হোমিওপ্যাথি মানবকল্যানমুখী এক আদর্শ চিকিৎসা পদ্ধতি ।ইহার একটি নিজস্ব দর্শন আছে ।প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের চিরন্তন বিধানসমূহের উপর ইহার প্রতিটি নীতি সুপ্রতিষ্ঠিত । বিশ্বখ্যাত জার্মান চিকিৎসা-বিজ্ঞানী মহাত্মা স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ১৭৯৬ সালে এই বৈপ্লবিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রবর্তন করেন ।এই পদ্ধতি প্রচলিত সমস্ত চিকিৎসা-পদ্ধতি থেকে নীতি ও প্রয়োগ-পদ্ধতিতে সম্পূর্ন স্বতন্ত্র।
চিকিৎসা দর্শনের যে শাখায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার বিষয়বস্তুু, নিয়মনীতি, আদর্শ, রোগ প্রতিরোধ ও রোগ আরোগ্য জীবনী শক্তির কার্যাবলী বর্ণনা, সুস্থ ও অসুস্থ দেহে স্থুল ও সূক্ষ্ম মাত্রা এবং নিম্ন ও উচ্চ শক্তি সম্পন্ন ঔষধের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা, রোগের মূল কারণ অনুসন্ধান, রোগ রোগী ও চিকিৎসকের সম্পর্ক, কিভাবে কখন কোন নিয়মে ঔষধ প্রয়োগ করিলে রোগী আরোগ্য লাভ করিবে, ঔষধ দেহ ও রোগ লক্ষণের একে অপরের সঙ্গে কি সম্পর্ক প্রভৃতি সম্পর্কে জানা যায় তাহাকে হোমিওপ্যাথিক দর্শন বলে।
হোমিওপ্যাথি দর্শনের উদ্দেশ্য কি?
”আমি আর রোগ যন্ত্রনা সহ্য করতে পারছি না, আমাকে বাচান।”-একজন রুগ্ন মানুষই আর্তকন্ঠে চিকিৎসকের কাছে এই আকুল আবেদন জানায় ।আর তাই এই রুগ্ন মানুষই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার কেন্দ্র বিন্দু ।যে মানুষটি কোন রোগাবস্থায় ভুগছে, তাকে সেই অবস্থা থেকে মুক্ত করে তার পূর্ব স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনাই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উদ্দেশ্য।
হোমিও দর্শনের উদ্দেশ্য হইল হোমিওপ্যাথির খন্ড খন্ড সত্যকে সুসংবদ্ধ ও সুসংহত করিয়া এক অখন্ড ধারনা দেওয়া এবং হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি গুলির সুযোজন ও সমন্বয় সাধনই ইহার উদ্দেশ্য।
স্যামুয়েল হ্যানেম্যানের হাত ধরে অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে চালু হয় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি৷ এই চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল দর্শন হচ্ছে, একটি বস্তু যদি সুস্থ মানুষের মধ্যে অসুস্থতার উপর্সগ সৃষ্টি করে তা হলে সেই বস্তুই অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করতে সক্ষম৷ স্যামুয়েল হ্যানেম্যান নিজে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও এই নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলিত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন৷
অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থার মতো সর্বজনবিদিত না হলেও বহু বিতর্কের মধ্যে দিয়ে এই চিকিৎসা বিজ্ঞান বিশ্বের অনেক দেশেই জনপ্রিয় হয়েছে৷
হোমিওপ্যাথি দর্শনের কাজ কি?
প্রাকৃতিক আরোগ্যের স্বীকার্য সত্য গুলিকে বিচার বিবেচনা ছাড়া হোমিও দর্শন গ্রহণ করে না। সুতরাং সাধারণ লোকের এবং চিকিৎসকের ধারনার সত্যাসত্য নিরূপণ করা হোমিও দর্শনের কাজ।
প্রাকৃতিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খন্ড খন্ড সত্যকে শৃংখলিত করিয়া এক অখন্ড সত্যের ধারণা দেওয়া, রোগের উৎপওি, তাৎপর্য, স্বরুপ এবং রোগ আরোগ্য সম্ভাবনার যথাযথ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন করা হোমিও দর্শনের কাজ।
হোমিওপ্যাথিতে একজন মানুষকে সম্পুর্ণরূপে চিন্তা করা হয় এবং চিন্তা করা হয় তার জীবনীশক্তি আক্রান্ত হয়েছে কোন রোগ শক্তির দ্বারা এবং তা বাইরে প্রকাশ পেয়েছে তার মানসিক ও শারীরিক লক্ষণের মাধ্যমে, তার সেই সমষ্টিটাই হল তার সম্পুর্ণ রোগচিত্র।
হোমিও দর্শনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব আলোচনা কর:
হোমিওপ্যাথি একটি উন্নতমানের সার্থক চিকিৎসা বিজ্ঞান। নীরবে, নিরুপদ্রবে, স্থায়ীভাবে এবং সর্বাপেক্ষা সুখবোধ্য বিধান মতে চিকিৎসা করা এবং রোগারোগ্য করাই হোমিওপ্যাথি মূল আদর্শ। হোমিও দর্শন আমাদিগকে শিক্ষা দেয় সেই আদর্শ।
দর্শন পাঠ করিলে আমরা স্রষ্টা ও সৃষ্টির রহস্য, তাহাদের সম্পর্ক, সৃষ্টির উদ্দেশ্য, মানোবতাবোধ, মমত্ববোধ, ব্যাধি কি ও কেন ? রোগ ও রোগীর সম্পর্ক, ঔষধ প্রয়োগের নিয়ম, নীতি ও আদর্শ এবং উদ্দেশ্য, কখন কিসে কোন রোগ কিভাবে বাড়ে বা কেম, কোন শক্তিতে কখন ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে, সোরা, সিফিলিস ও সাইকোসিস কি ও কেন ? ইহাদের আক্রমণ ও প্রতিকার, তরুণ রোগ, পুরাতন রোগ ও তাহাদের চিকিৎসা, রোগীর মনে ও দেহের অবস্থা প্রভৃতি আমরা দর্শন পাঠে জানতে পারি।
দর্শন না পড়িলে চিকিৎসা করা যায় না এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হওয়া যায় না। দর্শন আমাদিগকে জ্ঞানের, বিজ্ঞানের, হোমিও বিজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ভালবাসা শিক্ষা দেয়।
হোমিওপ্যাথির বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত উপাওগুলিকে গ্রথিত ও সংলগ্ন করিয়া উহাদের কার্যকরী ও উদ্দেশ্য সাধনের সমর্থ করিয়া তুলিতে হোমিও দর্শনের যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে ।
ডাঃ হ্যানিম্যানের চিকিৎসা দর্শনের মূলনীতিগুিল কি কি?
জার্মান চিকিৎসক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান উদ্ভাবিত (১৭৯৬) এক চিকিৎসা পদ্ধতি। এই চিকিৎসা পদ্ধতির অন্তর্নিহিত মূলনীতি হচ্ছে- কোনো একজন সুস্থ ব্যক্তির শরিরে যে ওষুধ প্রয়োগ করলে তার মধ্যে যে লক্ষণ দেখা দেয়, ওই একই ওষুধ সেই লক্ষনের ন্যায় অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তির উপরে প্রয়োগ করলে তা অসুস্থ ব্যক্তির জন্য অসুখের লক্ষণ নিরাময়ের কাজ করে।হ্যানিম্যানের প্রস্তাবিত এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থা।
হ্যানিম্যান বিশ্বাস করতেন সকল অসুখের মূলে রয়েছে "মায়াজম" নামক একধরনের প্রতিক্রিয়া এবং হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এই মায়াজম দূর করার জন্য কার্যকর।
নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের ন্যায় মাহাত্ম্য হ্যানিম্যান ও তাঁহার চিন্তাশক্তি দর্শন দ্বারা "Similla Similibus Curentur সিমিলা সিমিলিবাস কুরেন্টুর" পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই দর্শন পৃথিবীর অন্য কোন দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক বা চিকিৎসকের মধ্যে দেখা যায় না। তাহার আবিষ্কৃত চিকিৎসা শাস্ত্রের নাম হোমিওপ্যাথি। তাহার চিকিৎসা দর্শনের মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ।
👨 প্রাকৃতিক রোগ শক্তি সূক্ষ্ম ও অজড়। ইহা প্রকৃতি প্রদও একটি অশুভ শক্তি।
👨 মানবদেহের অভ্যন্তরে এক অজড় অমূর্ত্ত আত্মিক জীবনীশক্তি বিরাজমান। এই শক্তি মানবদেহের প্রতি অঙ্গে, প্রতি কোষে সমানভাবে পরিব্যপ্ত থাকিয়া দেহের প্রতিটি যন্ত্রকে স্বীয় কার্য সম্পাদনে নিয়োজিত রাখে। সদৃশ অজড় এই জীবনী শক্তিই বিশৃংখলা প্রাপ্ত হয় বা অসুস্থ হয়।
👨 প্রাকৃতিক আরোগ্যনীতি "Similla Similibus Curentur সিমিলা সিমিলিবাস কুরেন্টুর" অনুসারে রোগী ও ঔষধের সাদৃশ্য লক্ষ ণ অনুযায়ী প্রকৃত আরোগ্য সাধিত হয়।
👨 সুস্থদেহে যে ঔষধ রোগ সৃষ্টি করিতে পারে, ঐ ঔষধেরই রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা আছে।
👨 সদৃশ লক্ষণাযায়ী একবার একটিমাত্র ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে।
👨 সূক্ষমাত্রার শক্তিকৃত ঔষধই সূক্ষ রোগশক্তি দূরীকরণের উপযুক্ত অস্ত্র।
👨 রোগের আক্রমণে কোন বিশেষ অঙ্গ নয়, গোটা জীবনীশক্তি অসুস্থ হয়। তাই চিকিৎসা আঙ্গিকভাবে নয়, সামগ্রিকভাবেই করিতে হইবে।
👨 ক্ষুদ্র মাত্রার ঔষধ প্রয়োগ করিয়া চিকিৎসা করিতে হইবে
👨 যেহেতু মাবনদেহে মিশ্র ঔষধের প্রকৃত ক্রিয়া অজ্ঞাত সেহেতু একবারে একাধিক ঔষধ প্রয়োগ করা যাইবে না
0 Comments: