What is Philosophy

দর্শন (Philosophy) জ্ঞানের অন্যতম প্রাচীন একটি শাখা। ফিলোসফি শব্দটির প্রথম ব্যবহার করেছিলেন গ্রিক চিন্তাবিদ ও গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ অব্দের দিকে শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। পিথাগোরাস নিজেকে প্রাজ্ঞ ভাবতেন না, বরং প্রজ্ঞার অনুরাগী ভাবতেন। তিনিই ফিলোসফি শব্দটি ব্যবহার করেন love of wisdom তথা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ অর্থে।

দর্শনের সংজ্ঞা হিসেবে এই বিষয়টিকেই গ্রহণ করা যায়। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে দর্শন জ্ঞানের এমন একটি ধারা যা, মানুষের কিভাবে জীবন নির্বাহ করা উচিত (নীতিবিদ্যা); কোন ধরনের বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে এবং তাদের প্রকৃতি কি (অধিবিদ্যা); প্রকৃত জ্ঞান বলতে কোন জিনিসটিকে বোঝায় এবং কারণ প্রদর্শনের সঠিক নীতিগুলো কি কি (যুক্তিবিদ্যা); এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে।

দর্শন হ'ল সাধারণ ও মৌলিক সমস্যাগুলির অধ্যয়ন যেমন বাস্তবতা, অস্তিত্ব, জ্ঞান, মূল্যবোধ, কারণ, মন এবং ভাষার সাথে যুক্ত। বাস্তব অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বা মূল্যবোধের প্রকৃতি, কারণ বা নীতির তদন্ত, অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতির পরিবর্তে যৌক্তিক যুক্তির ভিত্তিতে। মৌলিক অনুমান বা বিশ্বাসের সমালোচনা বিশ্লেষণ।

দর্শন শব্দটি ইংরেজি philosophy শব্দ থেকে এসেছে। ফিলোসফি শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রিক ভাষা থেকে। গ্রিক ভাষায় (philosophía) শব্দটি দুটি শব্দ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। শব্দ দুটি হল: (ফিলোস: বন্ধু, ভালোবাসার পাত্র) এবং (সোফিয়া: প্রজ্ঞা)।

এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, দর্শনের সাথে মূল সম্পর্ক হচ্ছে প্রজ্ঞার, আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসার। জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা এক জিনিস নয়। ঘটনা ও তথ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ও নির্ভুল ধারণা থেকে জ্ঞান লাভ করা যায়, কিন্তু দার্শনিক (যিনি দর্শন চর্চা করেন তাকেই দার্শনিক বলা হয়) কেবল তথ্যগত জ্ঞানের উপর নির্ভর করেন না। দর্শনের প্রধান কাম্য বিষয় প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার অনুসন্ধান ও চর্চার মাধ্যমেই দর্শন বিকাশ লাভ করে।

পিথাগোরাস সারা জীবন প্রজ্ঞার সাধনা করেছেন, কখনও জ্ঞানের গরিমা অনুভব করেননি। এজন্য তিনি দার্শনিক হিসেবে বিদগ্ধ। দর্শনের জন্য যে প্রজ্ঞা কাম্য তার মধ্যে রয়েছে, অন্তর্দৃষ্টি, দৃষ্টিভঙ্গির অভ্রান্ততা, বিচারের ভারসাম্য ও বিশ্লেষণের সামঞ্জস্য। জীবন ও জগত সম্পর্কিত মৌলিক সমস্যাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধান করাই হচ্ছে দর্শন |

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন : “The unexamined life is not worth living.” অর্থাৎ অপরীক্ষিত জীবন যাপন করার কোনো মূল্য নেই | তিনি জগতের সমস্ত কিছুকে পরীক্ষা করেছিলেন | সমস্ত কিছুকে অনুসন্ধান করেছিলেন |তার কাছে দর্শন হলো জীবনকে পরীক্ষা করা | এই পরীক্ষা কিভাবে করেন তিনি ? প্রশ্ন আর উত্তরের দ্বারা |অর্থাৎ প্রশ্ন করা আর উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়েই জীবনকে পরীক্ষা করা হলো দর্শন সক্রেটিসের মতে |

দর্শন (গ্রিক ভাষা ফিলোসোফিয়া, আক্ষরিকভাবে "জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা") হলো অস্তিত্ব, জ্ঞান, মূল্যবোধ, কারণ, মন এবং ভাষা সম্পর্কে সাধারণ এবং মৌলিক প্রশ্নগুলির অধ্যয়ন।

জগৎ, জীবন, মানুষের সমাজ, তার চেতনা এবং জ্ঞানের প্রক্রিয়া প্রভৃতি মৌল বিধানের আলোচনাকেও দর্শন বলা হয়।

দর্শন হল এমন একটি ক্রিয়াকলাপ যা লোকেরা যখন নিজের সম্পর্কে, যে পৃথিবীতে তারা বাস করে এবং পৃথিবী এবং একে অপরের সাথে তাদের সম্পর্ক সম্পর্কে মৌলিক সত্যগুলি বুঝতে চেষ্টা করে।



দর্শক ও দার্শনিক:

দর্শন শব্দের মূল গ্রীকের (ফিলোসফিয়া) বাংলা অর্থ "জ্ঞান-প্রীতি"। আর, বাংলায় দর্শনের অর্থ তো দেখা। এখন যারা দর্শক তারাও দেখে, আর যারা দার্শনিক, দুইজনের "দেখা"র পার্থক্যটা হচ্ছে অন্তর্দৃষ্টির উপস্থিতি।

যে দর্শক, সে দেখে। দেখাটা তার ক্রিয়া। আর যে দার্শনিক, দেখাটা তার ক্রিয়ার অর্ধাংশ মাত্র। দেখার পরে দার্শনিক তাত্ত্বিকভাবে নতুন কিছু যোগ করতে পারেন যা দর্শকের দেখাকে পাল্টিয়ে দিতে পারে।

যা বুঝাতে চাচ্ছি, একটা ঘটনা বা বস্তু পর্যবেক্ষণ করে নতুন একটা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাত্ত্বিকভাবে যারা আলোচনা করতে পারবে তারা দর্শক না হয়ে দার্শনিক হতে পারে। সব মানুষের এইগুণটা আছে। কিন্তু সব মানুষ একই গুণকে একই পরিমাণ চর্চা করেনা বিধায় যারা বেশি করে তারা দার্শনিক উপাধি পায়।

একটা ভুল ধারণা অনেকের আছে যে দর্শন শুধু "কলা" বা "মানবিক" শাখার বিষয়। দর্শন যেকোনো বিষয়ে হতে পারে। Ph.D ডিগ্রীর পূর্ণরূপই হলো Doctor of Philosoph. অর্থাৎ, যেকোনো বিষয় নিয়ে নতুন একটা অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্ন তত্ত্ব দাড় করানোর কথা একজন পিএইচডি ডিগ্রীধারীর। সেইটা ভাষাতে হোক বা মেডিসিনে বা অর্থনীতিতে বা পদার্থবিদ্যায়।

দর্শনের উদ্দেশ্য কী?

"The unexamined life is not worth living". অর্থাৎ অপরীক্ষিত জীবন যাপন করার কোনো মূল্য নেই।সক্রেটিস মহাশয় " জীবন পরীক্ষায়" বিশ্বাসী ছিলেন। আর এই ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ জীবনকে পরীক্ষা করার জন্য দরকার "অনুসন্ধান"। দর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে " অনুসন্ধান"।জীবন,প্রকৃতি,সমাজ ও পরিবেশ ইত্যাদিকে অনুসন্ধান করা এবং সবকিছুর মোটিভ খুঁজা। আপনার মনে কি কখনো এরকম প্রশ্ন এসেছে?

[1] Why are we born ? [2] What is time ? [3] Is God real ? [4] Is there an afterlife ?

যদি এসে থাকে তাহলে আপনাকে অভিনন্দন জানাই।দর্শনের দুনিয়া আপনাকে স্বাগতম! (দরজা, জানালা, ফ্যান, লাইট সবকিছু অফ করে হয়েই যান না আজকের জন্য দার্শনিক!)

দর্শন মানুষকে কল্পনা করতে শেখায়।মানুষকে প্রকৃতি ও নিজের সম্পর্কে জানায়। অনুসন্ধানের মাধ্যমে সবকিছুর মোটিভ বের করতে শেখায়।দর্শনের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকৃতি,জগৎ ও জীবনের উদ্দেশ্য বের

দর্শনের কাজ:

দর্শনের কাজ হল মানুষের মনে উত্থাপিত মৌলিক প্রশ্নাবলির উত্তর বের করার, তথা জীবন ও জগতের মৌলিক সমস্যাবলির সমাধনের প্রচেষ্টা চালানো। এ প্রচেষ্টায় সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত মানুষের মনের জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি হয়না। তাই এসব সমস্যার সমাধানকল্পে মানুষ নিবিষ্টচিত্তে চিন্তা করে। মানুষের এ চিন্তাই দর্শন। দর্শনের কাজকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ যায় যথাঃ

১. কাজের মুল্য়য়েন

২. সমালোচনা মূলক কাজ

৩. গঠনমূলক কাজ

১. কাজের মুল্য়য়েনঃ এই বিশাল রহস্য ঘেরা বিচিএ বিশ্বজগতের দিকে মানুষ তাকাইতেছে আর অবাক হইতেছে।সেজন্য মানুষের চিন্তা চেতনার শেষ নাই। যুগে যুগে মানুষ চেষ্টা করিতেছে বিশ্ব ব্রক্ষান্ডের রহস্য় উদঘাটন করিতে। মানুষ নিজের জীবনের দিকে ফিরিয়া তাকাইয়া ও বিস্মিত হইয়াছে। তাই জীবন সম্পর্কে আত্মা সম্পর্কে জানার ইচ্ছা ও প্রকাশ করিয়াছে। তাই জীবনের উৎস, তাৎপর্য, স্বরুপ, পরিনতি প্রভৃতির যথাযথ ব্য়খ্য়া মুল্য়ায়ন করা দর্শনের কাজ।

২. সমালোচনা মূলক কাজঃ দর্শনের অন্যতম কাজ হইতেছে পরম আদর্শের স্বরূপ নির্ণয় এবং তাহার প্রেক্ষিতে জীবনের মূল্যায়ন।দর্শন অন্ধভাবে কোন কিছুকে গ্রহণ না করলে ও বুদ্ধিগ্রাহ্য কোনকিছুকে ও বাদ দেয় না। দর্শনের কাজ হইল আমাদের অন্ধযুক্তিহীন জগত ও জীবনের ধারনা গুলিকে বিশ্লেষণ করিয়া জগতের সু-সংহত জ্ঞান প্রদান করা। দর্শন বিচার বিবেচনা ছাড়া কোন স্বীকার্য সত্যগুলোকে ও গ্রহণ করে না। তাই সাধারন লোক ও বিজ্ঞানীদের ধারনার সত্যাসত্য নিরুপন করা দর্শনের কাজ।

৩. গঠনমূলক কাজঃ জগত ও জীবন সম্পর্কে ধারণা আমরা দর্শন হইতে পাই। দর্শন খন্ড খন্ড সত্যকে অখন্ডতার সূত্রে গ্রথিত করিয়া পূর্ণ সত্যের ভান্ডারটি আমাদের সামনে তুলিয়া ধরে। তাই দর্শনের কাজ হইতেছে খন্ড খন্ড সত্যকে বাঁধিয়া একখন্ড সত্যের ধারণা দেওয়া।

অভৌতিক রিপু সম্পর্কিত ইন্দ্রিয় সমূহ কি কি আলোচনা কর

মানব জীবন বড়ই বন্ধুর। জীবনে নানা ঘাত প্রতিঘাত জীবনকে প্রতিনিয়ত যেমনি শোধরিয়ে দেয় তেমনি আবার কলুষিতও করে থাকে। পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রাণীর মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পেছনে যে বিষয়গুলো সদা ক্রিয়াশীল তা হলো তার বিবেক, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা।

বিবেক হলো মানুষের অন্তর্নিহীত শক্তি যার দ্বারা ন্যায়, অন্যায়, ভালোমন্দ, ধর্মাধর্ম বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অর্জিত হয়।

বুদ্ধি হলো তার ধীশক্তি বা বোধশক্তি যার দ্বারা জীবন ও জগতে সংগঠিত যাবতীয় ক্রিয়াকলাপে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার বিজ্ঞানময় দক্ষতা নির্ণীত হয়।

বিচক্ষণতা হলো তার দূরদর্শীতা যার মাধ্যমে মানুষ জীবনে আগত ও অনাগত বিষয়ে পান্ডিত্য প্রদর্শন করে নিজেকে সর্বত্র সাবলীল ও সফল করে তুলতে সক্ষম হয়।

নিয়ন্ত্রণ হলো সংযমন যার দ্বারা মানুষ তার জীবনের সর্বত্র সংযত ও শৃক্মখলিত জীবনবেদ অনুধাবনে সক্ষম হয়।

ষড়-রিপু কাকে বলে? এবং ৬টি রিপু কী কী?

সুন্দর ও আদর্শ জীবন গঠনের উল্লেখিত সূচকগুলো যার কারণে প্রায়শ বাধাগ্রস্থ ও প্রতিহত হয় তা হলো ‘‘ষড়রিপু’’। মানুষের এ রিপু ছ'টি সর্ম্পকে সামান্য পরিচিতি হওয়া যাক। ষড়রিপু অর্থাৎ মানুষের চরম ও প্রধান ছ'টি শক্র হলো-কাম, ক্রোধ,লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য।

  • কাম (lust/Sex urge) - লালসা, যৌন সঙ্গকামনা, রিরংসা, যৌনক্ষুধা।
  • ক্রোধ (anger) - রাগ, উত্তেজনার বশীভূত হওয়া।
  • লোভ (greed/Cupidity) - লোলুপতা, লিপ্সা
  • মোহ (attachment/Illusion) - আসক্তি, টান, মায়া, বিভ্রম ।
  • মদ (arrogance/vanity) - অহংকার, দর্প, আত্মগৌরব।
  • মাৎসর্য (envy/jealousy) - অসূয়া, পরশ্রীকাতরতা, অন্যের ভালো দেখতে না পারা।

এগুলো প্রতিটি মানুষের জন্মগত। আমাদের চেষ্টা করা উচিত এগুলো বাড়তে না দেয়া বা নিয়ন্ত্রণে রাখা।

কাম (lust/Sex urge) - লালসা, যৌন সঙ্গকামনা, রিরংসা, যৌনক্ষুধা।

কাম শব্দের আভিধানিক প্রতিশব্দ হলো সম্ভোগেচ্ছা। এ কামশক্তি মানুষের জন্য অপরিহার্য। কামশক্তি নেই সম্ভবত এমন কোন প্রাণীই নেই। এ শক্তিতে অপূর্ণ হলে স্বামী তার স্ত্রীর কাছে যেমন মূল্যহীন আবার স্ত্রী তার স্বামীর কাছেও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয় পৃথিবীতে মানুষ আবাদের কাজটিই অচল হয়ে পড়ে। পৃথিবীর সমুদয় মূল্যই মূল্যহীন হয়ে পড়ে। মোটকথা পৃথিবীতে নারী- পুরুষের জীবন ও যৌবন ঘটিত কোন প্রকার সর্ম্পকই থাকে না। থাকে না প্রেম, ভালবাসা এবং থাকে না রূপ, রস,গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ এ পঞ্চগুণের উজ্জীবিত ও সজিব জীবনের উপস্থিতি।

সুতরাং, মানুষ মাত্রই থাকা চাই নিয়ন্ত্রিত কামশক্তি। এ নিয়ন্ত্রিত কামশক্তি যখন অনিয়ন্ত্রিত, বেপরোয়া ও বেসামাল হয়ে যায় তখনই তা হয়ে যায় শত্রু। অনিয়ন্ত্রিত কামশক্তি জন্ম দেয় উলঙ্গ প্রেম, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অবিশ্বাস ও কলঙ্ক, আরও জন্মদেয় এইডস এর মত নানা জটিল রোগ, শোক, পরিতাপ ও লাঞ্ছনা। সুতরাং কামরিপু মানুষের জন্যে এক চরম শত্রু। জাগতিক জীবনে যারা এ কামশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারাই প্রকৃত প্রস্তাবে যৌনজীবনে লাভ করেছে সুখ, সমৃদ্ধি ও আদর্শ সংসার জীবন।

ক্রোধ (anger) - রাগ, উত্তেজনার বশীভূত হওয়া।

ক্রোধ শব্দের প্রতিশব্দ হলো রাগ। কেবল মানুষই নয় প্রাণী মাত্রই ক্রোধ আছে। ক্রোধ শক্তি একজন মানুষকে অন্যজন থেকে আলাদা হতে সহায়তা করে।তবে ক্রোধের রয়েছে বহুবিধ চেহারা ও প্রকৃতি। ‘‘কুল লক্ষণ' বলে একটি কথা আছে। কুল লক্ষণ অর্থাৎ সৎকুলের ন'টি গুণ রয়েছে। গুণগুলো হলো-আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠা, আবৃত্তি, তপস্যা ও দান।

আসলে ক্রোধান্ধ একজন মানুষের পক্ষে বোধকরি উপরে বর্ণিত ন'টি গুণের একটিতেও সফল হওয়া সম্ভব নয়। কারও মধ্যে এ গুণগুলো অনুপস্থিত থাকলে প্রকৃত প্রস্তাবেই সে আসল মানুষ হতে পারে না। ক্রোধান্ধ মানুষের বিবেক বুদ্ধি থাকলেও তা সে কাজে লাগাতে ব্যর্থ। কিন্তু ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তার মধ্যে শিষ্টাচার, ভদ্রতা, বিদ্যা, আত্মপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সফলতা অর্জিত হতে পারে।

তাই মানুষকে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও রাখতে হবে। এ রাগ বা ক্রোধ মানব জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও কল্যাণে অপতিদ্বনিদ্ব শত্রু বলে বিবেচিত হয়।

লোভ (greed/Cupidity) - লোলুপতা, লিপ্সা

মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যত কাজকর্ম রয়েছে তার প্রতিটির পেছনে নিহীত রয়েছে লোভ। বিনালোভে পৃথিবীতে কিছুই হয় না। লোভ আছে বলেই মানুষের বেঁচে থাকার স্পৃহা আছে।

তবে কথায় বলে-অতি লোভে তাঁতী নষ্ট। আসলে অতি লোভের পরিণাম হিসেবে আসে পাপ এবং পাপের পরিণতি মৃত্যু। পৃথিবীতে মানুষ যে লোমহর্ষক কান্ডগুলো করছে তার মূলে রয়েছে অতি লোভ।

বিশেষ করে নারীর লোভ, অর্থ সম্পদের লোভ, সুনাম অর্জনের লোভ ও নেতৃত্ব লাভের লোভই মানুষের জীবনকে চরম ও ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। তখনই লোভ মানব জীবনের বড় রিপু বলে বিবেচিত হয়। আর তাইতো লোকে বলে- ‘‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’’।

মানুষ যখন লোভের বশীভূত হয়ে পড়ে তখন তার মানবতা, বিবেক, সুবুদ্ধি লোপ পায়। কিন্তু এ লোভকে সংবরণ করে, সংযম করে বা নিয়ন্ত্রণ করে হিতাহিত বোধকে জাগ্রত করে তার জীবন ও জগতের কল্যাণ বিবেচনা করে কাজ চালাতে পারলে সে লোভ তাকে নিতান্ত সুখ স্বর্গে নিক্ষেপ করে। নিয়ন্ত্রিত লোভ পৃথিবীকে সাজিয়ে দিতে পারে অনাবিল আরাম আর কল্যাণময় উন্নতির পুষ্পবাগানে।

4. মোহ (attachment/Illusion) - আসক্তি, টান, মায়া, বিভ্রম ।

মোহ শব্দটি অজ্ঞানতা, অবিদ্যা, মুর্খতা, নির্বুদ্ধিতা, ভ্রান্তি, মুগ্ধতা, বিবেকশূন্য, মায়া, ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আসলে মানব রিপুর মধ্যে এটি অন্যতম একটি রিপু। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ ও মাৎসর্য এ সবকটির উপর মোহ প্রভাব খাঁটিয়ে থাকে। অর্থাৎ মোহ দোষে দূষিত ব্যক্তি বাকি পাঁচটি রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাকে যে কোন রিপু অতি সহজেই গ্রাস করতে পারে। কারণ অজ্ঞতা বা নির্বুদ্ধিতা থেকেই বিবেকশূন্যতার সৃষ্টি হতে পারে। মায়া হলো মোহ রিপুর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

অতিমায়া বা দয়া ক্ষেত্র বিশেষে এতই ক্ষতিকর যে তা আর পুষিয়ে নেয়ার কোন উপায় থাকে না। যেমন- জীব হত্যা মহাপাপ। কিন্তু কোন বিষধর সাপকে যদি কেউ মায়া করে ছেড়ে দেয় তাহলে সে সাপটিই তাকে কামড় দিয়ে হত্যা করতে দ্বিধান্বিত হবে না। কাজেই মোহ বা মায়া সর্বত্রই গ্রহণযোগ্যতা পায় না। একজন অধার্মিক বা মুর্খকে তার গুরুতর কোন অপরাধের পর নিঃশর্ত বা শুধু শুধুই ছেড়ে দিলে সে তার মূল্য রক্ষা করে না-করতে পারে না। কারণ সে জীবনের প্রতিপাদ্য, জীবনবেধ জগতবেধ ইত্যাদি বিষয়ে তার বোধশক্তি ক্ষীণ তাই মোহ তাকে সহজেই আবেষ্টন করে রাখে।

5. মদ (arrogance/vanity) - অহংকার, দর্প, আত্মগৌরব।

মদ হলো দম্ভ, গর্ব, অহংকার, দর্প, প্রমত্ততা, বিহবল ভাব ইত্যাদি। যে কোন ধর্মীয় বিধানে মদের কোন স্থান নেই। মদ মানুষকে তার প্রকৃত অবস্থা থেকে বিকৃত করে দেয়। তার আসল রূপটি লোপ পায়। মদান্ধ মানুষদের অধিকাংশই আত্মগরিমায় ভোগে। এ আত্মগরিমা তার নিজের মধ্যে নিহিত আত্মবোধ বা আত্মদৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে সে পৃথিবীর সবকিছুই তুচ্ছ মনে করে ধরাকে সরাজ্ঞান করে থাকে। জীবনের অর্জিত বা সঞ্চিত যাবতীয় সম্পদকে সে এক ফুৎকারে ধ্বংস করে দিতে পারে।

6. মাৎসর্য (envy/jealousy) - অসূয়া, পরশ্রীকাতরতা, অন্যের ভালো দেখতে না পারা।

মাৎসর্য হলো ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, বিদ্বেষ, অপকার, হনন ইত্যাদি। মাৎসর্যের কোন প্রকার হিতাহিত বোধ নেই। মাৎসর্য উলঙ্গ, অন্ধ ও বিকৃত অবস্থাকে পূজা করে থাকে। মাৎসর্যান্ধ মানুষ নিজে কোন কাজেই কোনকালে সুখ পায় না। নিজের কোন কিছুর প্রতি যত্নবান হওয়া বা খেয়াল করার সুযোগও তার নেই। তার চোখে বুকে অপরের ভাল কাজের প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে থাকে। অথচ তার নিজের পক্ষে তা সম্পন্ন করার ক্ষমতাও তার নেই। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়েও সে মাৎসর্যে লিপ্ত হয়। এমনি এ রিপু তাকে ধীরে ধীরে হীন থেকে হীনতর পর্যায়ে নিয়ে যায়। এক সময় সমাজের চোখে সে চিহ্নিত হয়ে যায়। তখন তার কথা ও কাজের কোনই মূল্য থাকে না।

মাৎসর্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পরশ্রীকাতরতা। পরশ্রীকাতরতা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে চরম অশান্তি ডেকে আনে। পরশ্রীকাতরতার তিনটি দিকে রয়েছে। এক, অন্যের ভাল কিছু দেখলে তার গা জ্বলে যাওয়া; দুই, অপর কেউ ভাল কিছু করলে তার বিরোধিতা করা কিংবা ভাল কাজটির নেতিবাচক দিকগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে অন্যের সামনে হাজির করা; তিন, বেঁকে বসা (উর্ধ্বতন ও অধস্তনদের বেলায়) অর্থাৎ অমান্য বা অবজ্ঞা করা

দর্শনের বিষয়বস্তু:

দর্শনের বিষয়বস্তু অত্যন্ত ব্য়াপক। দর্শন বিশ্ব প্রকৃতির কোন বিশেষ দিকের আলোচনা করে না। দর্শনের বিষয়বস্তুকে মোটামুটি ভাবে চার ভাগে ভাগ করা যায় যথাঃ

  • জ্ঞানবিদ্যা (Epistemology)
  • তত্ত্ববিদ্যা বা অধিবিদ্যা (Metaphysics)
  • রূপ বিজ্ঞান
  • আদর্শ বিদ্যা
  • নীতিবিদ্যা
  • যুক্তিবিদ্যা
  • জ্ঞানবিদ্যা (Epistemology)

জ্ঞানতত্ত্ব জ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি সংশ্লিষ্ট দর্শনের শাখা। জ্ঞানতাত্ত্বিক অভিযাত্রা মূলত ‘জ্ঞান কি’ এবং ‘কিভাবে এটি অর্জিত হতে পারে’- এ-প্রশ্নগুলো নিয়েই। জ্ঞানবিজ্ঞানের উদ্বেগের সাধারণ প্রশ্নগুলি হ'ল:

What is knowledge? জ্ঞান কী?

Do we know anything at all? আমরা কি আদৌ কিছু জানি?

How do we know what we know? আমরা কীভাবে জানি যা আমরা জানি?

Can we be justified in claiming to know certain things? আমরা কি কিছু নির্দিষ্ট জিনিস জানার দাবীতে ন্যায়সঙ্গত হতে পারি?

যেকোনো বিষয় বা সত্তা সম্পর্কে কী মাত্রায় জ্ঞান অর্জন করা যায়- এটা নিয়েও আলোচনা চলে। জ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতির দার্শনিক বিশ্লেষণ এবং এটি (জ্ঞানের স্বরূপ) কিভাবে সত্য, বিশ্বাস ও যাচাইকরণ ধারণার সাথে সম্পর্কিত- বেশিরভাগ বিতর্ক এটাকে কেন্দ্র করেই। গ্রিক "epistēmē" ও "logos" শব্দ দুটি মিলে Epistemology বা জ্ঞানতত্ত্ব শব্দটির উদ্ভব।

দর্শনের যে শাখায় জ্ঞান, জ্ঞানের উৎপত্তি, স্বরূপ ও বিষয়বস্তু, আকার, বৈধতা-অবৈধতা, সত্য-মিথ্যার বার্তা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়, তাকে জ্ঞানবিদ্যা বলে।

তত্ত্ববিদ্যা বা অধিবিদ্যা (Metaphysics):

তত্ত্ববিদ্যা দর্শনের সত্তা সম্পর্কিত আলোচনা । বিশদভাবে , এর আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সত্তা বা পরম এর সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহ । বিশেষত অস্তিত্ব,বাস্তবতা এবং এদের সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনাই তত্ত্ববিদ্যার মুখ্য আলোচনার বিষয় । দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে এটি অধিবিদ্যা নামেও পরিচিত । তত্ত্ববিদ্যা অস্তিত্বশীলতা এবং অস্তিত্বশীল বিষয়ের একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

অধিবিদ্যায় দার্শনিকরা নিম্নলিখিত প্রশ্নের সম্মুখীন।

Is there a God? ঈশ্বর আছে কি?

What is the truth? সত্য কি?

What is a person? What makes a person the same through time? একজন ব্যক্তি কী? কী সময়ের সাথে একজনকে একই করে তোলে?

Is the world strictly composed of matter? পৃথিবী কি কঠোরভাবে পদার্থ নিয়ে গঠিত?

Do people have minds? If so, how is the mind related to the body? মানুষের মন আছে কি? যদি তা হয় তবে মন কীভাবে দেহের সাথে সম্পর্কিত?

Do people have free wills? মানুষের কি স্বাধীন ইচ্ছা আছে?

What is it for one event to cause another? একটি ইভেন্টের জন্য অন্যটির কারণ কী?

অধিবিদ্যা (Metaphysics) হল দর্শনের একটি শাখা যাতে বিশ্বের অস্তিত্ব, আমাদের অস্তিত্ব, সত্যের ধারণা, বস্তুর গুণাবলী, সময়, স্থান, সম্ভাবনা ইত্যাদির দার্শনিক আলোচনা করা হয়। এই ধারার জনক অ্যারিস্টটল। মেটাফিজিক্স শব্দটি গ্রিক ‘মেটা’ এবং ‘ফিজিকা’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

তত্ত্ববিদ্যায় কিছু মৌলিক প্রশ্ন হলোঃ

  • "অস্তিত্বশীলতা কি?"
  • "বস্তু কি?"
  • "অস্তিত্বশীল বস্তুসমূহ কোন উপায়ে সম্পর্কিত হয়?"
  • "সত্তা কি?"

দার্শনিকগণ তত্ত্ববিদ্যাকে বিভিন্ন উপায়ে শ্রেণিবিভক্ত করেন । যথাঃ

পরা-তত্ত্ববিদ্যাঃ যেসকল ধারণা তত্ত্ববিদ্যার বিকাশ ঘটায় সেসকল বিষয়ের আলোচনা করে।

কার্য-তত্ত্ববিদ্যাঃ বিশেষ কোন বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত ধারণা, কার্যক্ষেত্র অথবা এর সাথে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ধারণা নিয়ে আলোচনা করে, কম্পিউটারের ভাষা, অথবা বিজ্ঞানের কোন বিশেষ শাখার ন্যায় ।

ইন্টারফেস অধিবিদ্যাঃ দুইটি বিদ্যার ধারণার সংযোগ ঘটানো

পদ্ধতিগত তত্ত্ববিদ্যাঃ ইনপুট, আউটপুট, সীমাবদ্ধতা, ক্রম তথ্য ইত্যাদির কৌশল প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে ।

রূপ বিজ্ঞান:

দৃশ্যমান জগতের রূপ সৌন্দর্য নিয়ে বিজ্ঞানের মত দর্শন ও আলোচনা করে। দর্শনের যে শাখা দেশ কাল প্রেক্ষিতে জড়বস্তু মন ও প্রানের প্রকাশিত রুপের আলোচনা করে তাহাকে রুপ বিজ্ঞান বলে।

আদর্শ বিদ্যা:

দর্শনের এই শাখায় কোন বিযয়ের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। মূল্যর শ্রেণীবিন্যাস ও সত্য, সুন্দর ও কল্যাণকর আদর্শ, মানবতাবাদ সেই সাথে মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনা ও এই শাখার অন্তভূও।

নীতিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র (মূল্যবিদ্যা):

নীতিশাস্ত্র দর্শনের একটি শাখার নাম। মানুষের ব্যবহারগত সম্পর্কের তাৎপর্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে নীতিশাস্ত্র বিকাশ লাভ করেছে।

নীতিশাস্ত্রের দুটি দিক প্রধান। একটি হচ্ছে নীতির তত্ত্বের দিক। অর্থাৎ ভালোমন্দ কাকে বলে; মানুষের কর্মের পেছনে একটা চালক শক্তি আছে, এ কথার তাৎপর্য কী ইত্যাদি প্রশ্নের তত্ত্বগত এবং ঐতিহাসিক আলোচনা হচ্ছে নীতি-তত্ত্বের বিষয়।

নীতিশাস্ত্রের অপর দিক হচ্ছে তত্ত্বের প্রয়োগগত দিক। মানুষের কোনো ব্যবহার সৎ বা ভালো এবং কোনো ব্যবহার মন্দ; মানুষের সঙ্গে মানুষের কী সম্পর্ক থাকা সঙ্গত; ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে কোনো নীতির বন্ধন কাম্য এবং কোনো আদর্শ অনুসরণ সঙ্গত– এ সমস্ত বিষয়ের আলোচনা ব্যবহারিক নীতিশাস্ত্রের প্রয়োগের শাখায় অধিক পরিমাণে করা হয়।

নীতিশাস্ত্র হল এমন এক বিদ্যা বা শাস্ত্র যা মানুষের আচরণের মঙ্গল- অমঙ্গল, ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। অর্থাৎ নীতিবিদ্যার কাজ হল মানুষের আচরণের ভাল-মন্দ, উচিত- অনুচিতের বিচার করা। সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে মানুষের আচরণের নৈতিকতার দিকটির যথাযথ মূল্যায়ন করা শাস্ত্রটির প্রধান লক্ষ্য।

একটি নৈতিক আদর্শ বা মানদণ্ডের আলোকে মানুষের আচরণের নৈতিক মূল্য নির্ধারণ করা এর প্রধান কাজ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মানুষের ঐচ্ছিক আচরণেরই কেবলমাত্র নৈতিক বিচার করা সম্ভব, কোন বাধ্যতামূলক আচরণের নৈতিক বিচার করা যায় না। কেননা, যে কাজ মানুষ তার নিজ ইচ্ছা বা মর্জিতে করে তার জন্য সে অবশ্যই দায়ী থাকে। কিন্তু যে কাজ তার নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে করে বা করতে বাধ্য হয় তার জন্য তাকে দায়ী করা যায় না।

যেমন: যখন কোন সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু-সেনাকে হত্যা করে তার জন্য তাকে নৈতিক দিক দিয়ে তাকে দায়ী করা যায় না। কাজটি তার নিজের ইচ্ছায় সংগঠিত হয় নি বরং তা তার নিজ সেনাধ্যক্ষের নির্দেশে করতে সৈনিকটি বাধ্য হয়। এমন কাজের নৈতিকতা বিচার অবান্তর।

যুক্তিবিদ্যা:

পৃথিবীতে বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন চিন্তাশীল স্বাধীন সত্তা হিসেবে যেদিন থেকে মানুষের যাত্রা শুরু সেদিন থেকেই যুক্তির চিন্তার সূত্রপাত। মানব মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল চিন্তন। বিজ্ঞান ভিত্তিক জ্ঞান হল যুক্তিবিদ্যার জ্ঞান।

মানুষ চিন্তাশীল জীব। মানুষ যেহেতু চিন্তা করতে পারে তাই জানা থেকে অজানাকে জানার কৌতুহল চিরন্তণ। জানার মাধ্যমে অজানাকে জানার মানসিক প্রক্রিয়াকে বলা হয় অনুমান। আর অনুমান ও তার সহায়ক প্রক্রিয়াসমূহ নিয়ে যে বিদ্যা আলোচনা করে তাকে বলা হয় যুক্তিবিদ্যা।

উৎপত্তিগত অর্থে যুক্তিবিদ্যার ইংরেজী প্রতিশব্দ Logic- এর উৎপত্তি হয়েছে গ্রীক শব্দ Logike থেকে। Logike শব্দটি আবার গ্রীক Logos শব্দের বিশেষণ। Logos শব্দের অর্থ চিন্তা বা ভাষা। সুতরাং শব্দগত অর্থে যুক্তিবিদ্যা হলো ভাষায় প্রকাশিত চিন্তা বিষয়ক বিজ্ঞান। এখানে লক্ষনীয় যে ‘চিন্তা’ কথাটি খুবই ব্যাপক। মনোবিজ্ঞানে ‘চিন্তা’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যুক্তিবিদ্যায় ‘চিন্তা’ বলতে আমরা শুধুমাত্র অনুমানকে বুঝে থাকি।

  • যোসেফের মতে, “যুক্তিবিদ্যা হলো চিন্তার বিজ্ঞান।”
  • হোয়েটলি বলেন, “যুক্তিবিদ্যা হলো যুক্তিপদ্ধতির বিজ্ঞান ও কলা।”
  • টমসনের মতে, “যুক্তিবিদ্যা হলো চিন্তার নিয়মাবলীর বিজ্ঞান।”
  • হ্যামিলটন বলেন, “যুক্তিবিদ্যা হলো চিন্তার আকারগত নিয়মাবলীর বিজ্ঞান।”
  • অলড্রিচের মতে, “যুক্তিবিদ্যা হলো যুক্তি সংক্রান্ত কলা।”
  • ওয়েলটন বলেন, “যুক্তিবিদ্যা হলো বৈধ চিন্তার নীতিমালা নিয়ন্ত্রনকারী বিজ্ঞান।”

জে. এস. মিল তিনি তার সংজ্ঞায় বলেন, “যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে ঐ সব চিন্তন প্রক্রিয়ার বিজ্ঞান, যে প্রক্রিয়াগুলো সাক্ষ্য প্রমাণের উপর নির্ভরশীল; অথাৎ জ্ঞাত সত্য থেকে অজ্ঞাত সত্যে উপনীত হওয়ার প্রক্রিয়া এবং তার সহায়ক অন্যান্য সব প্রক্রিয়া সম্পর্কীত বিজ্ঞান।”

পরিশেষে যুক্তিবিদ্যার সংজ্ঞায় একথা বলা যায়, যে বিদ্যা যুক্তি ও তার সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াগুলোর সাহায্যে যথার্থ যুক্তি প্রয়োগ ও অযথার্থ যুক্তি পরিহার করতে সহায়তা করে তাকে যুক্তিবিদ্যা বলে।

কী পড়ানো হয়?

প্রত্যেক মানুষেরই তার নিজেকে জানা প্রয়োজন। নিজেকে জানার পদ্ধতিটা কী? আমি কে, আমি কীভাবে এলাম, আমাদের জগৎ কীভাবে সৃষ্টি হলো ইত্যাদি সম্পর্কে জানা গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ বলছি কারণ, আমরা নিজেদের যেভাবে জানি, তার ওপর ভিত্তি করেই জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিই। কেউ হয়তো বিজ্ঞানী হবে, কেউ পরিসংখ্যানবিদ হবে, কেউ হবে অর্থনীতিবিদ। কিন্তু এই অর্থনীতি, পরিসংখ্যান বা বিজ্ঞানের লক্ষ্য কী? সে লক্ষ্য সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কতটা কাজে লাগবে, একজন অর্থনীতিবিদ বা একজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গি কী রকম হবে, কিংবা প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও আমাদের লক্ষ্য কী হবে—আমরা যদি এই পুরো বিষয় সম্পর্কে একটা বিচারমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাই, তাহলে আমাদের দর্শন পড়া উচিত।

কারা পড়বে?

দর্শন তারই পড়া উচিত, যার একটা বিষয় সম্পর্কে গভীরে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। কেউ হয়তো গণিত বোঝে। কিন্তু এই গণিত কীভাবে এল, তা জানতে চাইলে শুধু গণিত বুঝলে হবে না, আরও একটু প্রচেষ্টা লাগবে। এ রকম শুধু গণিত নয়, যেকোনো বিষয়েই যার এ ধরনের কৌতূহলী মন আছে, যে নিজের ধারণা-অবস্থান দিয়ে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ একটা অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, যে যুক্তিশীল, নৈতিক, সুন্দর মনের মানুষ হতে চায়, সর্বোপরি, কোনো বিষয়ের গভীরে যে যেতে চায়, তারই দর্শন পড়া উচিত

Previous Post
Next Post

post written by:

DHMS (BHB), PDT and MBA

0 Comments: