহা এত নির্ভুলভাবে বুঝিতে পারা যায় যে অবিলম্বে বিশেষ উন্নতির লক্ষণ– যাহা অনুপযুক্ত এলোপ্যাথিক ঔষধের বৃহত্তম মাত্রা রোগীকে আমরন পুনঃপুনঃ প্রয়োগ দ্বারাও আনা যায় না—লক্ষ্য করা যায়। বস্তুত বহু অভিজ্ঞতার ফলে আমি বিশ্বস্তভাবে নিশ্চয় করিয়া বলিতে চাই যে, দৈহিক পীড়া হইতে উদ্ভূত কিংবা তাহার সহিত বিকাশপ্রাপ্ত দীর্ঘদিনের মানসিক ও আবেগজনিত পীড়ায় হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতির যে শ্রেষ্ঠ সাফল্যের গৌরব তাহা, আমার ধারণার মধ্যে অন্যান্য যে সকল চিকিৎসাপদ্ধতি আছে , তাহাদের কোনোটিতে নাই।

(২৯) সবিরাম রোগ (সূত্র-২৩১-২৩৫)

🎴সূত্রঃ ২৩১। সবিরাম ব্যাধিসমূহ এবং যে সকল ব্যাধি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পুনঃপুনঃ দেখা দেয় যেমন, বহু প্রকারের সবিরাম জ্বর এবং সবিরাম জ্বরের মতো যে সকল বাহ্যতে জ্বরবিহীন ব্যাধি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পুনঃপুনঃ হয় এবং সেই সকল ব্যাধিও যেগুলি অনির্দিষ্ট সময় অন্তর এক এক প্রকারের লক্ষণ লইয়া পর্যায়ক্রমে আসে– সেই সকল বিশেষভাবে আলোচনার যোগ্য।

🎴সূত্রঃ ২৩২। শেষোক্ত প্রকারের পর্যায়শীল ব্যাধিসমূহ সংখ্যাতেও অনেক কিন্তু সেইগুলি শ্রেণীভুক্ত। সেইগুলি সাধারণত সোরারই পূর্ণ বিকাশ মাত্র, ক্বচিৎ কখনো সিফিলিসের সঙ্গে জটিলতা প্রাপ্ত হয় এবং সেইজন্য পূর্বোক্ত ক্ষেত্রে সোরাদোষনাশক ওষুধ দ্বারা আরোগ্য করা যায় এবং শেষোক্ত ক্ষেত্রে ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থে আমার উপদেশ অনুযায়ী সিফিলিসদোষনাশক ওষুধের পর্যায়ক্রমে ব্যবহার দ্বারা আরোগ্য করা যায়।

🎴সূত্রঃ ২৩৩। সেইগুলিই হইল খাঁটি সবিরাম ব্যাধি যেখানে অপরিবর্তিত লক্ষণ প্রায় নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ফিরিয়া আসে, সেই সময়ের মধ্যে রোগী আপত সুস্থ অবস্থায় থাকে এবং সেইরূপ একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেই রোগাবস্থা অন্তর্হিত হয়। বাহ্যত জ্বরবিহীন রোগলক্ষণ যেগুলি কোন কোন সময়ে পর্যায়বৃত্তভাবে আসে যায় এবং সেই সকল জ্বর যেমন নানা প্রকারের সবিরাম জ্বর, তাহাদের ক্ষেত্রে এইরূপ দেখা যায়।

🎴সূত্রঃ ২৩৪। যে সকল বাহ্যত জ্বরবিহীন বিশিষ্ট পর্যাবৃত্ত রোগলক্ষণের কথা এখন বলা হইল যাহা একসময়ে একটিমাত্র রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় ( ইহা বিক্ষিপ্তভাবে বা মহামারীরূপে দেখা যায় না ), তাহা সর্বদাই সোরাদোষগ্রস্ত চিররোগের অন্তর্ভুক্ত, কদাচিৎ সিফিলিসের সঙ্গে জড়িত দেখা যায় এবং একই পন্থায় সাফল্যের সহিত চিকিৎসা করা। তথাপি তাহাদের পর্যায়ক্রমিক আবির্ভাব সম্পূর্ণভাবে রোধ করার জন্য সিঙ্কোনাছালের শক্তিকৃত দ্রবের একটি ক্ষুদ্র মাত্রা কখনো কখনো অন্তর্বর্তীকালীন ওষুধরূপে ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়।

🎴সূত্রঃ ২৩৫। যেসকল সবিরাম জ্বর বিক্ষিপ্তভাবে কিংবা মহামারী রূপে দেখা (জলাভূমি অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে যেগুলি দেখা যায় সেগুলি নহে) তাহাদের প্রত্যেক আক্রমণে দুইটি বিপরীত পর্যায়শীল অবস্থা (শীত, উত্তাপ–উত্তাপ, শীত), অধিকাংশ সময়ে তিনটি ও (শীত, উত্তাপ, ঘর্ম ) লক্ষ্য করা যায়। সেইজন্য পরীক্ষিত অসৎ সমূহের সাধারণ শ্রেণী (সোরাদোষঘ্ন ছাড়া অন্য কিছু) হইতে নির্বাচিত ঔষুধের (এবং এই প্রকার ঔষধি সুনিশ্চিত) সুস্থ শরীরে দুইটি (বা তিনটিই) অনুরূপ পর্যায় শীল অবস্থা সম্পাদন করিবার ক্ষমতা থাকা চাই কিংবা সদৃশ লক্ষণ অনুসারে সর্বাপেক্ষা সুচিহ্নিত, প্রবলতম ও বিশিষ্ট পর্দাশীল অবস্থার সহিত (আনুষাঙ্গিক লক্ষণ সহ প্রত্যেকটির শীত, উত্তাপ কিংবা ঘর্মাবস্থা যেটি সবচেয়ে প্রবল ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ) মিল থাকা চাই। কিন্তু রোগীর বিজ্বর অবস্থার লক্ষণসমূহই সর্বাধিক উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচনের প্রধান নির্দেশক।

(৩০) ঔষধ প্রয়োগের সময় (সূত্র-২৩৬-২৪৪)

🎴সূত্রঃ ২৩৬। এই সকল ক্ষেত্রে ঔষধ প্রয়োগের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ও কার্যকরী সময় হইল আক্রমণ শেষ হইবামাত্র কিংবা তাহার অতি অল্পক্ষণ পরেই, যখন রোগী কিয়ৎ পরিমাণে সুস্থবোধ করিয়াছে। স্বাস্থ্য পুনরানয়নের জন্য যে সকল পরিবর্তন সাধন করিবার প্রয়োজন তাহা তখন করিবার সময়। তাহাতে বেশি কিছু গোলযোগ বা প্রবল আলোড়ন হয়না। পড়ন্তু খুব উপযুক্ত ঔষধ ও যদি আক্রমণের পূর্বে প্রয়োগ করা হয় তাহা হইলে ওষুধের ক্রিয়া পীড়ার স্বাভাবিক গতির সহিত মিলিত হইয়া দেহে এরূপ প্রতিক্রিয়া ও প্রচণ্ড বিক্ষোভ আনে যে সেই জাতীয় আক্রমণে জীবনহানি না হইলেও অত্যন্ত বলহানি হয়। কিন্তু ঔষধ যদি বৃদ্ধির শেষে, অর্থাৎ যখন জ্বর বিচ্ছেদ হইয়াছে এবং পরবর্তী আক্রমণ শুরু হইতে বহু বিলম্ব আছে সেই সময়ে দেওয়া হয় তাহা হইলে দেহের জীবসত্তা ঔষধ দ্বারা শান্তভাবে পরিবর্তিত হইবার সর্বোত্তম সুযোগ লাভ করে এবং এইরূপে পুনরায় সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়া আসে।

🎴সূত্রঃ ২৩৭। কিন্তু বিজ্বর অবস্থা যদি খুব সংক্ষিপ্ত হয় যেমন কতকগুলি অতি দুষ্ট জ্বরে ঘটে বা পূর্ববর্তী আক্রমণের পরবর্তী যন্ত্রণা ভোগ দ্বারা তাহা বিঘ্নিত হয় তাহা হইলে ঘাম কমিয়া আসিতে থাকিলে বা বিলীয়মান আক্রমণের পরবর্তী অবস্থাগুলি হ্রাস পাইতে থাকিলে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করা কর্তব্য।

🎴সূত্রঃ ২৩৮। উপযুক্ত ঔষধ এর কেবল একমাত্র সচরাচর পীড়ার কতকগুলি আক্রমণ বন্ধ করিয়া দিতে পারে এবং স্বাস্থ্যকে ফিরাইয়া আনিতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি আক্রমণের শেষে একমাত্রা করিয়া ঔষধ দিতে হইবে। আরও ভালো হয় লক্ষণের প্রকৃতির পরিবর্তন না হওয়াকালীন যদি সেই ঔষধই পুনঃ প্রয়োগের নূতন নিয়মানুসারে (২৭০ সূত্রের পাদটীকা দ্রষ্টব্য) ঔষধপূর্ণ শিশিটিকে প্রত্যেক পরবর্তী মাত্রা প্রয়োগের সময় দশ-বারো বার ঝাঁকি দিয়া শক্তিকৃত করিয়া দেওয়া হয়। তথাপি সময়ে সময়ে এরূপ ক্ষেত্র আসে, যদিও তাহা বিরল, যেখানে কিছুদিন ভালো থাকার পর সবিরাম জ্বর আবার ফিরে আসে।রোগী সুস্থ থাকার পর একই জ্বরের এইরূপ প্রত্যাবর্তন কেবলমাত্র সম্ভবপর হয় সেখানে যে দূষিত কারণে জ্বরের প্রথম সূত্রপাত তাহা যদি সদ্যোরোগমুক্ত রোগীর উপর ক্রিয়া করিতে থাকে, যেমন জলাভূমি অঞ্চলে ঘটে। এই ক্ষেত্রে কেবলমাত্র উত্তেজনা—কারণ হইতে দূরে সরিয়া গেলেই স্থায়ী স্বাস্থ্য লাভ হইতে পারে, যেমন জলাভূমি অঞ্চলের গড় পার্থক্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করিলে ঘটে।

🎴সূত্রঃ ২৩৯। প্রায় প্রত্যেকটি ঔষধ যখন তাহার বিশুদ্ধ ক্রিয়ায় এক বিশেষ প্রকৃতির উৎপাদন করে এমনকি পর্দাশীল অবস্থা যুক্ত এক প্রকার সবিরাম জ্বর, যাহা অন্যান্য ঔষধ সৃষ্ট জ্বর হইতে পৃথক, তখন বহু প্রকার প্রাকৃতিক সবিরাম জ্বরের জন্য বিশাল ভেষজের ভান্ডার হইতে সঠিক হোমিওপ্যাথিক ঔষধ পাওয়া সম্ভব। সুস্থ দেহে পরীক্ষিত অষুধের পরিমিত সংগ্রহের মধ্যেও এরূপ অনেকগুলি জ্বরের জন্য ঔষধ পাওয়া যায়।

🎴সূত্রঃ ২৪০। কিন্তু সবিরাম জ্বরের কোন ব্যাপক হারে যাহা অমোঘ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রূপে গণ্য তাহা যদি কোন কোন রোগীকে সম্পূর্ণ আরোগ্য দান করিতে সমর্থ না হয় এবং জলাভূমি অঞ্চলের অভাব যদি আরোগ্যলাভের প্রতিবন্ধক রূপে সাব্যস্ত না হয়, তাহা হইলে তাহার পিছনে নিশ্চয় সোরাবীজ আছে এবং সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সোরাদোষনাশক ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে।

🎴সূত্রঃ ২৪১। যে সকল স্থানে মহামারীরূপী সবিরাম জ্বর আমিও কারণ হতে উদ্ভূত নহে সেই সকল স্থানে তাহা চিররোগের প্রকৃতি বিশিষ্ট এবং তাহার একটিমাত্র প্রবল আক্রমণ হয়। প্রত্যেকটি মহামারীতেই আক্রান্ত ব্যক্তিদের সকলের মধ্যে একটি বিশেষ প্রকারের বৈশিষ্ট্যসূচক লক্ষণ দেখা যায় এবং যখন ইহা সকলের মধ্যেই লক্ষণ সমষ্টিরুপে দেখা যায় তখন তাহা সকল ক্ষেত্রে উপযোগী এক নির্দিষ্ট হোমিওপ্যাথিক ওষুধের সন্ধান দেয় যে ঔষধ যেসকল রোগীর পূর্বে মোটামুটি সুস্থ ছিল, অর্থাৎ উদ্দীপ্ত সোরার আক্রমণে চিররোগগ্রস্থ হয় নাই, তাহাদের পক্ষে সর্বজনীনভাবে উপকারী।

🎴সূত্রঃ ২৪২। এরূপ মহামারীরূপী সবিরাম জ্বরের প্রথম আক্রমণ যদি অনারোগ্য অবস্থায় থাকে বা অনুপযুক্ত এলোপ্যাথিক চিকিৎসার ফলে রোগী দুর্বল হইয়ে পড়ে, তখন অন্তর্নিহিত সোরা, যাহা কত লোকের ভিতরে হায়! সুপ্ত রহিয়াছে, তাহা উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিয়া সবিরাম জ্বরের প্রকৃতি গ্রহণ করে এবং দৃশ্যত সবিরাম জ্বরের মহামারীর ভূমিকা অভিনয় করে। সেইজন্য প্রথম আক্রমণে যে ওষুধ প্রয়োজন ছিল (কদাচিৎ তাহা সোরাবিষঘ্ন) এখন তাহার আর উপযোগিতা এবং কার্যকারিতা থাকেনা। এখন সোরা হইতে উৎপন্ন সবিরাম জ্বর হিসেবে তাহাকে ধরিতে হইবে এবং উচ্চশক্তির সালফার কিংবা হিপার সালফারের ক্ষুদ্র মাত্রায় (কাদাচিৎ পুনঃপ্রয়োগে) তাহা প্রশমিত হইবে।

🎴সূত্রঃ ২৪৩। সেই সকল অত্যন্ত মারাত্মক সবিরাম জ্বরের ক্ষেত্রে যেখানে জলা অঞ্চলে বাস না করিয়া ও দেহ আক্রান্ত হয়, সেখানে প্রথমে সোরাজনিত সাধারণ অচিররোগে যেমন করা হয় তেমনি অন্য শ্রেণীর পরীক্ষিত ঔষধ (সোরাদোষনাশক নহে) ইহাতে সেই বিশেষ ক্ষেত্রের জন্য এটি হোমিও ঔষধ নির্বাচন করিয়া কয়েকদিন ধরিয়া তাহার প্রয়োগ করিয়া কতটা কি কার্য হয় দেখিতে হইবে। কিন্তু যদি এইরূপ করা সত্ত্বেও আরোগ্য বিলম্বিত হয় তখন বুঝিতে হইবে যে, মূলে যে সোরা আছে তাহার প্রতিবিধান আবশ্যক এবং সেই ক্ষেত্রে একমাত্র সোরাদোষনাষক ওষুধই চূড়ান্তভাবে আরোগ্য দান করিতে সমর্থ।

🎴সূত্রঃ ২৪৪। জলাভূমি অঞ্চলের স্থানীয় এবং যে সকল অঞ্চল প্রায়ই বন্যা প্লাবিত হয় সেখানকার সবিরাম জ্বর সম্বন্ধে পুরাতন পন্থী চিকিৎসকগণের তৎপরতা দেখা যায়। তথাপি কোন স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি যৌবনে জলাভূমি বাস করিতে অভ্যস্ত হইয়া সুস্থ জীবন কাটাতে পারে যদি সে পথ্যাপথ্য সম্বন্ধে ত্রুটিহীন নিয়ম পালন করে এবং যদি অভাব, ক্লান্তি ও দুষ্টু প্রবৃত্তির দ্বারা তাহার দৈহিক শক্তির অপচয় না ঘটে। সেখানে প্রথম আসিলে সেখানকার স্থানীয় সবিরাম জ্বর বড়জোর তাহাকে আক্রমণ করতে পারে, কিন্তু সিঙ্কোনা ছালের নির্দেশের উচ্চশক্তির দুই কোটি ক্ষুদ্র মাত্রা ও পূর্বোল্লিখিত সুনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা তাহাকে দ্রুত রোগ মুক্ত করিতে পারে। কিন্তু উপযুক্ত দৈহিক ব্যায়াম এবং সুস্থ মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য বিধিব্যবস্থা পালন সত্ত্বেও যে সকল ব্যক্তির জলাভূমি অঞ্চলের সবিরাম জ্বর এইরোপ দুই একটি ক্ষুদ্র মাত্রায় সিঙ্কোনা প্রয়োগে সারে না, তাহাদের পীড়ার মূল কারণ রূপে সোরা সর্বদা বিদ্যমান রহিয়াছে তাহা বিকশিত হইবার চেষ্টা করিতেছে এবং জলাভূমি অঞ্চলে তাহাদের সেই সবিরাম জ্বর সোরাদোষ নাশক ঔষধ ব্যতীত আরোগ্য লাভ করিতে পারে না। কখনো কখনো যদি যদি অবিলম্বে জলাভূমি অঞ্চল ছাড়িয়া শুষ্ক অঞ্চলে যায় তাহা হইলে দৃশ্যত আরোগ্য শুরু হয় (জ্বর ছাড়িয়া যায়) অবশ্য যদি তাহারা তখন ও গভীরভাবে না হইয়া থাকে অর্থাৎ যদি সোরা তাহাদের ভিতরে সম্পূর্ণভাবে বিকাশ লাভ না করিয়া থাকে এবং সেইহেতু পুনরায় তাহা সুপ্ত অবস্থায় ফিরিয়া আসিতে পারে, কিন্তু সোরাদোষনাশক চিকিৎসা ছাড়া তাহাদের পূর্ণ স্বাস্থ্য লাভ করা কখনই সম্ভব নহে ।


🎴সূত্রঃ ২৪৫। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় প্রধান ধরনের বিভিন্ন রোগের এবং তাহাদের সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট অবস্থার ক্ষেত্রে কতখানি মনোযোগ দেওয়া উচিত তাহা লক্ষ্য করিয়া আমরা এখন ঔষধ, তাহার ব্যবহারবিধি এবং তাহা ব্যবহারকালে কিরূপ পথ্যাদির ব্যবস্থা করিতে হইবে তাহা আলোচনা করিতেছি।

🎴সূত্রঃ ২৪৬। চিকিৎসাকালে প্রত্যেকটি উপশম যতক্ষণ স্পষ্ট, উন্নতিশীল ও ক্রমবর্ধমান থাকিবে ততক্ষণ কোন ঔষধই পুনঃ প্রয়োগ করা চলবে না। কারণ উপযুক্ত ঔষধ এর উপকার প্রদান করা এখন সম্পূর্ণ তার পথে চলিয়াছে। অচির রোগের ক্ষেত্রে এরূপ প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু অধিকতর চিররোগের ক্ষেত্রে, অপরপক্ষে সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের একটি মাত্রা কখনও কখনও মন্হর গতিতে উন্নতি দেখাইয়া আরোগ্য সম্পর্ণ করিতে পারে এবং এইরূপ ক্ষেত্রে এই প্রকার ঔষধের পক্ষে স্বভাবত চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, একশত দিনের মধ্যে যেটুকু সাহায্য দেওয়া সম্ভব তাহা দিতে পারে। এইরূপ কিন্তু বড় একটা ঘটে না। তাহা ছাড়া, এই সময়কে অর্ধেক, সিকি এবং তাহার ও কম করা সম্ভব হইলে রোগীকে আরও দ্রুত আরোগ্য প্রদান করা যায়, ইহা ও চিকিৎসক ও রোগীর পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুনঃ পুনঃ পর্যবেক্ষণ এর ফলে সম্প্রতি যে অভিজ্ঞতা আমি লাভ করি আছি তাহাতে নিম্নলিখিত শর্তে উহা সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ করা যাইতে পারে।প্রথমত, সাধ্যানুসারে নির্বাচিত ঔষধ যদি সর্বতোভাবে সদৃশ্য লক্ষণযুক্ত হয়, দ্বিতীয়ত, যদি তাহা উচ্চ শক্তিতে পরিণত করা হয় এবং জলে দ্রবীভূত করিয়া সর্বাপেক্ষা দ্রুত আরোগ্যসাধনের ফলে নির্দিষ্ট সময়ান্তরে, অভিজ্ঞতা দ্বারা যাহা সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত বলিয়া বিবেচিত সেইরূপ স্বল্প মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু সেই সাবধানতা অবলম্বন করিতে হইবে যেন প্রত্যেক মাত্রা পূর্ববর্তী টি হইতে কিছু পরিবর্তিত হয়। তাহা হইলে জীবনীশক্তি যাহাকে সদৃশ ভেষজব্যাধির অনুরূপ করিতে হইবে তাহার কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হইবে না এবং সে বিদ্রোহ প্রকাশ করিবে না যাহা অপরিবর্তিত, বিশেষত মাত্রার অতি দ্রুত আছে পুনঃ পুনঃ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বদা দেখা যায় ।

🎴সূত্রঃ ২৪৭। আরোগ্য যাহাতে বিলম্বিত না হয় সেজন্য স্বল্প সময় অন্তর কোন প্রয়োগের কথা দূরে থাক, কাশির ঔষধ অপরিবর্তিত মাত্রায় পুনর্বার দেওয়াও অবাস্তব। জীবনীশক্তি এরূপ অপরিবর্তিত মাত্রাকে বিনা বাধায়, অর্থাৎ যেরূপ সরাইতে হইবে তাহার লক্ষণ ছাড়া ওষুধের অন্যান্য লক্ষণ প্রকাশিত হইতে নাদিয়া কখনই গ্রহণ করে না। কারণ, পূর্ববর্তী মাত্রা পূর্বেই জীবনীশক্তির উপর বাঞ্ছিত পরিবর্তন সাধন করিয়াছে এবং সেই ঔষধ এর সম্পূর্ণ সদৃশ সূক্ষ্ম অপরিবর্তিত দ্বিতীয় মাত্রা জীবনীশক্তির ঠিক একই অবস্থা আর খুজিয়া পায় না । এইরূপ অপরিবর্তিত মাত্রা আর প্রয়োগ করা হইলে রোগী অন্যভাবে কাতর হইয়া পড়ে, এমনকি যাহা ছিল তাহা অপেক্ষা ও বেশি অসুস্থ হইতে পারে, কারণ প্রদত্ত ঔষধ টি সেইসকল লক্ষণই এখন ক্রিয়াশীল থাকে যেগুলি মূল পীড়ার সদৃশ নহে, সেইজন্য আরোগ্যের পথে অগ্রগতি হয় না, রোগের বৃদ্ধির একটা অবস্থা মাত্র হয়। কিন্তু যদি পরবর্তী মাত্রাসমূহ প্রত্যেকবার অল্প অল্প পরিবর্তিত হয়, যেমন উচ্চ শক্তিতে উন্নতি করিয়া (২৬৯-২৭০), তাহা হইলে জীবনীশক্তি অনায়াসে সেই ঔষধ দ্বারাই পরিবর্তিত হতে পারে (প্রাকৃতিক রোগের অনুভূতি মন্দীভূত থাকে) এবং এইরূপে আরোগ্য আরও নিকটবর্তী হয়।

🎴সূত্রঃ ২৪৮। এই উদ্দেশ্যে আমরা নূতন করিয়া ঔষধ দ্রব্যকে (হয়তো ৮,১০,১২ বার ঝাঁকি দিয়া) শক্তিকৃত করিয়া লই এবং তাহা হইতে রোগীকে এক বা (বর্ধিত করিয়া) কতিপয় চাচামচ মাত্রা, দীর্ঘস্থায়ী পীড়ায় প্রত্যেহ কিংবা একদিন অন্তর, অচিররোগে দুই হইতে ছয় ঘণ্টা অন্তর খুব জরুরী ক্ষেত্রে এক ঘন্টা অন্তর কিংবা আরো শীঘ্র প্রদান করি। এই উপায়ে চিররোগের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি সঠিকভাবে নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ, তাহার ক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হইলেও, অধিকতর সাফল্যের সহিত মাসের-পর-মাস প্রত্যহ পুনঃপ্রয়োগ করা যায়। দ্রব্যটি যদি (সাত বা পনের দিনে) শেষ হইয়া যায় এবং ঐ ঔষধের লক্ষণ যদি তখনও বিদ্যমান থাকে তাহা হইলেও সেই ওষুধের লক্ষণ যদি তখন ও বিদ্যমান থাকে তাহা হইলে সেই ওষুধের উচ্চতর শক্তি একটি (কদাচিৎ কয়েকটি) অণুবটিকা দিয়া পরবর্তী দ্রব্য প্রস্তুত করিতে হইবে এবং তাহা রোগীর ক্রমোন্নতির পথে তাহার জীবনে আর কখনও অনুভূত হয় নাই এমন কোনো লক্ষণ আসিয়া যতদিন উপস্থিত না হয় ততদিন চালাইয়া যাইতে হইবে। যদি এইরূপই হয়, যদি রোগের অবশিষ্ট অংশ একগুচ্ছ পরিবর্তিত লক্ষণ রূপে প্রকাশ পায়, তাহা হইলে শেষ ওষুধটির পরিবর্তে আর একটি অন্য সদৃশ ঔষধ নির্বাচন করিয়া একইভাবে পুনঃ পুন মাত্রায় প্রয়োগ করিতে হইবে, তবে মনে রাখিতে হইবে যে সজোরে ঝাঁকি দিয়া প্রত্যেক মাত্রার শক্তি যেন কিছু পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত করা হয়। অপরপক্ষে সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের প্রায় প্রাত্যহিক পুনঃ প্রয়োগ কালে চিররোগ চিকিৎসার শেষের দিকে তথাকথিত (১৬১সূত্র) হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি দেখা যাইতে পারে যাহার ফলে রোগের অবশিষ্ট লক্ষণসমূহ কিছু পরিমাণে আবার বৃদ্ধি পাইয়াছে মনে হয় (মূল রোগের সদৃশ ওষুধসৃষ্ট লক্ষণই কেবল তখন অবিরত প্রকাশ পেতে থাকে)। সেই ক্ষেত্রে ঔষধের মাত্রা আরও হ্রাস করিতে হইবে এবং উহা অধিকতর সময়ের ব্যবধানে প্রয়োগ করিতে হইবে। হয়ত বা রোগমুক্তির জন্য আর ঔষধ প্রয়োজন আছে কিনা দেখিবার জন্য কিছুদিন ঔষধ বন্ধ করিয়া দিতে হইবে। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের অতি ব্যবহার হেতু আপাত লক্ষণ গুলি শীঘ্রই অন্তর্হিত হইয়া যাইবে এবং তৎপশ্চাতে উপদ্রবহীন স্বাস্থ্য বিরাজ করিবে। যদি ছোট একটি শিশি যেমন, এক ড্রাম জলমিশ্রিত সুরাসারে একটি অণুবটিকা ঝাঁকি দিয়া মিশাইয়া চিকিৎসার জন্য তাহার দুই, তিন বা চার দিন অন্তর ঘ্রাণ লইবার ব্যবস্থা করা হয়, তাহা হইলে সেইটিকেও প্রত্যেকবার ঘ্রাণ লইবার পূর্বে আট দশবার ঝাঁকি দিয়া লইতে হইবে।

🎴সূত্রঃ ২৪৯। কোন রোগীকে দেওয়া প্রত্যেকটি ঔষধ তাহার ক্রিয়া প্রকাশকালে যদি এরূপ নতুন এবং কষ্টদায়ক লক্ষণ উৎপাদন করে যাহা ব্যাধির অঙ্গ ছিল না তাহা হইলে বুঝিতে হইবে তাহা প্রকৃত উপকার সাধন করিতে অক্ষম এবং তাহা হোমিওপ্যাথিক নীতি অনুসারে নির্বাচিত হয় নাই। অতএব, বৃদ্ধির লক্ষণ যদি বেশি প্রকাশ পায় তাহা হইলে সদৃশ ক্রিয়া অনুসারে পরবর্তী সঠিক ঔষধ দিবার পূর্বে যত শীঘ্র সম্ভব কোনো প্রতিষেধক ঔষধ দ্বারা তাহার ক্রিয়াকে আংশিকভাবে নষ্ট করিয়া দিতে হইবে বা কষ্টদায়ক লক্ষণগুলি যদি খুব উগ্র না হয় তবে পরবর্তী ঔষধ অবিলম্বে দিতে হইবে যাহাতে বেঠিক ভাবে নির্বাচিত স্থান গ্রহণ করিতে পারে।

🎴সূত্রঃ ২৫০। যে পর্যবেক্ষণশীল চিকিৎসক রোগের অবস্থা সঠিকভাবে অনুসন্ধান করেন তিনি যখন জরুরী ক্ষেত্রে ছয়, আট বা বার ঘণ্টা বাদে বুঝিতে পারেন যে শেষ ওষুধটির নির্বাচন ঠিক হয় নাই, যাহার ফলে রোগীর অবস্থা খুব কম পরিমাণে হইলেও বোধগম্য ভাবে প্রতি ঘন্টায় নুতন লক্ষণ ও যন্ত্রণার আবির্ভাব খারাপের দিকে চলিয়াছে, তখন তৎকালীন অবস্থার জন্য উপযুক্ত একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন দ্বারা তাহার ভ্রম সংশোধন শুধু অনুমোদনযোগ্য নহে, তাহা তাহার কর্তব্য (সূত্রঃ ১৬৭) ।

🎴সূত্রঃ ২৫১। এমন কতকগুলি ওষুধ আছে (যেমন, ইগ্নেশিয়া, ব্রায়োনিয়া, রাস টক্স এবং কখনও কখনও বেলেডোনা) যাদের মানুষের স্বাস্থ্য পরিবর্তন করিবার ক্ষমতা প্রধানত পর্যায়শীল ক্রিয়াসমূহের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত, একপ্রকার মুখ্য ক্রিয়া সংবলিত পরস্পর বিপরীত লক্ষণ। ঠিক সদৃশ নীতি অনুসারে ইহাদের একটি প্রয়োগ করিয়া চিকিৎসক যদি কোন উপকার দেখিতে না পান তাহা হইলে তাহার প্রয়োজন সাধন ত্বরান্বিত করিবার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে (অচির রোগের ক্ষেত্রে এমনকি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ও) স্বল্প মাত্রায় সেই ঔষধ পুনঃ প্রয়োগ করিতে পারেন।

🎴সূত্রঃ ১৫২। কিন্তু চির রোগের (সোরা) ক্ষেত্রে অন্যান্য ঔষধ প্রয়োগ করলে যদি আমরা দেখি যে, সর্বতোভাবে সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধের (সোরাঘ্ন) যথোচিত (ক্ষুদ্রতম) মাত্রায় উপকার হইতেছে না, তাহা হইলে ইহাই প্রমাণিত হয় যে রোগের পরিপোষক কারণটি তখন ও বিদ্যমান এবং রোগীর জীবনযাত্রা পদ্ধতি কিংবা যে অবস্থায় সে নিপতিত তাহাতে এমন কোন ঘটনা আছে যাহা স্থায়ী আরোগ্য লাভের জন্য দূর করা অবশ্য কর্তব্য।

(৩২) পীড়ার বৃদ্ধি ও উপশম (সূত্র-২৫৩-২৫৮)

🎴সূত্রঃ ২৫৩। সমস্ত রোগে, বিশেষত উগ্র প্রকৃতিবিশিষ্ট রোগসমূহে যেসকল লক্ষণ উপশম বা বৃদ্ধির সামান্য সূচনা জানাইয়া দেয় যাহা প্রত্যেকের কাছে বোধগম্য হয় না, তাহাদের মধ্যে মানসিক লক্ষণ ও রোগীর সমগ্র আচরণ সর্বাপেক্ষা সুনিশ্চিত এবং শিক্ষাপ্রদ । সামান্য একটু বসলাম হইলেই রোগীর অধিকতর আরাম, আরও বেশি স্বস্তি এবং মনের স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রফুল্লতা যাহা প্রায় স্বাভাবিক অবস্থার দিকে প্রত্যাবর্তন আমরা লক্ষ্য করি। আবার অল্প একটু বৃদ্ধির সূচনায় ইহার ঠিক অবস্থা ঘটে ঃ মন, সমগ্র আচরণ, ক্রিয়া ও ভাবভঙ্গীতে একপ্রকার স্বাচ্ছন্দ্য, অসহায় শোচনীয় অবস্থা—-যাহা মনোযোগের সহিত লক্ষ্য করলে সহজেই ধরা যায়, কিন্তু কথায় প্রকাশ করা যায় না।

🎴সূত্রঃ ১৫৪। অন্য নুতন লক্ষণ লক্ষণের বৃদ্ধি, কিংবা তদ্বিপরীত, যথা নূতন লক্ষণের আবির্ভাব না ঘটিয়া মূল লক্ষণগুলির হ্রাস—মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণশীল ও অনুসন্ধানকারী চিকিৎসকের মন হইতে রোগের বৃদ্ধি বা উপশম সম্বন্ধে সকল সন্দেহ দুর করিয়ে দিবে, যদিও রোগীদের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছে যাহারা উপশম বা বৃদ্ধির ঠিক বিবরণ দিতে অসমর্থ কিংবা তাহা স্বীকার করিতে অনিচ্ছুক।

🎴সূত্রঃ ২৫৫। ঔষধ নির্বাচন সঠিক হইয়াছে কিনা চিকিৎসকের জানার উপায়—-

এইরূপ রোগের ক্ষেত্রেও এই বিষয়ে আমরা নিশ্চয়ই বোধ করিতে পারি যদি রোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ সমস্ত লক্ষণ একে একে আলোচনা করিয়া মিলাইয়া লইয়া দেখি যে সেইগুলি ছাড়া অন্য কোন অসঙ্গত নুতন লক্ষণের কথা রোগী বলিতেছে না এবং পুরাতন লক্ষণগুলি ও আর খারাপের দিকে যায় না। এইরূপ হইলে এবং মন ও প্রকৃতিতে উন্নতির সূচনা দেখা গেলে বুঝিতে হইবে রোগের উপশমে ঔষধ নিশ্চয় কার্যকরী হইয়াছে বা এজন্য যদি যথেষ্ট সময়ে অতিবাহিত না হইয়া থাকে, তাহা হইলে শীঘ্র কার্যকরী হইবে। উন্নতি আসিতে তাহার পরেও যদি খুব বিলম্ব হয় তাহা হইলে রোগীর আচার আচরণে হয় কিছু গোলমাল আছে, আর নয় তো বাধা সৃষ্টিকারী অন্য কোন অবস্থা তাহার কারণরূপে বিদ্যমান।

🎴সূত্রঃ ২৫৬। ঔষধ প্রয়োগের পর রোগী নূতন গুরুতর লক্ষণের কথা প্রকাশ করিলে বুঝিতে হইবে ঔষধ নির্বাচন সঠিক হয় নাই—-

অপর পক্ষে, রোগী যদি এমন কোনো নতুন ঘটনা এবং জরুরী লক্ষণের কথা বলে যাহা নির্দেশ করে যে ওষুধটি ঠিকমতো হোমিওপ্যাথিক মতে নির্বাচিত হয় নাই, তাহা হইলে সে ভদ্রতাবশত ভালো আছে বলিয়া আশ্বাস প্রদান করিলে ও—যেমন ফুসফুসে স্ফোটকযুক্ত যক্ষ্মারোগী প্রায়ই দিয়া থাকে–আমরা সেই আশ্বাসে বিশ্বাস স্থাপন করিব না, বরং সেই অবস্থাকে বর্ধিত অবস্থা বলিয়াই মনে করি এবং তাহা শীঘ্র স্পষ্ট বুঝা যাইবে।

🎴সূত্রঃ ২৫৭। কোন ঔষধ এর প্রতি অযথা আসক্তি বর্জনীয় —-

যে সকল ঔষধ ব্যবহার করিয়া দৈবক্রমে উপকার পাইয়াছেন প্রিয় ঔষধরূপে সেই গুলির প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন যেন করা না হয় সে সম্বন্ধে প্রকৃত চিকিৎসককে সাবধান হইতে হইবে। যদি সেইরূপ করা হয় তাহা হইলে যে ওষুধগুলি কম ব্যবহার করা হয় অথচ সাদৃশ্য অনুযায়ী অধিকতর উপযুক্ত সুতরাং অধিকতর কার্যকরী সেইগুলি উপেক্ষিত হইবে।

🎴সূত্রঃ ২৫৮। কোন ওষুধের প্রতি অযথা অবহেলা ও বর্জনীয়—–

উপরন্তু, যিনি প্রকৃত চিকিৎসক তিনি নিজের ভুল নির্বাচন হেতু যে সকল ঔষধ প্রয়োগ করিয়া কুফল পাইয়াছেন সেইগুলির প্রতি অবিশ্বাসপূর্ণ দুর্বলতা দেখাইয়া অবহেলা প্রদর্শন করিবেন না বা অন্য কারণ হেতু যেমন, পূর্বক্ষেত্রে অসদৃশ ছিল বলিয়া সেগুলিকে পরিত্যাগ করবেন না। এই সত্য তাকে অবশ্যই স্মরণ রাখিতে হইবে যে প্রত্যেকটি রোগের ক্ষেত্রে পরিচায়ক লক্ষণসমষ্টির সহিত সঠিক মিল আছে এমন একটি মাত্র ঔষধি ভেষজ ভান্ডার এর মধ্যে প্রকৃষ্টতম এবং এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের পথে কোন ক্ষুদ্র পক্ষপাতিত্ব বাধাস্বরূপ হওয়া উচিত নহে।

(৩৩) পথ্য ও পরিচর্যা (সূত্র-২৫৯-২৬৩)

🎴সূত্রঃ ২৫৯। চিকিৎসাকালে ভেষজগুণ সম্পন্ন পথ্য বর্জনীয়—-

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় মাত্রার ক্ষুদ্রতা অবশ্যক ও উপযোগী—-ইহা স্বীকার করিয়া লইলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে চিকিৎসাকালে পথ্যাদি হইতে সেই সকল বস্তু বর্জন করিতে হইবে যাহাদের ভেষজ ক্রিয়া থাকিতে পারে, যাহার দ্বারা ক্ষুদ্র মাত্রাটি অভিভূত ও বিনষ্ট কিংবা অসঙ্গত অন্য কোন উত্তেজক বস্তু দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত না হইতে পারে।

🎴সূত্রঃ ২৬০। চির রোগের ক্ষেত্রে ভুল পানাহারে পীড়ার বৃদ্ধি ঘটে—-

সেইজন্য আরোগ্যের পথে এই প্রকার বাধাসমূহের সযত্ন অনুসন্ধান বিশেষত, চিররোগীদের ক্ষেত্রে, বিশেষ প্রয়োজন। কারণ তাহাদের ব্যাধির প্রায়ই সেই প্রকার অনিষ্টকর প্রভাব এবং ব্যাধি উৎপাদক ভুল পথ্যাদির দ্বারা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় যাহা প্রায়ই দৃষ্টির অগোচরে থাকে।

🎴সূত্রঃ ২৬১। চির রোগের ক্ষেত্রে আরোগ্যের বিঘ্ন দূর করতঃ বিপরীত অবস্থা সৃষ্টি করা দরকার—-

চির রোগের ঔষধ প্রয়োগ কালে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত পথ্যাদির ব্যবস্থা হইল আরোগ্যের পথে সেই সকল বাধাবিঘ্নাদি দূর করা এবং প্রয়োজনবোধে তদ্বিপরীত ব্যবস্থা করা যথা, নৈতিক ও মানসিক নির্দোষ আমোদপ্রমোদ, প্রায় সকল ঋতুতে মুক্ত বায়ুতে দৈহিক ব্যায়াম (প্রাত্যহিক ভ্রমণ, সামান্য দৈহিক পরিশ্রম) উপযুক্ত, পুষ্টিকর, ভেষজক্রিয়াবিহীন খাদ্য ও পানীয় প্রভৃতি।

🎴সূত্রঃ ২৬২। তরুণ রোগের ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ চেতনা পথ্যাপথ্যের নির্ভুল নির্দেশ প্রদান করে——–

অপরপক্ষে অচিররোগে—মানসিক বিকৃতির ক্ষেত্র ছাড়া—জাগ্রত জীবনরক্ষিণী শক্তির তীক্ষ্ণ, নির্ভুল প্রেরণা এরূপ পরিষ্কার এবং সঠিকভাবে জানাইয়া দেয় যে চিকিৎসকের প্রয়োজন শুধু বন্ধু ও শুশ্রূষাকারীদের উপদেশ দেওয়া যাতে কোন খাদ্য সম্বন্ধে রোগীর একান্ত আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ না করিয়া বা কোনো ক্ষতিকর দ্রব্য খাইতে বাধ্য করিয়া তাহারা প্রকৃতির আদেশ পালনে যেন বাধা সৃষ্টি না করে।

🎴সূত্রঃ ২৬৩। রোগীর আকাংখিত আরামপ্রদ পথ্যাদির ব্যবস্থা করিলে জীবনীশক্তির অনেকটা সুস্থ বোধ করে——

অচিররোগে আক্রান্ত রোগীর খাদ্য ও পানীয় সম্বন্ধে যে আকাঙ্ক্ষা তাহা প্রধানত সেই সকল জিনিসের জন্য হয় যাহা সাময়িক আরাম প্রদান করে। সেইগুলি কিন্তু যথার্থ ভাবে ভেষজ প্রকৃতির নহে, সেইগুলি কেবলমাত্র এক প্রকার অভাব মিটায়। পরিমিত মাত্রায় এই অভাব পূরণ করা হইলে সমূলে রোগ দূরীকরণের পথে যদি সামান্য বাধা উপস্থিত ও হয় তবে তাহাকে সদৃশ ঔষধের শক্তি দ্বারা এবং একান্ত আকাঙ্ক্ষিত বস্তু গ্রহণ জনিত তৃপ্তিলাভের ফলে জীবনীশক্তি যে স্বাচ্ছন্দ্যলাভ করে তাহার দ্বারা উপযুক্তভাবে প্রতিরোধ ও জয় করা যাইতে পারে। ঠিক সেইভাবে অচিররোগে ঘরের উত্তাপ এবং বিছানার উষ্ণতা শীতলতা রোগীর সম্পূর্ণ ইচ্ছানুসারে ব্যবস্থা করিতে হইবে। তাহাকে অত্যধিক মানসিক শ্রম ও উত্তেজনার আবেগ হইতে মুক্ত রাখিতে হইবে।

(৩৪) ঔষধ প্রস্তুত প্রণালী (সূত্র-২৬৪-২৭১)

🎴সূত্রঃ ২৬৪। চিকিৎসকের হাতে বিশুদ্ধ ও সতেজ ঔষধ থাকা অত্যাবশ্যক—-

প্রকৃত চিকিৎসকের অক্ষুন্ন শক্তি বিশিষ্ট বিশুদ্ধ ঔষধ থাকা চাই। তাহা হইলে তাহাদের আরোগ্যকারী ক্ষমতার উপর তিনি বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিবেন। তাহাদের বিশুদ্ধতা সম্বন্ধে বিচার পরিবার সামর্থ্য তাহাদের নিজেরই থাকা আবশ্যক।

🎴সূত্রঃ ২৬৫। চিকিৎসককে নিজ হাতে ঔষধ প্রস্তুত করিতে হইবে—

প্রত্যেক ক্ষেত্রে চিকিৎসক সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ থাকিবেন যে রোগী ঠিক ঔষধ গ্রহণ করিয়াছে এবং ইহা হইবে তাহার বিবেকের বিষয়। সেই জন্য সঠিক নির্বাচিত ঔষধ প্রস্তুত করিয়া তিনি প্রয়োগ করবেন।

🎴সূত্রঃ ২৬৬। ভেষজ পদার্থ সতেজ অবস্থায় সর্বাপেক্ষা উপযোগী—

প্রাণী এবং উদ্ভিদরাজ্যের বস্তুসমূহের ভেষজ ধর্ম তাহাদের কাঁচা অবস্থাতে সর্বাপেক্ষা পূর্ণভাবে বিদ্যমান থাকে।

🎴সূত্রঃ ২৬৭। স্থানীয় উদ্ভিদ হইতে ঔষধ প্রস্তুত প্রণালী—-

স্থানীয় উদ্ভিদ এবং যে সকল উদ্ভিদ টাটকা পাওয়া যায় তাহাদের নিষ্কাশিত টাটকা রসের সহিত প্রদীপে জ্বালানো যায় এইরূপ সুরাসার তখনই সমপরিমানে মিশ্রিত করিয়া সম্পূর্ণ ও নিশ্চিতরূপে আমরা তাহাদের শক্তির অধিকার লাভ করিতে পারি। ইহা একদিন ও একরাত্রি একটি ছিপিবদ্ধ বোতলে থিতাইতে দিলে এবং তন্তু ও অ্যালবুমিনজাতীয় পদার্থ তলানি পড়িয়া গেলে উপরিস্থিতি পরিষ্কার তরল পদার্থকে তখন ঔষধার্থে ব্যবহারের জন্য উপর ঢালিয়া লওয়া হয়। সুরাসার উদ্ভিদরসের তৎক্ষণাৎ গাজিয়া যাওয়া নিবারন করে এবং ভবিষ্যতেও গাজিয়া যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। উত্তমরূপে ছিপিবন্দ্ধ অবস্থায় এবং যাহাতে বাষ্পীভূত হইয়া উবিয়া না যায় সেই জন্য ঘুম লাগাইয়া সুরক্ষিত করিলে এবং সূর্যের আলো হইতে দূরে রাখিলে সেই উদ্ভিদরসের সমগ্র ভেষজশক্তি (পূর্ণ ও আবিষ্কৃতভাবে) চিরকাল সংরক্ষিত থাকে।

🎴সূত্রঃ ২৬৮। বিদেশ হইতে আনীত ভেষজ উদ্ভিদ নিঃসন্দেহ হইতে হইবে—–

অন্যান্য বিদেশীয় উদ্ভিদ, বল্কল, বীজ এবং শিকড়সমূহ যাহা টাটকা অবস্থায় পাওয়া যায় না, বিবেচক চিকিৎসক বিশ্বাস করিয়া কখনও সেইগুলিকে চূর্ণ অবস্থায় গ্রহণ করিবেন না। ঔষধরূপে ব্যবহার করিবার পূর্বে তাহাদের অপরিবর্তিত ও সম্পূর্ণ অবয়ব দেখিয়া তাহাদের বিশুদ্ধতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইবেন।

🎴সূত্রঃ ২৬৯। স্থূল ভেষজ পদার্থের অন্তর্নিহিত ভেষজ শক্তিকে অত্যন্ত উচ্চ শক্তিতে উন্নীত করা যায়—-

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা প্রণালী তাহার বিশেষ প্রয়োগের জন্য ইতোপূর্বে আর কখনো ব্যবহৃত হয় নাই এইরূপ এক নিজস্ব প্রক্রিয়া অনুসরণ দ্বারা স্থূল পদার্থসমূহের অন্তর্নিহিত ভেষজশক্তিকে অশ্রুতপূর্ব মাত্রায় বিকশিত করিতে পারে। এমন কি যে সকল পদার্থের স্থূল অবস্থায় মানবশরীরে ভেষজশক্তির ও পরিচয় পাওয়া যায় না তাহারা ও তদ্দ্বারা অপরিমিত ও গভীরভাবে ফলপ্রদ আরোগ্যদায়িনী শক্তির অধিকার লাভ করে। প্রাকৃতিক বস্তুসমূহের এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণগত পরিবর্তন এক প্রচ্ছন্ন, অননূভূতপূর্ব সুপ্ত অন্তর্নিহিত অতীন্দ্রিয় সূক্ষ্মশক্তিকে যেন জাগ্রত করে যাহা জীবনী-শক্তির উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া জীবের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ঘটায়। ইহা ঘর্ষণ ও আলোড়নের মত যান্ত্রিক উপায়ে তাহাদের ক্ষুদ্রতম কণাগুলির উপর সাধিত হয় এবং সেইগুলি শুষ্ক অথবা তরল অন্য একটি নিষ্ক্রিয় দ্রব্যের সংমিশ্রনে পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় অতীন্দ্রিয়ায়িতকরণ, শক্তিসঞ্চারণ (ভেষজশক্তির স্ফুরণ), এবং তদুৎপন্ন যে ফল তাহাকে বলা হয় বিভিন্ন মাত্রার শক্তি।

🎴সূত্রঃ ২৭০। শক্তিকরন পদ্ধতি——-

শক্তির সেই সর্বোত্তম বিকাশ লাভের জন্য যে বস্তুতে শক্তি সঞ্চারিত করিতে হইবে তাহার একটি ক্ষুদ্র অংশ, ধরা যাক, এক গ্রেন প্রতিবার একশত গ্রেন করিয়া তিনবারে তিনঘন্টা দুগ্ধশর্করার সহিত নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসারে ১০ লক্ষ ভাগের ১ অংশ বিচূর্ণ করিবার জন্য ঘর্ষণ করিতে হইবে। নিম্নলিখিত কারণসমূহের জন্য এই বিচূর্ণের এক গ্রেন এক ভাগ সুরাসার ও চার ভাগ পাতিত জলের মিশ্রণের পাঁচশত ফোটার সহিত মিশ্রিত করিয়া তাহার এক ফোঁটা একটি শিশিতে রাখা হইল। ইহাতে একশত ফোটা বিশুদ্ধ সুরাসার দিয়া একটি শক্ত অথচ সম্প্রসারণশীল বস্তুর উপর হস্ত দ্বারা একশতবার সজোরে ঝাকি দেওয়া হইল। ইহাই শক্তিতে রূপান্তরিত ঔষধের প্রথম শক্তি। ইহার সহিত ক্ষুদ্র অণুবটিকা ভিজাইয়া লইয়া তখনই ব্লটিং কাগজের সাহায্যে শুকাইয়া লইয়া একটি উত্তমরূপে ছিপিবদ্ধ শিশিতে রাখিয়া প্রথম শক্তি (।) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাহারই একটি মাত্র অণুবটিকা পরবর্তী শক্তি প্রস্তুত করিবার জন্য একটি দ্বিতীয় নুতন শিশিতে (দ্রবীভূত করিবার জন্য এক ফোঁটা জলের) লওয়া হয়, এবং তাহাতে একশত ফোঁটা উত্তম সুরাসার মিশাইয়া পূর্ববর্ণিত উপায়ে একশতবার প্রবল ঝাঁকি দিয়া সূক্ষ্মায়িত করা হয় । সূরাসার মিশ্রিত এই তরল ঔষধ দিয়ে আবার অণুবটিকা সিক্ত করিয়া ব্লটিং কাগজের উপর তাড়াতাড়ি শুকাইয়া লইয়া উত্তাপ ও সূর্যের আলো না লাগিতে পারে এরূপ স্থানে উত্তম ছিপিবন্ধ শিশিকে সংরক্ষিত করিয়া দ্বিতীয় শক্তিরূপে (।।) চিহ্নিত করা হয়।

এইভাবে এই পদ্ধতি ঊনত্রিশ শক্তি পর্যন্ত অনুসরণ করা হয়। তাহার পর একশত ফোটা সুরাসারের সহিত একশত বার ঝাঁকি দিয়া সুরাসারঘটিত একটি তরল ভেষজ পাওয়া যায় যাহার দ্বারা শর্করা হইতে প্রস্তুত অণুবটিকা যথানিয়মে সিক্ত করিয়া ও শুকাইয়া লইয়া ত্রিশ শক্তি প্রস্তুত হয়।

স্থূল ভেষজসমূহ হইতে এইরূপ প্রক্রিয়ায় এমন বস্তু পাওয়া যায় যাহা পীড়িত দেহের ক্লিষ্ট অংশের উপর প্রবল ভাবে প্রভাব বিস্তার করিবার পূর্ণ ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। এই প্রকারে কৃত্তিম সদৃশ রোগ শক্তি দ্বারা জীবনীশক্তির উপর প্রভাব বিস্তারকারী প্রাকৃতিক রোগ প্রশমিত হয়। উল্লিখিত নির্দেশ ঠিকমত পালন করলে এই প্রক্রিয়া দ্বারা ভেষজের এরূপ রূপান্তর ঘটে যাহা স্থূল অবস্থায় কেবল জড়ধর্মী ছিল, যাহা ভেষজশক্তিহীন বস্তু বলিয়া মনে হয়ত তাহাও এইরূপ উচ্চ হইতে উচ্চতর সূক্ষ্মায়িতকরণের দ্বারা পরিবর্তিত হইয়া অবশেষে অতীন্দ্রিয় ভেষজশক্তিতে পরিণত হয়। বস্তুত ইহা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয় না বটে কিন্তু ঔষধরূপে প্রস্তুত ইহার শুষ্ক বটিকা যাহা জলে দ্রবীভূত করা হইলে অধিকতর কার্যকরী হয় তাহা বাহক হয় এবং এই অবস্থায় রুগ্ন দেহে এই অদৃশ্য শক্তির রোগ আরোগ্যের ক্ষমতা প্রকাশ করে।

🎴সূত্রঃ ২৭১। চিকিৎসক স্বহস্তে ঔষধ প্রস্তুত করবেন—-

রোগ হইতে মানুষকে রক্ষা করিবার কর্তব্যবোধে চিকিৎসক যদি তাহার নিজের হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নিজে প্রস্তুত করেন তাহা হলে তিনি টাটকা গাছগাছড়াই ব্যবহার করিবেন কারণ, আরোগ্যের উদ্দেশ্যে তাহার যদি নিংড়ানো রসের প্রয়োজন না হয় তাহা হইলে অল্প পরিমাণ স্হূল বস্তুতেই কাজ হইবে। ঝাঁকি দিয়া শক্তিকৃত করিবার পূর্বে খলে কয়েক গ্রেন মাত্র লইয়া তাহার সহিত একশত গ্রেন দুগ্ধশর্করা তিনবারে মাড়িলে একের দশ লক্ষাংশ শক্তিবিশিষ্ট ভেষজ পাইবেন (২৭০ সূত্র) । শুষ্ক বা তৈলাক্ত অন্যান্য ভেষজ সম্বন্ধেও এই একই প্রথা অনুসরণ করিতে হইবে।

(৩৫) ঔষধের প্রয়োগ ও মাত্রা (সূত্র-২৭২-২৭৪)

🎴সূত্রঃ ২৭২। অনুবটিকা প্রয়োগ———

এইরূপ একটি শুষ্ক অণুবটিকা জিহ্বায় দিলে অনুগ্র সাম্প্রতিক কোন রোগের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রতম মাত্রা। এইক্ষেত্রে ঔষধ অল্প কয়েকটি স্নায়ুকেই স্পর্শ করে। ঐরূপ একটি অণুবটিকা কিছু দুগ্ধশর্করার সহিত গুড়া করিয়া অধিক পরিমান জলে মিশাইয়া (২৪৭ সূত্র) এবং প্রত্যেকবার প্রয়োগ করিবার পূর্বে ভালোভাবে ঝাঁকি দিলে কিছুদিন ব্যবহারের পক্ষে অধিকতর শক্তিশালী ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। প্রত্যেকটি মাত্রা, তাহা যতই ক্ষুদ্র হউক, পক্ষান্তরে অনেকগুলি স্নায়ুকে স্পর্শ করে।

🎴সূত্রঃ ২৭৩। একসাথে একাধিক ঔষধ প্রয়োগ নিষিদ্ধ , একটিমাত্র ঔষধ প্রয়োগ যুক্তিযুক্ত——–

চিকিৎসার কোনো ক্ষেত্রেই একবারে একটির বেশি কোন অবিমিশ্র ভেষজদ্রব্য প্রয়োগ করা আবশ্যক হয় না এবং তাহা সমর্থনযোগ্যও নহে। অসুস্থতায় একবারে একটি মাত্র ঔষধ অথবা বিভিন্নভাবে ক্রিয়াশীল কতকগুলি ওষুধের মিশ্রণের যুক্তিযুক্ত এবং নিয়মসঙ্গত সেই সম্বন্ধে কেমন করিয়া অনুমাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে তাহা ধারণাতীত। একমাত্র সত্য, সরল ও প্রাকৃতিক আরোগ্যকলা হোমিওপ্যাথিক বিধানে রোগীকে একেবারে দুইটি বিভিন্ন প্রকারের ভেষজদ্রব্য প্রয়োগ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

🎴সূত্রঃ ২৭৪। একটি মাত্র অবিমিশ্র ঔষধ প্রয়োগ ব্যতীত চিকিৎসক অন্য কোন চিন্তা করিতে পারেন না— এককভাবে, মিশ্রিত না করিয়া, প্রয়োগ করা হইলে প্রকৃত চিকিৎসক যখন অবিমিশ্রিত ভেষজের মধ্যে যাহা কিছু বাঞ্ছনীয় (কৃত্রিম রোগ শক্তি যাহা হোমিওপ্যাথিক ক্ষমতাবলে প্রাকৃতিক রোগকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত ও ধ্বংস করিয়া স্থায়ী আরোগ্যবিধান করিতে পারে) সকলই পাইতে পারেন তখন “সরল উপায় যথেষ্ট হইলে জটিল উপায় প্রয়োগ করা ভুল” এই নীতিবাক্য স্মরণে রাখিয়া তিনি কখনও একটি অবিমিশ্র ভেষজ দ্রব্য ছাড়া আর কিছু দিবার কথা চিন্তা করিবেন না। আরও এই কারণে যে, অবিমিশ্র ভেষজসমূহের বিশিষ্ট বিশুদ্ধ ক্রিয়া সুস্থ মানবশরীরে সম্পূর্ণ পরীক্ষিত হইয়া থাকিলেও দুই বা ততোধিক ভেষজদ্রব্য সংযুক্ত হইলে মানবশরীরে তাহাদের পরস্পরের ক্রিয়া কিভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং পরিবর্তিত হয় তাহা পূর্ব হইতে জানা অসম্ভব। অপরপক্ষে একটি অবিমিশ্র ভেষজ যাহার লক্ষণসমষ্টি সঠিকভাবে জানা আছে তাহা হোমিওপ্যাথিক মতে নির্বাচিত হইয়া ব্যাধিতে প্রয়োগ করা হইলে একাই উপযুক্ত সাহায্য প্রদান করিতে পারে। আর যদি মন ধরা যায়, ঠিক সদৃশ লক্ষণানুসারে নির্বাচিত হয় নাই এবং সেইজন্য কোন উপকার দেখা গেল না তাহা হইলেও তাহা আমাদের ওষুধবিষয়ক জ্ঞান বৃদ্ধির সহায়ক হইবে। কারণ এইরূপ ক্ষেত্রে উদ্ভূত নূতন লক্ষণসমূহ যাহা সুস্থ শরীরে পরীক্ষাকালে পূর্বেই দেখা গিয়েছিল তাহা সমর্থিত হইল। যে সুযোগ একাধিক ঔষধের মিশ্রণের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না।

(৩৬) ঔষধ শক্তি (সূত্র-২৭৫-২৮৩)

🎴সূত্রঃ ২৭৫। ঔষধের প্রতিযোগিতা শুধু উহার সদৃশ নির্বাচনের উপরই নির্ভর করে না, উপযুক্ত মাত্রার উপরও নির্ভরশীল——-

যে কোন পীড়ার ক্ষেত্রে কেবল সদৃশনীতি অনুযায়ী সঠিক নির্বাচনের উপর ঔষধের প্রতিযোগিতা নির্ভর করে না, সেই সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণ অর্থাৎ মাত্রার ক্ষুদ্রতার উপর তাহা নির্ভর করে। সদৃশনীতি অনুসারে নির্বাচিত হইলেও যদি আমরা কোন ঔষধ অত্যধিক মাত্রায় প্রদান করি তাহা হইলে উহার স্বাভাবিক উপকারিতা থাকা সত্বেও তাহা কেবল মাত্রাধিক্যহেতু ক্ষতিকারক হইতে পারে এবং হোমিওপ্যাথিক ক্রিয়ার সাদৃশ্যহেতু অপ্রয়োজনীয়রূপে প্রবলভাবে জীবনীশক্তিকে প্রভাবিত করিয়া ইহার মাধ্যমে জীবসত্তার সর্বাপেক্ষা অনুভূতিশীল অংশসমূহ আক্রমণ করে যেগুলি পূর্বেই প্রাকৃতিক রোগে সর্বাপেক্ষা আক্রান্ত হইয়াছে।

🎴সূত্রঃ ২৭৬। উপযুক্ত সদৃশ ঔষধের বৃহৎ মাত্রা অনিষ্ট সাধন করে———

এইজন্য কোন ব্যাধিতে হোমিওপ্যাথিক মতে উপযুক্ত ঔষধ নির্বাচন হইলেও তাহার মাত্রা যদি বৃহৎ হয় তাহা হইলে ঐ প্রত্যেকটি বৃহৎ মাত্রাই ক্ষতিকর হয় এবং তাহা তত অধিক সদৃশ হইবে এবং তাহার যত উচ্চশক্তি (এখানে উচ্চশক্তি বলিতে হ্যানেমান বোধ হয় পরিমাণ বুঝাইতে চাহিয়াছেন ।) নির্বাচিত হইবে উহা তত বেশি ক্ষতিকর হইবে যাহা অদৃশ্য এবং রোগলক্ষণ অনুসারে নির্বাচিত নহে এইরূপ ঔষুধের (অ্যালোপ্যাথিক) ক্ষেত্রে যত না হয়। সঠিক নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মাত্রাসমূহ বিশেষত তাহা পুনঃ পুনঃ প্রয়োগ করা হইলে সাধারণত প্রভূত অনিষ্ট সাধিত হইয়া থাকে। ইহা প্রায়শই রোগীর জীবনকে বিপন্ন করে কিংবা রোগকে অসাধ্য করিয়া তোলে । প্রাণশক্তির অনুভূতির দিক দিয়া তাহা প্রাকৃতিক রোগকে ধ্বংস করে এবং অত্যধিক মাত্রার হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ক্রিয়া প্রকাশের মুহূর্ত হইতে রোগী আর মূলরোগে কষ্ট পায় না বটে কিন্তু তাহার ফলে রোগী সদৃশ ওষুধজ ব্যাধির প্রবল প্রভাবে অধিকতর পীড়িত হইয়া পড়ে—যাহা দূর করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ।

🎴সূত্রঃ ২৭৭। সুনির্বাচিত সদৃশ ওষুধের ক্ষুদ্রমাত্রা অধিকতর কার্যকরী—–

ঠিক একই কারণে এবং যেহেতু একটি ঔষধ, যদি তাহার মাত্রা যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষুদ্র হয়, যত অধিক সদৃশভাবে নির্বাচিত হইবে তত অধিক হিতকারী এবং বিস্ময়করভাবে কার্যকরী হইবে, সেইহেতু কোন ঔষধের নির্বাচন ঠিক সদৃশভাবে করা হইলে তাহার মাত্রাকে অতি ক্ষুদ্র করিয়া যদি নিরুপদ্রব্য নিরাময়ের উপযুক্ত পর্যায়ে হ্রাস করা হয় তাহা হইলে তাহা তত বেশি পরিমাণে হিতকারী হইবে।

🎴সূত্রঃ ২৭৮। উপযুক্ত ক্ষুদ্রমাত্রা অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার দ্বারা নির্ণয় করা যায়——

এখন প্রশ্ন এই, সুনিশ্চিত ও বিনাকষ্টে আরোগ্যবিধানের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ক্ষুদ্রতম মাত্রা কি? অর্থাৎ যে কোন রোগের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম আরোগ্যবিধানের জন্য সদৃশভাবে নির্বাচিত প্রত্যেকটি ওষুধের মাত্রা কত ক্ষুদ্র হইবে? এই সমস্যার সমাধানের জন্য এবং প্রত্যেকটি ওষুধের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক মতে আরোগ্য প্রদানের জন্য তাহার কি মাত্রা যথেষ্ট হইবে অথচ তাহা এত ক্ষুদ্র হইবে যাহাতে সর্বাপেক্ষা নিরুপদ্রব্য ও দ্রুত আরোগ্যলাভ করা যায়—- এই সমস্যার সমাধান যে অনুমান বা জল্পনা-কল্পনার বিষয় নহে এবং তাহা যে যুক্তির জাল বুনিয়া বা আপাতমধুর তর্ক ও আলোচনা দ্বারা করা যায় না তাহা সহজে ধারণা করা যায়। আবার সকল রকম সম্ভাব্য রোগীক্ষেত্রও হিসাবে আনা অসম্ভব। বিশুদ্ধ পরীক্ষা, প্রত্যেকটি রোগীর অনুভূতিপ্রবণতা সম্বন্ধে যত্নসহকারে পর্যবেক্ষণ এবং সঠিক অভিজ্ঞতাই প্রত্যেকটি রোগীক্ষেত্রে তাহা নির্দেশ করিতে পারে । হোমিওপ্যাথিক আরোগ্যের জন্য মাত্রার ক্ষুদ্রতা সম্বন্ধে বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা যাহা ব্যক্ত করে তাহার বিপক্ষে পুরাতন পন্থানুযায়ী (অ্যালোপ্যাথিক) ঔষধের বৃহৎ মাত্রার—-যাহা দেহের পীড়িত অংশকে সদৃশনীতি অনুযায়ী স্পর্শ করে না, ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত নহে এমন অংশকেই কেবল আক্রমণ করে—নজির দেখান অযৌক্তিক।

🎴সূত্রঃ ২৭৯। উচ্চ শক্তির ঔষধের নূন্যতম ক্ষুদ্রমাত্রাও ব্যাধিকে পরাভূত করিতে পারে——–

এই বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা সর্বতোভাবে প্রকাশ করে যে, যদি ব্যাধি প্রকাশ্যভাবে দেহের কোন প্রধান আন্তরযন্ত্রের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতির উপর নির্ভর না করে (এমন কি ইহা যদি চির ও জটিল পীড়াসমূহেরও অন্তর্ভুক্ত হয়) এবং চিকিৎসাকালে যদি অন্যান্য বিরুদ্ধ ঔষধের প্রভাব হইতে রোগীকে দূরে রাখা হয় তাহা হইলে কোন মুখ্য বিশেষত চিররোগচিকিৎসার আরম্ভে সদৃশনীতি অনুসারে নির্বাচিত উচ্চশক্তির ঔষধের মাত্রাকে কখনই এত ক্ষুদ্র কোরিয়া প্রস্তুত করা যায় না যে যাহা প্রাকৃতিক রোগ হইতে অধিক বলশালী হইবে না কিংবা তাহাকে অন্তত আংশিকভাবে পরাভূত করিতে পারিবে না এবং প্রাণশক্তির অনুভূতির ক্ষেত্র হইতে তাহাকে মুছিয়া ফেলিয়া আরোগ্যের সূচনা করিবে না।

🎴সূত্রঃ ২৮০। ঔষধের যে মাত্রাটির দ্বারা উপকার পাওয়া যায়————

নূতন কোন কষ্টকর উপসর্গ উৎপন্ন না করিয়া ঔষধের মাত্রা দ্বারা উপকার পাওয়া যাইতেছে তাহা ক্রমোন্নত শক্তিতে প্রয়োগ করিয়া চলিতে হইবে যতদিন সাধারণ উন্নতির সহিত রোগী একটি বা কতিপয় পুরাতন প্রাথমিক উপসর্গের মৃদু প্রত্যাবর্তন অনুভব করিতে আরম্ভ না করে। ইহা দ্বারা সূচিত হয় যে প্রত্যেকবার ঝাঁকি দিয়া পরিবর্তিত ক্রমোন্নত মাত্রার ভিতর দিয়া আরোগ্য নিকটবর্তী হইতেছে (২৪৭ সূত্র)। ইহা নির্দেশ করে যে প্রকৃতির ব্যাধির অনুভূতি হইতে মুক্তিলাভ করিবার জন্য জীবনীশক্তিকে সদৃশ ওষুধজ ব্যাধির দ্বারা প্রভাবিত করিবার আর প্রয়োজন নাই (১৪৮ সূত্র) । ইহা দ্বারা বুঝা যায়, প্রাকৃতিক ব্যাধি হইতে মুক্ত জীবনীশক্তি এখন হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি বলিয়া এযাবৎ পরিচালিত ওষুধজনিত কিছু ব্যাধি ভোগ করিতে শুরু করিয়াছে।

🎴সূত্রঃ ২৮১। অল্পদিন ঔষধ বন্ধ রাখিয়া প্রকৃত আরোগ্য পর্যবেক্ষন করিতে হইবে——-

এ বিষয়ে সুনিশ্চিত হইবার জন্য আট, দশ কিংবা পনের দিন কোন ঔষধ না দিয়া শুধু দুগ্ধশর্করার পুরিয়া দিয়া রোগীকে রাখা হয় । শেষের দিকে আগত উপসর্গগুলি যদি ঔষধজনিত হয় এবং তাহা যদি পূর্বেকার প্রাথমিক রোগলক্ষণের অনুরূপ হয় তাহা হইলে এই সকল উপসর্গ কয়েক দিন বা ঘণ্টার মধ্যেই তিরোহিত হইবে। ঔষধ বিহীন দিন গুলির মধ্যে স্বাস্থ্যনীতি বজায় রাখিয়া যদি প্রাথমিক ব্যাধির আর কিছুই দেখিতে পাওয়া না যায় তাহা হইলে, সম্ভবত রোগী আরোগ্যলাভ করিয়াছে। কিন্তু কিছুদিন পরে পূর্বের ব্যাধিলক্ষণ কিছু কিছু যদি পুনরায় আসিয়া উপস্থিত হয় তাহা হইলে সেইগুলি প্রাথমিক রোগের অবশিষ্টাংশ যাহা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস প্রাপ্ত হয় নাই। উহাকে ঔষুধের উচ্চতর শক্তি দ্বারা পূর্ব নির্দেশ অনুসারে নতুনভাবে চিকিৎসা করিতে হইবে। আরোগ্যবিধান করিতে হইলে প্রাথমিক অল্পমাত্রাকে অনুরূপভাবে পুনরায় ক্রমোন্নত করিতে হইবে। তবে তাহা স্বল্প অনুভূতিপ্রবণরোগীর ক্ষেত্রে যেমন দ্রুত গতিতে উচ্চতর শক্তিতে অগ্রসর হওয়া যায়, অধিকতর উত্তেজনাপ্রবণ রোগীর ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ধীর ও মন্হর গতিতে তাহা করা যাইতে পারে। এমন অনেক রোগী আছে যাহাদের অনুভূতিপ্রবনতার সহিত অনুভূতিবিহীনের অনুপাত হাজারে এক ।

🎴সূত্রঃ ২৮২। প্রথম মাত্রার ঔষধ জনিত রোগ বৃদ্ধি ওষুধের বৃহৎ মাত্রার পরিচায়ক——-

চিকিৎসাকালে বিশেষত চিররোগ চিকিৎসায় প্রথম মাত্রাতে এবং প্রত্যেকটি পুনঃপ্রযুক্ত মাত্রা ( ২৪৭ সূত্র ), তাহা প্রয়োগ করিবার পূর্বে ঝাঁকি দিয়া যতই পরিবর্তিত (অর্থাৎ অধিকতর শক্তি সঞ্চারিত) করা হোক না কেন, যদি তথাকথিত হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি অর্থাৎ প্রথমে লক্ষিত মূল পীড়ার সুস্পষ্ট বৃদ্ধি আনে তাহা হইলে ইহা মাত্রাধিক্যের সুনিশ্চিত লক্ষণ।

🎴সূত্রঃ ২৮৩। ক্ষুদ্র মাত্রার সুবিধা———

প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুবর্তী হইয়া কাজ করিবার জন্যই প্রকৃত আরোগ্যশিল্পী সর্বতোভাবে উপযোগী হয় এমন সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ অতি অল্প মাত্রায় ব্যবস্থা করিবেন। মনুষ্যোচিত দুর্বলতা দ্বারা বিভ্রান্ত হইয়া যদি তাহাকে অনুপোযোগী ঔষধ প্রয়োগ করিতে হয় তাহা হইলে রোগের সহিত ওষুধের ভুল সম্বন্ধহেতু অসুবিধা এত অল্প হয় যে রোগী তাহার জীবনীশক্তির সাহায্যে এবং সদৃশ লক্ষণানুসারে নির্ভুলভাবে নির্বাচিত ঔষধের (ইহাও অতি ক্ষুদ্রতম মাত্রায়) শীঘ্র বাধা প্রদানের দ্বারা ( ২৪৯ সূত্র) তাহা দ্রুত দূর করিতে ও তাহার সংস্কার করিতে পারে।

(৩৭) চুম্বক, বিদ্যুৎ, মর্দন ও মেসমেরিজম (সূত্র-২৮৪-২৯১)

🎴সূত্রঃ ২৮৪। ঔষধ দ্বারা কোন কোন অঙ্গ প্রভাবিত হয়———

জিভ, মুখ ও পাকাশয় সাধারণভাবে ওষুধের দ্বারা সর্বাপেক্ষা প্রভাবিত হইলেও নাসিকা ও শ্বাসযন্ত্রও নিঃশ্বাস গ্রহণ ও ঘ্রাণের সাহায্যে তরল ঔষধের ক্রিয়া গ্রহণ করিতে পারে। কিন্তু দেহের ত্বক আচ্ছাদিত সমস্ত অংশ ও তরল ভেষজ দ্রব্যের ক্রিয়া গ্রহণে উপযুক্ত, বিশেষত ঔষধ মর্দনের সহিত যদি উহার অভ্যন্তরীণ প্রয়োগও করা হয়।

🎴সূত্র- ২৮৫। পুরাতন রোগে নির্বাচিত ঔষুধের বাহ্যিক মর্দন আরোগ্য সাধনকে ত্বরান্বিত করে——–

এইরূপে, চিকিৎসক যে ঔষধ সেবনে করিতে দিয়াছেন এবং আরোগ্যপ্রদ বলিয়া জানা গিয়েছে তাহা বাহ্য প্রয়োগে পৃষ্ঠে, বাহুতে হস্তপদে মর্দন করিতে দিয়া অতি পুরাতন ব্যাধির আরোগ্য বিধান দ্রুততর করিতে পারেন। ইহা করিতে গিয়া ব্যাথা, আক্ষেপ কিংবা উদ্ভেদযুক্ত অংশ অবশ্যই বাদ দিবেন।

🎴সূত্রঃ ২৮৬ । চুম্বক, বিদ্যুৎ প্রভৃতিও জীবনীশক্তির উপর ক্রিয়া করে থাকে ———

মুখ দিয়ে সেবন, ত্বকে মর্দন কিংবা ঘ্রাণের সাহায্যে রোগ প্রশমনকারী তথাকথিত ঔষধ অপেক্ষা খনিজ চুম্বকের সূক্ষ্মশক্তি, বিদ্যুৎ ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন তড়িৎশক্তির প্রাণশক্তির উপর ক্রিয়া কম নহে এবং ঐগুলি কম সদৃশগুণসম্পন্ন নহে। এমন রোগ ও থাকিতে পারে বিশেষত, সংবেদনশীলতা ও উত্তেজনা, অস্বাভাবিক অনুভূতি এবং অনৈচ্ছিক পেশিকম্পনসংক্রান্ত যেগুলি ঐ সকল উপায়ে নিরাময় হইতে পারে। কিন্তু শেষোক্ত দুইটির সুনিশ্চিত প্রয়োগপদ্ধতি তথা তড়িৎচুম্বক যন্ত্রের প্রয়োগ সম্বন্ধে জ্ঞান এত অল্প যে হোমিওপ্যাথিক মতে তাদের ব্যবহার চলে না। এই পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও রাসায়নিক তড়িতের সাময়িক উপশমের জন্য যে ব্যবহার হইয়াছে তাহা রোগীর ক্ষতিরই কারণ হইয়াছে। সুস্থ মানবদেহে উভয়ের সুনির্দিষ্ট বিশুদ্ধ ক্রিয়া এখনও পর্যন্ত সামান্যই পরীক্ষা করা হয়েছে।

🎴সূত্রঃ ২৮৭। খনিজ চুম্বকের ব্যবহার————

মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা শক্তিশালী চুম্বক শলাকার উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর প্রত্যক্ষ ক্রিয়া সম্বন্ধে যে বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে তদনুসারে রোগ নিরাময়ের জন্য উহা অধিকতর নিশ্চয়তার সহিত প্রয়োগ করা যাইতে পারে। যদিও উভয় মেরুই সমান শক্তিশালী তথাপি নিজস্ব ক্রিয়া অনুসারে তাহারা পরস্পর বিপরীত আচরণ করে। লক্ষণানুযায়ী সূচিত উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর স্পর্শকালের সময়ের দৈর্ঘ্য দ্বারা মাত্রার তারতম্য ঘটানো হয়। বিষম ক্রিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে পালিশ করা দস্তার প্লেট ব্যবহারই যথেষ্ট।

🎴সূত্রঃ ২৮৮। জৈবিক চুম্বক বা মেসমেরিজম———

আমি এখনো জৈবিক চুম্বকত্ব অভিহিত অর্থাৎ মেসমেরিজম সম্বন্ধে (প্রথম আবিষ্কারক মেসমারের প্রতি শ্রদ্ধাবশত যে নাম উল্লেখযোগ্য) যাহা অন্য সকলপ্রকার আরোগ্যদায়ী বস্তু হইতে প্রকৃতিতে এত ভিন্ন—উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। শতাব্দি ধরিয়া নির্বোধের মতো অস্বীকৃত ও অবজ্ঞাত এই আরোগ্যদায়ী শক্তির ক্রিয়া বিভিন্নমুখী। ইহা মনুষ্যসমাজে ভগবানের এক বিস্ময়কর অমূল্য দান, যদ্দারা প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পূর্ণ কোন হিতাকাঙ্খী ব্যক্তি স্পর্শ. এমন কি ইহা ব্যতীত দূর হইতেও রোগীর ভিতরে নিজের সুস্থ জীবনীশক্তিকে সুক্ষ্মভাবে সঞ্চারিত করিতে পারেন (ঠিক যেমন শক্তিশালী চুম্বকের একটি মেরু একটি ইস্পাত শলাকার উপর করে)। রোগীর দেহে যে সকল স্থানে জীবনীশক্তি ক্ষীণ অবস্থায় থাকে এবং অন্যান্য অংশে অধিকমাত্রায় সঞ্চিত হইয়া উহা স্নায়ুবিক বিশৃঙ্খলা ঘটায় সেই সকল স্থানে উহা সরাইয়া দিয়া, হ্রাস করিয়া এবং তাহার সমতা রক্ষা করিয়া এবং সাধারণভাবে রোগীর প্রাণশক্তির ব্যাধিসমূহ যথা, পুরাতন ক্ষত, অন্ধতা, একটি অঙ্গের পক্ষাঘাত প্রভৃতিকে দূরীভূত করিয়া সম্মোহক তাহার শক্তিশালী সম্মোহকের বিভিন্ন যুগে যে সকল দ্রুত আপাত আরোগ্যসাধন করিয়া থাকেন তাহা এই শ্রেণীর অন্তর্গত। পূর্ণ তেজ ও শক্তি-সম্পন্ন ব্যক্তির সহানুভূতিপূর্ণ অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ইচ্ছাশক্তিরূপ মানবীয় ক্ষমতা প্রয়োগ দ্বারা সমগ্র মানবদেহে শক্তি সঞ্চারণে মৃতকল্প ব্যক্তির পুনরুজ্জীবন চমৎকারভাবে দেখা গিয়াছে এবং এইপ্রকার পুনর্জীবনলাভের অনেক অনস্বীকার্য দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বর্ণিত আছে। যদি সক্ষম সম্মোহনকারী স্ত্রী অথবা পুরুষ—-সৎপ্রভৃতির এবং উৎসাহশীল হন (এমন কি তাহা বিকৃত হইয়া যদি গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, অতীন্দ্রিয়তা ও বিশ্বহিতৈষণার স্বপ্নেও দাঁড়ায়) তাহা হইলে তিনি আরও অধিক এই জনহিতকর আত্মোৎসর্গকারী ক্রিয়াশীল ব্যবহার করিয়া তাহার সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তির প্রতি তাঁহার আদেশব্যঞ্জক সদিচ্ছাকে পরিচালনা করিতে পারেন এবং কখনও কখনও তাহা কেন্দ্রীভূত করিয়া অলৌকিক ঘটনা দেখাইতে পারেন।

🎴সূত্রঃ ২৮৯। মেসমেরিজমের প্রকার———-

রোগীর ভিতরে অল্পাধিক জীবনীশক্তির অনুপ্রবেশের উপর সম্মোহনশক্তি ব্যবহারের উল্লিখিত সকল পদ্ধতি নির্ভর করে বলিয়া উহাদের বলা হয় পজিটিভ মেসমেরিজম (positive mesmerism)। সম্মোহনশক্তি প্রয়োগের বিপরীত পদ্ধতি যাহা বিপরীত ফল প্রদান করে তাহাকে বলা হয় নেগেটিভ মেসমেরিজম (negative mesmerism)।

স্বপ্নচারিতা হইতে জাগরিত করিবার জন্য হস্তচালনা এবং প্রশমন ও সঞ্চালন নামক সকল প্রকার দৌহিক কৌশল এই শ্রেণীর অন্তর্গত। দুর্বল নয় এইরূপ ব্যক্তি বিশেষ কোন স্থানে বেশি পরিমাণে সঞ্চিত জীবনীশক্তিকে নেগেটিভ মেসমেরিজম দ্বারা নিশ্চিত ও সহজভাবে বিমোচন করা যায় প্রসারিত হাতের তালুকে শরীর হইতে এক ইঞ্চি দূরে সমান্তরালভাবে রাখিয়া মস্তকশীর্ষ হইতে পায়ের আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত দ্রুত সঞ্চালন করিয়া। যত দ্রুত হস্ত সঞ্চালন করা যাইবে তত ফলপ্রদরূপে বিমোচন ঘটিবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পূর্বে সুস্থ ছিল এইরূপ স্ত্রীলোক প্রচন্ড মানসিক আঘাতহেতু হঠাৎ রজঃস্রাব বন্ধ হইয়া মৃতকল্প হইয়া পড়িল জীবনীশক্তি সম্ভবত হৃৎপ্রদেশে কেন্দ্রীভূত হয় যাহা দ্রুত নেগেটিভ মেসমেরিজম প্রয়োগে বিমোচিত হইয়া সমগ্র দেহে সমতা প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে এবং তাহার ফলে তৎক্ষণাৎ তাহার পুনরুজ্জীবন ঘটে। সেইরূপ কোন অত্যধিক উত্তেজনাপ্রবণ ব্যক্তির উপর অত্যধিক শক্তিশালী পজিটিভ হস্তচালনাজনিত অতিরিক্ত অস্থিরতা ও অনিদ্রা এবং তৎসহ উৎকণ্ঠা মৃদু ও ধীর নেগেটিভ সঞ্চালনে উপশম প্রাপ্ত হয়।

🎴সূত্রঃ ২৯০। অঙ্গ দলনে স্বাভাবিক শক্তি ফিরিয়া আসে—————

রোগ সরিয়া গিয়াছে কিন্তু ধীরে ধীরে সুস্থ হইয়া উঠিতেছে এমন ক্ষীণ দেহ, দুর্বল পরিপাকশক্তিযুক্ত ও নিদ্রাহীন চিররোগীর সৎপ্রকৃতিবিশিষ্ট কোন বলবান ব্যক্তি কর্তৃক অঙ্গমর্দন ও ইহার অন্তর্ভুক্ত। হাত,পা, বুক ও পিঠের মাংসপেশিকে পৃথকভাবে ধরিয়া ও পরিমিত চাপ দিয়ে মর্দন করিলে জীবনী- শক্তি জাগ্রত হইয়া মাংসপেশি, ধমনি ও লসিকানালীসমূহে সঞ্চালিত হয় এবং তাহাদের স্বাভাবিক শক্তি ফিরাইয়া আনে। সম্মোহনের প্রভাবই হইল এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য এবং উত্তেজনাপ্রবণ রোগীতে ইহা অতিরিক্ত করা উচিত নহে।

🎴সূত্রঃ ২৯১। বিভিন্ন তাপমাত্রায় স্নানের উপকারিতা——-

বিশুদ্ধ জলে স্নান কতকটা উপশমকারী, কতকটা অচিররোগ এবং চিররোগ সারিয়া যাওয়ার পর স্বাস্থ্যলাভের পথে হোমিওপ্যাথিক মতে সাহায্য করে যদি স্বাস্থ্যের অবস্থা, জলের তাপমাত্রা, স্নানের স্থিতিকাল এবং পুনরায় স্নান করা সম্বন্ধে যথাযথ বিচার করা যায়। কিন্তু উত্তম প্রয়োগ হইলেও তাহা কেবল রুগ্ন দেহের শারীরিক পরিবর্তনই আনয়ন করে, উহা কোন প্রকৃত ঔষধ নহে। ২৫-২৭ ডিগ্রীর রেওমিউর (Reaumur) [৩১°-৩৪° সেলসিয়াস—ত্রি না ব] ঈষদুষ্ণ জল মৃতকল্প ব্যক্তির (ঠান্ডায় অসাড়, জলমগ্ন, রুদ্ধশ্বাস) সাড়হীন স্নায়ুচেতনাকে জাগ্রত করে। যদিও ইহা সাময়িক উপশমকারী তথাপি ইহা অনেক সময় যথেষ্ট কার্যকরী বলিয়া বিবেচিত হয়, বিশেষত কফি ও হস্তদ্বারা ঘর্ষণসহ প্রয়োগ করা হইলে। হোমিওপ্যাথিক মতে তাহাদের ক্রিয়া সেই সকল ক্ষেত্রে প্রকাশ পায় যেখানে উত্তেজনা খুব অসমভাবে ছড়াইয়া থাকে এবং শরীরের অভ্যন্তরস্থ কোন যন্ত্রে অত্যন্ত অসমভাবে জমিয়া থাকে, যেমন কতিপয় হিস্টিরিয়া রোগীর আক্ষেপ এবং শিশুদের তড়কায় হয়। ঠিক একই প্রকারে চিররোগ চিকিৎসার দ্বারা সারিয়া যাইবার পর এবং জীবনীশক্তির উত্তাপের অভাব ঘটিলে হোমিওপ্যাথিক মতে শীতল জলে (১০ হইতে ৬ ডিগ্রি রেওমিউর) [১৩°-৮° সেলসিয়াস-ত্রি না বা ] স্নান সহায়ক হয় । তাৎক্ষণিক এবং পরে পুনঃপুন অবগাহন অবসন্ন মাংসপেশির শক্তি সাময়িকভাবে পুনরুদ্ধার করে। এই উদ্দেশ্যে এইরূপ স্নান মুহূর্তকালের বেশি বরং কয়েক মিনিটের জন্য এবং ক্রমশ নিম্ন উত্তাপে হওয়া উচিত। উহা সাময়িক উপশমপ্রদ এবং উহা কেবল বাহ্যত ক্রিয়া প্রকাশ করে বলিয়া সাময়িক উপশমকারী অতীন্দ্রিয় ভেষজ হইতে যেমন বিপরীত ক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে ইহাতে সে অসুবিধার সম্ভাবনা নাই।

কেন অর্গানন অভ মে‌ডি‌সিন পড়‌বেন ?
১. হো‌মিওপ্যা‌থি‌কে মৌ‌লিকভা‌বে বুঝ‌তে হ‌লে,
২. রোগ সম্প‌র্কে  জান‌তে হ‌লে,
৩. লক্ষণ সম্প‌র্কে জান‌তে হ‌লে, 
৪. সুস্থতা ও অসুস্থতা সম্প‌র্কে  জান‌তে হলে ,
৫. জীবনীশ‌ক্তি সম্প‌র্কে জান‌তে হ‌লে,
৬. রো‌গের হ্রাসবৃদ্ধি সম্প‌র্কে  জান‌তে হ‌লে,
৭. ঔষধ-পরীক্ষা সম্প‌র্কে জান‌তে হ‌লে,
৮. আরোগ্যের ধারা সম্প‌র্কে জান‌তে হ‌লে,
৯. সবল ব্যা‌ধি দুর্বল ব্যা‌ধি‌কে কিভা‌বে আরোগ্য ক‌রে,
১০. আরোগ্য কী শ‌র্তের উপ‌রে নির্ভর ক‌রে সে‌টি জান‌তে,
১১. চির‌রো‌গে (শ‌ক্তিশালী ব্যা‌ধি‌তে) আক্রান্ত ব্যক্তির দে‌হে দুর্বল বিসদৃশ ব্যা‌ধি কেন প্র‌বেশ কর‌তে পা‌রে না সে সম্প‌র্কে জান‌তে,
১২. পী‌ড়িত কো‌নো ব্য‌ক্তির‌ দে‌হে বিসদৃশ নতুন সবল ব্যা‌ধি দুর্বল ব্যা‌ধিকে কিভা‌বে সাম‌য়িক স্থ‌গিত ক‌রে ও সবল ব্যা‌ধির ভোগকাল শে‌ষে সা‌বেক দুর্বল ব্যা‌ধি‌টি ‌কেন পুনরায় দেখা দেয় এ সম্প‌র্কে জান‌তে,
১৩. ‌বিসদৃশ দু‌টি ব্যা‌ধি কিভা‌বে একই মানব‌দে‌হে সহাবস্থান ক‌রে সে সম্প‌র্কে জান‌তে,
১৪. ‌চির‌রোগগু‌লো কেন জ‌টিল হয় সে সম্প‌র্কে জান‌তে,
১৫. ব্যা‌ধি কিভা‌বে তার পছন্দনীয় অঙ্গ বে‌ছে নেয়,
১৬. সদৃশ দু‌টি ব্যা‌ধি এক‌টি অপর‌টি‌কে কিভা‌বে ধ্বংস ক‌রে,
১৭. মায়াজমঘ‌টিত ব্যা‌ধিগু‌লো কেন অ‌ধিক ভী‌তিকর ও বিপজ্জনক,
১৮. এ-আরোগ্যকলা প্রকৃ‌তির শাশ্বত অব্যর্থ নিয়‌মের উপর প্র‌তি‌ষ্ঠিত সে‌টি জান‌তে ও বুঝ‌তে,
১৯. পৃ‌থিবী‌তে অ‌নেক চি‌কিৎসাপদ্ধ‌তি আবিষ্কৃত ও ধ্বংস হ‌য়ে‌ছে, 
২০. বিপরীত চি‌কিৎসাপদ্ধ‌তির ক্ষ‌তিকর দিকগু‌লো জান‌তে,
২১. ঔষ‌ধের মুখ্য‌ক্রিয়া ও গৌণ ক্রিয়ার ম‌ধ্যে প্র‌ভেদ জান‌তে,
২২. কখন বিপরীত চি‌কিৎসা অনু‌মোদন‌যোগ্য ও কেন, সে‌টি জান‌তে,
২৩. আরোগ্য যে কয়‌টি বিষ‌য়ের অন্তর্ভুক্ত,
২৪. ‌লক্ষণসম‌ষ্টি (Totality of Symptoms) জান‌তে ও বুঝ‌তে,
২৫. অপ‌চি‌কিৎসার ক্ষ‌তিকর দিকগু‌লো জান‌তে, এবং সেগু‌লো আরোগ্য করা কেন ক‌ঠিন ,
২৬. ‌সোরার ই‌তিহাস জান‌তে, 
২৭. সাধারণ প্যাথলজী‌তে রো‌গের যে নামকরণ করা হয় তা কেন হো‌মিওপ্যা‌থি‌তে গ্রহণ‌যোগ্য নয়,
২৮. অ‌চির‌রো‌গে ঔষধ নির্বাচন কেন সহজ ও চির‌রো‌গে কেন ক‌ঠিন,
২৯. ‌রোগী পর্য‌বেক্ষ‌ণের কৌশল সম্প‌র্কে  জান‌তে,
৩০. ‌রোগী‌লি‌পি করার কৌশল সম্প‌র্কে জান‌তে,
৩১. প্র‌ত্যেক মানুষ‌কে স্বতন্ত্রভা‌বে বিচার-‌বি‌শ্লেষণ কর‌তে , মানব‌দে‌হের সং‌বেদনশীলতা সম্প‌র্কে জান‌তে হ‌লে,
৩২. ‌চির‌রোগ আরোগ্য হ‌তে কেন বেশি সময় লা‌গে,
৩৩. অ‌চির‌রো‌গে হো‌মিওপ্যা‌থিক রোগবৃ‌দ্ধি কেন শুভ লক্ষণ, 
৩৪. রোগবৃ‌দ্ধি নিরস‌নের উপায়,
৩৫. ‌চির‌রো‌গের তরুণ উচ্ছাস কী ও তা কেমন হয় সে সম্প‌র্কে জান‌তে,
৩৬. ঔষধ ভুলভা‌বে নির্বা‌চিত হ‌লে‌ চি‌কিৎস‌কের করণীয় কি,
৩৭. এক‌দিক‌বি‌শিষ্ট ব্যা‌ধি কী ও তার চি‌কিৎসা,
৩৮. অস্ত্র‌চি‌কিৎসা কখন প্রয়োজন, 
৩৯. জীবনীশ‌ক্তির বৈ‌শিষ্টসমূহ,
৪০. ‌চি‌কিৎসক কখন ছায়া আরোগ্য দ্বারা প্রতা‌রিত হন,
৪১. সদৃশভাবে  নির্বা‌চিত ঔষধ একসা‌থে আভ্যন্তরীণ সেবন এবং বা‌হ্যিক ব্যবহার কেন নি‌ষেধ,
৪২. মান‌সিক লক্ষ‌ণের গুরুত্ব কেন বে‌শি,
৪৩. ‌হো‌মিওপ্যা‌থি‌তে মান‌সিক ব্যা‌ধির চি‌কিৎসা করা অত্যা‌ধিক সহজ,
৪৪. মহামারী ব্যা‌ধির চি‌কিৎসা, স‌বিরাম ব্যা‌ধির চি‌কিৎসা, রো‌গে আক্রান্ত হওয়ার পূ‌র্বে প্রি‌ভে‌ন্টিভ সম্প‌র্কে বিস্তা‌রিত জান‌তে,
৪৫. ‌রোগী‌দের পথ্যা‌দি সম্প‌র্কে বিস্তা‌রিত জান‌তে,
৪৬. হ্যা‌নিম্যা‌নের সর্ব‌শেষ আবিষ্কার পঞ্চাশ সহস্রত‌মিক শ‌ক্তির ঔষ‌ধের গুণাগুণ সম্প‌র্কে জান‌তে,
৪৭. ‌চির‌রোগ চি‌কিৎসার সমা‌প্তি সম্প‌র্কে জান‌তে,
৪৮. ‌চি‌কিৎসাধীন রোগী‌তে একসা‌থে একা‌ধিক ঔষধ সেবন কর‌তে দেয়া নি‌ষেধ,
৪৯. ঔষধ গ্রহণ করার অঙ্গসমূহ কী কী,
৫০. ‌পে‌টেন্ট কেন হো‌মিওপ্যা‌থি‌তে গ্রহণ‌যোগ্য নয় ইত্যা‌দি।

Previous Post
Next Post

post written by:

DHMS (BHB), PDT and MBA

0 Comments: